RECRUITMENT SCAM KUNTAL GHOSH

পিরামিডের মাথায় পার্থর চেয়েও 'প্রভাবশালী'

রাজ্য কলকাতা

recruitment scam partha Chatterjee kuntal ghosh avishek banerjee mamata banerjee enforcement directorate tmc bengali news

ধৃত প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি-ই নিয়োগ দুর্নীতির একমাত্র মাথা নন। পার্থ চ্যাটার্জির থেকেও বেশি প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান ব্যক্তি রয়েছেন এই নিয়োগ দুর্নীতির পিরামিডের মাথায়। ২০১৪’র টেট থেকে ২০২১ পর্যন্ত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে যে বিপুল টাকার লেনদেন হয়েছে তা গিয়েছে সেই ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’র কাছেই।

নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে এবার এমনই বিস্ফেোরক দাবি কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র। গত ১৪ দিন হেপাজতে নিয়ে ধৃত যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষকে জেরা করেই ইডি’র হাতে এসেছে এমন তথ্য। টাকার পাশাপাশি দামি দামি গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট সহ একাধিক মূল্যবান ‘উপহার’ কুন্তলের মাধ্যমে পেত ওই প্রভাবশালী মহল। সেই ‘উপহার’র পরিমাণও কোটি কোটি টাকা। সেই উপহারের বিনিময়েই যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক পদে বসিয়ে দেওয়া হয় প্রতারক কুন্তল ঘোষকে।

শুক্রবারই আদালতে ইডি’র তরফে নিয়োগ কাণ্ডে ধৃত কুন্তল ঘোষকে জেরা করে পাওয়া তথ্য উল্লেখ করে যে সাবমিশন পেশ করা হয় তাতেও স্পষ্ট করে জানানো হয়, চাকরি দেবার নামে কুন্তল ঘোষ যে ১৯ কোটি টাকা এবং পরবর্তী টেট পাশ করিয়ে দেওয়া এবং নবম-দশমে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগের নামে মোট যে টাকা তুলেছিলেন তার থেকে একটা বড় অংশের ভাগ পার্থ চ্যাটার্জি ছাড়াও অত্যন্ত প্রভাবশালীদের কাছে পাঠাতেন। জেরাতে এই যুব তৃণমূল নেতা স্বীকার করেছেন যে ওই ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’ ব্যক্তিই টাকার বিনিময়ে এই অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তাঁকে সাহায্য করতেন। এখানে ‘সাহায্য’ মানে যে অবৈধভাবে অযোগ্যদের নিয়োগ নিশ্চিত করা, অবৈধ মেধা তালিকা তৈরি করা— তাও জানিয়েছে ইডি। সেই কারণেই সেই অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এখন ইডি’র তদন্তের নজরদারিতে। শুধু তাই নয়, ইডি’র দাবি, দুর্নীতির জাল এমনভাবে ছড়ানো হয়েছিল যে প্রাথমিক থেকে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ, উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ, এসএসসি’র আধিকারিকরা সকলেই ‘ভাগ’ পেয়েছিলেন।

পার্থ চ্যাটার্জি থেকে মানিক ভট্টাচার্য, মধ্যশিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলি, এসএসসি’র প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচার্য, নিয়োগ নজরদারি কমিটির প্রাক্তন উপদেষ্টা শান্তিপ্রসাদ সিনহা, এসএসসি’র তৎকালীন সচিব অশোক সাহা প্রত্যেকেই সেই সুবিধা পেয়েছেন। কুন্তল ঘোষের তরফে বিলাসবহুল গাড়ি উপহার পেয়েছিলেন। নিয়োগ দুর্নীতির টাকায় কুন্তল ঘোষের দেওয়া গাড়ি চাপেন তৃণমূলের এক যুব নেত্রী সহ একাধিকজন। ইডি সূত্রে জানা গিয়েছে, গত আট বছরে ১০০টির মতো গাড়ি কুন্তল ঘোষ বিভিন্ন জনকে উপহার হিসাবে দিয়েছেন, যার বিনিময়ে আট বছর ধরে নিশ্চিন্তে এই বেআইনি নিয়োগ চক্র চালিয়ে গিয়েছে। কলকাতা, হুগলীর একাধিক গাড়ি ব্যবসায়ী, শো-রুম থেকে এই গাড়ি নেওয়া হয়েছিল, একাধিক ক্ষেত্রে টাকাও মেটানো হয়নি। সেই গাড়ি এখনও চড়ছেন এমন ব্যক্তিও রয়েছে।

একইসঙ্গে সরকারি চাকরি বেচার টাকা একাধিক ভুয়ো, শিখণ্ডি সংস্থাতেও ঢুকেছে। ইডি’র তরফে দাবি করা হয়েছে, নির্দিষ্ট দুটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট আছে কুন্তল ঘোষের। সেই দুটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে কুন্তল ঘোষ নিজে সাড়ে ছয় কোটি টাকা ডিপোজিট করেছিল। যদিও অ্যাকাউন্টে সেই টাকা জমা পড়ার পরেই একাধিক ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে সেই টাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছিল। সেই ব্যাঙ্কগুলির হদিশও পেয়েছে ইডি। মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তও চলছে। শুধু একাধিক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাচারই নয় নিয়োগ দুর্নীতির টাকায় টলিউডেও খাটানো হয়েছিল। একটি মিউজিক কোম্পানিও পার্টনারশিপে খুলেছিলেন এই যুব তৃণমূল নেতা।
তবে পার্থ চ্যাটার্জির নাকতলার বাড়িতে একাধিকবার গিয়েছেন কুন্তল ঘোষ। ধৃত প্রাক্তন শিক্ষা মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতা মুখার্জির হরিদেবপুর ও বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাটেও যাতায়াত ছিল তাঁর। 

ইডি‘র জেরাতেই কুন্তল ঘোষ স্বীকার করেছেন, নিয়োগ কাণ্ডে দফায় দফায় নগদে ১৫ কোটি টাকা সে পার্থ চ্যাটার্জিকে দিয়েছিল। অর্পিতা মুখার্জির ফ্ল্যাটের সেই টাকা তুলে দেওয়া হতো পার্থ চ্যাটার্জির কাছে।
ইতিমধ্যেই আরেক শিক্ষা ব্যবসায়ী তাপস মণ্ডল একটি সংবামাধ্যমে ইন্টারভিউতে জানিয়েছিলেন, তাঁর কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে মাথা পিছু কয়েক করে লক্ষ টাকা নেওয়ার পরে ফেরত দেওয়ার কথা বললে কুন্তল নাকি জানাতো ‘কালীঘাটের কাকু’কে টাকা দিতে হয়! কে সেই কালীঘাটের সেই কাকু? তাঁর নামও জানান তাপস মণ্ডল। তাঁর নাম সুজয় ভদ্র বলে দাবি তাপস মণ্ডলের। 

সুজয় ভদ্র কলকাতার বাসিন্দা। অভিষেক ব্যানার্জির অফিসেই এই মাঝবয়সি ব্যক্তিকে দেখা যায়। নারদ স্টিং অপারেশনে অভিষেক ব্যানার্জির ক্যামাক স্ট্রিটের অফিসের যে ভিডিও দেখা গিয়েছিল তাতেও ছিলেন তিনি। তাঁকে অভিষেক ব্যানার্জির খুবই ঘনিষ্ঠ বলে দাবি করা হয়। এই ব্যক্তিই আবার ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’ তৈরি হওয়ার পরে বোর্ড অব ডিরেক্টরস’এ ছিলেন। সেই সময় অভিষেক ব্যানার্জিও ছিলেন বোর্ড অব ডিরেক্টরসে। ২০১৪ সালে লোকসভা ভোটের আগে বোর্ড অফ ডিরেক্টরস থেকে পদত্যাগ করেন।

ফলে নিয়োগ কাণ্ডে যার পকেটে কোটি কোটি টাকা ঢুকেছে গত আট বছরে, যে সাহায্য করেছিল বলেই অবৈধ নিয়োগ চক্র চালিয়ে গেছে কুন্তল ঘোষ দীর্ঘদিন এবার সেই ‘অত্যন্ত প্রভাবশালী’ ব্যক্তির ভূমিকাও ইডি’র তদন্তের আওতায়।


 

Comments :0

Login to leave a comment