Editorial

প্রতিবাদের মুখে নত সরকার

সম্পাদকীয় বিভাগ

মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকারের ঔদ্ধত্য, তেজ এবং কর্তৃত্ব খানিকটা হলেও ঢিলে হয়ে গেছে আর জি কর কাণ্ডকে কেন্দ্র করে। হাসপাতালের মধ্যেই কর্তব্যরত চিকিৎসক ছাত্রীর ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদের আগুন যেভাবে রাজ্যজুড়ে জ্বলে উঠেছে এবং ছাত্র-যুব-মহিলা সহ সব অংশের মানুষের অংশগ্রহণে যেভাবে গণঅভ্যুত্থানের চেহারা নিচ্ছে তাতে হারানোর ভয়ে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়া ছাড়া শাসকের উপায় নেই। তাই আপন সিদ্ধান্তে গোঁ ধরে বসে থাকার জেদকে পাশে সরিয়ে সরকার বাধ্য হচ্ছে আন্দোলনের কাছে মাথানত করতে। ক্ষমতার দম্ভে জনগণের ওপর যা কিছু সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেবার দিন শেষ।
ধর্ষণ-খুনের ঘটনার পরদিন থেকেই ন্যায় বিচারের দাবিতে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের ঢেউ যেভাবে আছড়ে পড়তে শুরু করেছে তাতেই প্রমাদ গুনতে শুরু করেছে সরকার। প্রতিবাদের উত্তাপ কিছু কমাতে আর জি করের অধ্যক্ষকে দিয়ে পদত্যাগের নাটক করানো হয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী সেই চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ‘মহান ব্যক্তি’র প্রতি স্নেহ পরবশ হয়ে তাকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অবশ্য তাকে তার কুকীর্তির জন্য পুরষ্কৃত করে ন্যাশনাল মেডিক্যা্ল কলেজের অধ্যক্ষ পদে নিয়োগ করা হয়। যদিও ন্যাশনালের ডাক্তাররা সেই কুখ্যাত ব্যক্তিকে হাসপাতালেই ঢুকতে দেননি। এক মন্ত্রী ও রোগী কল্যাণ কমিটির শাসক নেতা তদবির করতে গিয়ে কার্যত ঘাড় ধাক্কা খেয়ে পালাতে হয়েছে। এরপর বাধ্য হয়েই সেই সন্দীপ ঘোষের ন্যাশনালে নিয়োগ আদেশ বাতিল করতে হয় সরকারকে। আর জি করে অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষ পদত্যাগের পর তার জায়গায় বসানো হয় তারই ঘনিষ্ট সুহৃতা পালকে। কিন্তু চিকিৎসকরা তাকে মানতে রাজি নন। যাবতীয় তথ্য প্রমাণ লোপাটের ষড়যন্ত্রের শিরোমণি যে সন্দীপ ঘোষ তারই কাছের মানুষ এই সুহৃতা পাল। ফলে বিক্ষোভের জেরে হাসপাতালে আসাই বন্ধ করে দিয়েছেন।
ডাক্তারদের সুস্পষ্ট দাবি তথ্য প্রমাণ লোপাট এবং সন্দেহজনক কার্যকলাপে কোনও না কোনোভাবে যুক্ত হাসপাতালের শীর্ষকর্তাদের অপসারণ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত হালে পানি না পেয়ে সরকার সুহৃতা পাল সহ হাসপাতালের চার আধিকারিককে সরাতে বাধ্য হয়েছে জেদ ধরে বসে থাকা সরকার। এমনকি ১৪ আগস্ট রাতে হাসপাতালে তাণ্ডব ও ভাঙচুর চলার সময় কর্তব্যরত তিন পুলিশ অফিসারকেও সাসপেন্ড করতে হয়েছে। সেদিনের রাতের ঘটনা যে পূর্বপরিকল্পিত, তথ্য প্রমাণ লোপাটের জন্য গুন্ডাদের পাঠানো হয়েছিল এবং নির্বিঘ্নে ভাঙচুর করার জন্য পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়েছিল সেটা মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ায় তিন পুলিশ অফিসারকে সাসপেন্ড করে মুখ রক্ষা করা ছাড়া উপায় ছিল না।
মমতা ব্যানার্জির সরকার এখন উভয় সঙ্কটে। যদি তথ্য প্রমাণ লোপাট না করে সঠিক পথে সঠিক তদন্ত হয় তাহলে  ধর্ষক-খুনিরা তো উপযুক্ত সাজা পাবেই সেই সঙ্গে আর জি করে দুর্নীতির সীমাহীন তাণ্ডব জনসমক্ষে উন্মুক্ত হয়ে রকারকে উলঙ্গ করে দেবে। আবার তথ্য প্রমাণ লোপাট করে ন্যায় বিচারের রাস্তা বন্ধ করলে প্রতিবাদ-বিক্ষোভের রোষে পড়ে সরকার নাজেহাল হবে। এই অবস্থায় সরকার যে কার্যত দিশাহারা তা বোঝা যায় অপরাধীর ফাঁসির দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে শাসক দলের মিছিল করা থেকে। এটা নির্বোধেও বোঝে ফাঁসি বা তেমন সাজা দেবার দায় সরকারের। মুখ্যমন্ত্রী তাঁর নিজের সরকারের বিরুদ্ধেই পথে নেমেছেন। এর থেকে হাস্যকর রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা আর কি হতে পারে।
১৩ বছরের শাসনে এই সরকার ও শাসক দল অসংখ্য অপরাধ করেছে। এমন অপরাধ আছে যা ক্ষমার অযোগ্য। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রতিবাদ হয়েছে আবার থেমেও গেছে। কিন্তু মনের মধ্যে ক্রমাগত জমা ক্ষোভ কখনো উবে যায়নি। দীর্ঘদন ধরে জমা সেই ক্ষোভ বিস্ফোরণের মতো ফেটে বেরিয়েছে আর জি কর কাণ্ডে। এমন দলমত নির্বিশেষে সব অংশের মানুষের গণপ্রতিবাদ ১৩ বছরের আগে কখনও দেখা যায়নি। তাই শাসক ভীত, শঙ্কিত। রাজ্যজুড়ে গণজাগরণের পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতে সরকার বদলের বার্তা বয়ে আনছে।

Comments :0

Login to leave a comment