নীলাদ্রি সেন
চার বছর আগে দেশের রাজধানীর বুকে আছড়ে পড়া কৃষক আন্দোলনের চাপে তিন দানবীয় কৃষি আইন প্রত্যাহার করা হলেও কৃষকদের মূল দাবিগুলো অমীমাংসিতই রয়ে গিয়েছে। এইসব দাবি নিয়ে অতীতে বেশ কয়েকবার মোদী সরকারের সঙ্গে কৃষক সংগঠনগুলোর আলোচনা হলেও সেইসব দাবি আজও মেনে নেওয়া হয়নি। ফলে আমাদের দেশের কৃষক ও তাঁর পরিবারের জীবন জীবিকার সঙ্কট প্রতিদিন আরও তীব্র হয়ে উঠছে। সারা দেশে চার লক্ষাধিক কৃষক এই সঙ্কটের জেরে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। নরেন্দ্র মোদী দেশবাসীকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি এই কৃষক আত্মহত্যা বন্ধ করবেন। অথচ বাস্তবে শুধু মোদীজিদের শাসনকালেই কৃষক আত্মহত্যার হার ৪২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। শেষে কৃষকের আত্মহত্যা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে মোদীজিরা কৃষক আত্মহত্যার সরকারি পরিসংখ্যান প্রকাশ করাই ২০১৬ সাল থেকে বন্ধ রেখেছেন।
এই দেশের কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবি ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করা, যাতে কৃষকরা ঋণজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন। কৃষিবিজ্ঞানী এমএস স্বামীনাথন জাতীয় কৃষি কমিশনের সুপারিশ ছিল ফসলের ন্যায্য দাম অর্থাৎ কৃষির খরচের দেড়গুণ (সি ২ + ৫০% সূত্র) কৃষককে এমএসপি হিসাবে দেওয়া হোক। এই দামে কৃষকদের কাছ থেকে সরাসরি ফসল কিনে নেওয়া উচিত ভারত সরকারের। কেউ এর থেকে কম দামে ফসল কেনবার চেষ্টা করলে তার শাস্তির ব্যবস্থা করা হোক। এছাড়া ব্যাঙ্ক, সমবায় এবং সুদখোরদের কাছে কৃষকদের সমস্ত ঋণ এককালীন মকুব করা হোক। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি’র ইশ্তেহারে ও মোদীজি তাঁর একাধিক নির্বাচনী প্রচারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলে তাঁরা স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশগুলো কার্যকর করবেন। ক্ষমতায় ফেরবার মাত্র কয়েক মাস পর মোদীজির সরকার থেকেই নির্লজ্জভাবে সুপ্রিম কোর্টে হলফনামা দাখিল করে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয় যে, স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করা তাদের সরকারের পক্ষে অসম্ভব।
কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত ফসল মান্ডি, সরকার নিয়ন্ত্রিত বাজার, কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি (এপিএমসি) এবং বেসরকারি বাজারগুলোতে বিক্রি করেন। আমাদের দেশে ২৮ হাজারের বেশি নানা ধরনের মান্ডি আছে। এগুলোতে ফসল নির্দিষ্ট দামে তালিকাভুক্ত ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করা যায়। এর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারেরও কিছু কর আদায় হয়। মান্ডিগুলো কৃষি উৎপাদনকারীদের ফসলের দাম খুঁজে পেতে সাহায্য করে। ষাটের দশকের শেষ থেকে এই ব্যবস্থা চালু রয়েছে। তবে তা ত্রুটিপুর্ণ। কারণ মান্ডিগুলো গড়ে উঠেছে অসমভাবে। আর এই ব্যবস্থা রাজ্যগুলোর হাতে থাকায় এগুলোর কার্যকলাপ সংশ্লিষ্ট রাজ্যের কৃষি পরিস্থিতির ওপরে নির্ভরশীল। পাঁচ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে কৃষক মান্ডি গড়ে তোলা দরকার। এই ছিল স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশ। অথচ এখন সংখ্যাটা এই হিসাবে তুলনামুলকভাবে অনেক কম। ২৩টি রাজ্য ও ৪টি কেন্দ্রীয় শাসিত অঞ্চলে মাত্র ১৩৮৯টি মান্ডি আছে যেখানে সব ধরনের কৃষিজাত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ এবং কেনা বেচার জন্য ই-ন্যাম নামে একটি নির্দিষ্ট পোর্টাল ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মান্ডিগুলোতে বেশির ভাগটাই হলো অভাবি বিক্রি। ফসল ফড়েদের কাছে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয় কৃষকদের। বিজেপি সরকারের আমলেই তৈরি শান্তাকুমার কমিটির প্রতিবেদনে রয়েছে যে, দেশের মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক সহায়ক মূল্য পেয়ে থাকেন। এটা হয় মূলত এফসিআই, নাফেড বা কনফেডের মতো সংস্থা বা রাজ্য সরকার নিয়োজিত এজেন্সি, যেসব জায়গা থেকে ফসল কেনে। ভারত সরকার বছর বছর ২৩টি কৃষি ফসলের জন্য নিয়ম রক্ষার মতো সামান্য কিছু সহায়ক মূল্য ঘোষণা করলেও বাস্তবে আমাদের দেশে ৯৪ শতাংশ কৃষককেই সহায়ক মূল্য থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।
কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি সংক্ষেপে এপিএমসি’র আইন অনুসারে কেন্দ্রকে প্রতি বছর কিছু নির্দিষ্ট ফসলের জন্য সহায়ক মূল্য ঘোষণা করতে হয়। অবশ্য সেই দাম বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কৃষির খরচের তুলনাতে অনেকটা কম হয়। আর প্রকৃতপক্ষে মাত্র ১০ শতাংশেরও কম কৃষক সহায়ক মুল্য পেয়ে থাকেন। একথা ঠিক যে বর্তমানে চালু থাকা এপিএমসি’র মধ্যে অনেক গলদ রয়েছে। কৃষকদের অধিকার আরও বাড়ানো দরকার। পরিচালনার ত্রুটি দুর করে এগুলোর গণতান্ত্রিক সংস্কার করা জরুরি। তবুও এই ব্যবস্থা দেশে যেটুকু রয়েছে সামগ্রিক না হলেও আংশিকভাবে কৃষকদের স্বার্থে টিকে থাকা জরুরি। এপিএমসি’র অনুপস্থিতি যে কৃষকের পক্ষে ক্ষতিকর তার অনেক উদাহরণ রয়েছে আমাদের দেশে। ২০০৬ থেকে বিহারে এপিএমসি আইন নেই। এখানে কৃষকদের দেশের মধ্যে নিম্নতম দামে ফসল বিক্রি করতে হয়। ২০১৫ সাল থেকে মহারাষ্ট্রের ফড়নবিশ সরকার এপিএমসি’র পরিধি রাজ্যে মাত্র কয়েক হাজার বর্গ কিলোমিটারের মধ্যে সীমাবদ্ধ করে দেয়। বাকি বেশির ভাগটা খুলে রাখা হয় কর্পোরেটদের জন্য।
কেন্দ্রে অতীতে বিজেপি’র নেতৃত্বে এনডিএ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকারের পক্ষ থেকে এপিএমসি আইনের সংস্কার করে একটি খসড়া মডেল রাজ্যগুলোর কাছে পাঠানো হয়েছিল। অধিকাংশ রাজ্য তা কার্যকর করতে অস্বীকার করে। এমনকি দেখা যায় বিজেপি পরিচালিত অনেক রাজ্যেও তা মানা হয়নি। অর্থাৎ বিজেপি বা অবিজেপি সব রাজ্য সরকারই চলতি এপিএমসি আইনের পক্ষে। এরপর ২০১৭ সালে মোদী সরকারের পক্ষ থেকে রাজ্যগুলোর কাছে আবার একটি খসড়া মডেল পাঠানো হয়। এখানে নতুন করে ই-কমার্স ও অনলাইন ট্রেডিং এর বিষয়টিকে যুক্ত করে দেওয়া হয়। এখানে উল্লেখ্য, ২০০৩ সালে বাজপেয়ী সরকারের তৈরি করা খসড়া মডেল মেনে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমুল কংগ্রেস সরকারের পক্ষ থেকে ২০১৪ সালে বিধানসভাতে আইন পাশ করানো হয়। ২০১৭ সালে পুনরায় রাজ্যগুলোর কাছে মোদী সরকার খসড়া মডেল পাঠালে এই বছরেই পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্রের পরামর্শ মেনে কৃষিতে ই-কমার্স ও অনলাইন ব্যবস্থা চালু করে দেওয়া হয়।
সম্প্রতি মোদী মন্ত্রীসভাতে ডিজিটাল এগ্রিকালচার মিশন অভিমুখী প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকার ৭টি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে। আমাদের জনসংখ্যার ৫৩ শতাংশ কৃষিতে যুক্ত কিন্তু এর মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি পরিবারই ক্ষুদ্র, প্রান্তিক, ভূমিহীন এবং ঠিকা কৃষক। বড় বড় কর্পোরেট গোষ্ঠী পরিচালিত ডিজিটাল ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হওয়া মাত্র কর্পোরেট হাঙররাই হয়ে উঠবে কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক শক্তি। ডিজিটাল ব্যবস্থায় সারের ভরতুকি বেপরোয়াভাবে ছাঁটাই করা হবে। কৃষিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দিয়ে চুক্তি চাষের এটা প্রাথমিক ধাপ বলা যেতে পারে। বহুজাতিক আধিপত্যে তাদেরই বিপণন ছক অনুযায়ী ফসল চক্রকেও বদলে দেওয়া হবে। ডিজিটাল মিশনে চলতি বছরেই ৬ কোটি কৃষকের কৃষিজমি ও ফসলের সব তথ্য ডিজিটাল নথিতে পরিণত করবার কথা। আগামী কয়েক বছরের লক্ষ্য হলো আরও ৯.৩ কোটি কৃষককে এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা।
ডিজিটাল ব্যবস্থা ক্রমে হয়ে উঠবে সাধারণ কৃষকের মৃত্যু পরোয়ানা। সারা ভারত কৃষকসভার পক্ষ থেকে মোদীজিদের এই কৃষক বিরোধী ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করবার পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির দাবি মেনে এবং বিশ্বব্যাঙ্কের সুপারিশেই ভারতীয় কৃষিতে ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু করতে চাইছে মোদী সরকার। ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অব এগ্রিকালচারাল রিসার্চের (আইসিএআর) সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে এদেশে বায়ার, সিনজেন্টা, আমাজনের মতো বহুজাতিক কর্পোরেশনগুলোর ঢালাও অনুপ্রবেশের পরিপ্রেক্ষিতেই দেখতে হবে মোদী সরকারের এই পদক্ষেপকে। এই পরিকল্পনা মতোই অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ২০২৪-২৫ অর্থাৎ চলতি অর্থবর্ষের বাজেট ভাষণে বেসরকারি গবেষণায় সরকারি অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব রেখেছেন। আসলে এর আগে কর্পোরেটমুখী জমি অধিগ্রহণ অর্ডিন্যান্স এবং তিনটি কৃষক হত্যার কৃষি বিল কৃষক আন্দোলনের সাহসী প্রতিরোধের মুখে প্রত্যাহারে বাধ্য হয়েছিল সরকার। এবার মোদী সরকারের পক্ষ থেকে কর্পোরেট স্বার্থে নিজেদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কৌশল হিসাবে এইসব প্রসাধনী প্রকল্প ঘোষণা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে এফসিআই কয়েকটি রাজ্যে ফসল কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। মোদী সরকার চাইছে যেকোনও উপায়ে ভারতের কৃষি বাজারকে দেশি বিদেশি বৃহৎ কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে। মনস্যান্টো, পেপসি, বেয়ার, ওয়ালমার্ট, কর্গিল, ম্যারিকো, নেসলে, রালিস, রিলায়েন্স ফ্রেস, আদানি উইলমার, আদানি লজিস্টিক ইত্যাদি অসংখ্য কর্পোরেট ইতিমধ্যেই আমাদের দেশের কৃষিজাত পণ্যের বাজার দখলের জন্য দাপিয়ে বেড়াতে ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠছে। এদের রুখে দিতে না পারলে ভারতের কৃষি পণ্যের বিপণন ব্যবস্থাতে এদের এজেন্টরাই ভবিষ্যতে নতুন ফড়ে হয়ে উঠে ফসলের দরদাম ঠিক করবার অসম প্রক্রিয়াতে নির্ণায়ক শক্তি হয়ে উঠতে পারে।
সারা ভারত কৃষকসভা, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়ন সহ বামপন্থী কৃষক সংগঠনসমূহ এবং কৃষক সংগ্রামের বৃহত্তর ঐক্যে গড়ে ওঠা ২০০টি কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনগুলোর যৌথ মঞ্চ সংযুক্ত কিষান মোর্চা তাই এমএসপি’র আইনি স্বীকৃতি সহ কৃষকদের বকেয়া দাবিগুলোকে সামনে রেখে দেশের সঙ্কটে থাকা কৃষক সমাজের কাছে আবার নতুন করে লড়াইয়ের ডাক দিয়েছে। মোদী সরকারকে তিন মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়ে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশমতো এমএসপি আইন পাশ করবার দাবি জানানো হয়েছে। অন্যান্য বকেয়া দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সব ফসলের সরকারি সংগ্রহ নিশ্চিত করা, ঋণজাল থেকে মুক্তি দিতে ও কৃষক আত্মহত্যার মিছিল বন্ধ করতে কৃষি ঋণ মকুব করা, বিদ্যুৎ বেসরকারিকরণ ও প্রিপেড স্মার্ট মিটার চালু করবার পদক্ষেপ বাতিল, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উদ্যোগে সুসংহত কৃষি বিমা, মাসিক ন্যূনতম ১০ হাজার টাকা অবসর ভাতা এবং কর্পোরেটদের কৃষি জমি দখল বন্ধ করা। এসবই মোদী সরকারকে তিনমাস সময়সীমার মধ্যে মেনে নিয়ে কার্যকর করবার দাবি জানানো হয়েছে। এইসঙ্গে সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, কৃষি ও কৃষকের স্বার্থে এই দাবিগুলো না মানলে সংযুক্ত কিষান মোর্চা ফের দেশব্যাপী জোরালো আন্দোলনে নামবে।
Comments :0