গার্গী চ্যাটার্জি
ভারতের শ্রমিকশ্রেণি আজ এক গভীর সঙ্কটের সম্মুখীন। বিজেপি সরকারের নেতৃত্বে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার একের পর এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছে, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সংকুচিত করছে এবং দেশের অর্থনীতিকে আরও বেশি অতি ধনী পুঁজিপতিদের স্বার্থে পরিচালিত করছে। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমান ২৯টি শ্রম আইনকে বাতিল করে চারটি নতুন শ্রমকোড চালু করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যা কার্যকর হচ্ছে আজ, ১ এপ্রিল। এই শ্রমকোড বাস্তবায়িত হলে শ্রমিকশ্রেণির জীবন-জীবিকা বিপন্ন হবে।
অন্যদিকে, শ্রমিক আন্দোলন তার সর্বশক্তি দিয়ে এই কালা কোড প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শ্রমিকরা ১ এপ্রিল দেশজুড়ে কারখানা চত্বর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এই শ্রমকোডের প্রতিলিপি পুড়িয়ে সরকারকে বার্তা দেবে— অবিলম্বে এই শ্রম বিরোধী নীতিকে প্রত্যাহার করতে হবে। এই আন্দোলনেরই অংশ হিসেবে আগামী ২০ এপ্রিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। এই কোড প্রত্যাহার না করলে, শ্রমিকশ্রেণি বাধ্য হবে দেশজুড়ে সমস্ত উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্র বন্ধ করে দিতে।
সুদীর্ঘকাল ব্যাপী শ্রমিক আন্দোলনের চাপে আরএসএস’র নির্দেশে পরিচালিত বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার শ্রমকোড আইনে পরিণত করার পরেও দেশে কার্যকর করতে পারেনি। যদিও শ্রমিকদের দাবি মেনে তা প্রত্যাহারও করেনি। শ্রমিক আন্দোলনের দাবি মেনে না নেওয়ায় আগামী ২০ মে সিআইটিইউ সহ ১০টি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের আহ্বানে এক ঐতিহাসিক সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল হবে। এই ধর্মঘটের মাধ্যমে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া হবে, শ্রমিকশ্রেণির অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে লাগাতার দেশব্যাপী প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে।
শ্রমকোড, পুঁজিবাদের নয়া আগ্রাসন
নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার দাবি করছে, এই নতুন শ্রমকোড শ্রমিকদের জন্য সুবিধাজনক হবে এবং এতে নতুন বিনিয়োগ আসবে। কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে, শ্রমিক যে ন্যূনতম আইনি অধিকারগুলো অর্জন করেছিল সুদীর্ঘ লড়াইয়ের মাধ্যমে, সেগুলি নিষ্পেষিত হবে এই শ্রমকোড কার্যকর হলে।
শ্রমকোডের প্রভাব
মজুরি ও বোনাস: শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ও বোনাস প্রদানের বাধ্যবাধকতা ছিল এতদিন। একে নতুন কোডে মালিকদের ইচ্ছাধীন করা হয়েছে, ফলে ন্যায্য মজুরি পাওয়া কঠিন হবে।
ধর্মঘটের অধিকার: পূর্ববর্তী আইনে শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার ছিল। এখন ধর্মঘটের আগে ৬০ দিনের নোটিস বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যা কার্যত ধর্মঘটের অধিকার খর্ব করবে।
ছাঁটাই ও চাকরি সুরক্ষা: ১০০ জনের বেশি কর্মী থাকলে ছাঁটাইয়ের আগে সরকারের অনুমতি লাগত। নতুন ব্যবস্থায় এই সংখ্যা বাড়িয়ে ৩০০ জন করা হয়েছে। অর্থাৎ দেশের বেশিরভাগ কারখানাতেই কর্মী ছাঁটাইয়ে আর কোনও সরকারি অনুমতি লাগবে না, যার ফলে বিশাল সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাইয়ের ঝুঁকিতে পড়বেন।
সামাজিক সুরক্ষা: পেনশন, ইএসআই ও গ্র্যাচুইটি বাধ্যতামূলক ছিল এতদিন। মালিকদের হাতে এখন এটা নির্ধারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ফলে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা ঝুঁকির মুখে পড়বে।
কাজের সময় ও নিরাপত্তা: ৮ঘণ্টা কাজের সময় ও কাজের নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল পুরানো আইনে। এখন ১২ঘণ্টা কাজের পথ খোলা হয়েছে, যা শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
শ্রমিকের সংজ্ঞা: পুরানো শ্রম আইনে শ্রমিক বলতে কারখানা, খনি, পরিবহণ, নির্মাণ, পরিষেবা, কৃষি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে কাজ করা সকল কর্মীকেই স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। নতুন শ্রমকোডে শ্রমিকের সংজ্ঞাকে সীমিত করা হয়েছে। যদি কোনও কর্মচারীর মাসিক মজুরি ১৮,০০০ টাকার বেশি হয়, তবে তাকে ‘শ্রমিক’ (Worker) হিসেবে গণ্য না করে, তাকে ‘সুপারভাইজার’ হিসাবে চিহ্নিত করা হতে পারে। এর ফলে তারা শ্রম আইনের সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হবেন।
অর্থাৎ, চাকরির নিরাপত্তা কমে যাবে এবং নিয়োগ ও ছাঁটাই প্রক্রিয়া আরও শিথিল হবে, স্থায়ী চাকরির সংখ্যা হ্রাস পেয়ে চুক্তিভিত্তিক ও অস্থায়ী শ্রমিক বাড়বে, যা শ্রমিকদের চরম আর্থিক অনিশ্চয়তায় ঠেলে দেবে। ন্যূনতম মজুরির নিশ্চয়তা থাকবে না, ইপিএফ ও পেনশনে সঙ্কট নেমে আসবে, কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি পাবে, নতুন শ্রমকোড অনুযায়ী দৈনিক কাজের সময় ১২ঘণ্টা পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে, ফলে বাধ্যতামূলক ওভারটাইমের নামে শোষণ বাড়বে। শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে গুরুত্ব না দেওয়ায় শিল্প দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণে বাড়বে। শ্রম আইন শিথিল হওয়ায় শিশুশ্রমের হার বাড়তে পারে এবং নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রের সুরক্ষা দুর্বল হবে। সর্বোপরি শ্রমিকদের সংগঠিত আন্দোলন দমন করতে ইউনিয়নের অধিকার খর্ব করা হবে, ধর্মঘট বা আন্দোলন সংগঠিত করার ক্ষেত্রে আরও কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, যা শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করছে।
শুধুমাত্র তাই নয়, শ্রমকোডের ছত্রে ছত্রে মালিকপক্ষের স্বার্থে সমস্তরকম মজুরি, বোনাস, পিএফ-ইএসআই, নির্দিষ্ট শ্রমঘণ্টা সংক্রান্ত বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হয়েছে। আগের শ্রম আইনে এগুলো বাধ্যতামূলক থাকার ফলে কর্মস্থলে এই আইনসমূহ খানিকটা হলেও শ্রমিকদের সুরক্ষা প্রদান করত। তাকে কার্যত দুর্বল করা হয়েছে এবং বেশ কিছু ক্ষেত্রে তুলে দেওয়া হয়েছে। এই শ্রম কোড কার্যকর হলে মূলত কর্পোরেটদের আরও মুনাফা নিশ্চিত হবে, শ্রমিকদের কোনও অধিকার থাকবে না। বিজেপি সরকার এই শ্রমকোড চাপিয়ে দিয়ে দেশের মেহনতি মানুষের জীবনকে আরও শোষণ, বঞ্চনা ও অনিশ্চিয়তার দিকে ঠেলে দেবে।
রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি, কর্পোরেট রাজ
শুধু শ্রমকোডই নয়, বিজেপি সরকার একের পর এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিচ্ছে। মোদী সরকার মনিটাইজেশন পাইপলাইন প্রকল্পের নামে— রেলওয়ে বেসরকারিকরণ করছে, যেখানে আদানি-আম্বানিরা লাভবান হচ্ছে। বিমান পরিবহণ ক্ষেত্রে এয়ার ইন্ডিয়া বিক্রি করা হয়েছে টাটা গোষ্ঠীর কাছে। বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বেসরকারি হাতে। বিদ্যুৎ ও কয়লা খনি ক্ষেত্র বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক এবং বীমা সংস্থাগুলো কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এই নীতি দেশের সাধারণ মানুষের সম্পদ লুটের নামান্তর। বিজেপি সরকারের কর্পোরেট বন্ধুরা যাতে আরও বেশি মুনাফা করতে পারে তার জন্যই একের পর এক রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রি করা হচ্ছে।
এমনিতেই চূড়ান্ত অবহেলিত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ আরও অন্ধকার হয়ে যাবে। ভারতে ৯৩ শতাংশের বেশি শ্রমিক অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে, কিন্তু তাঁদের জন্য কোনও সামাজিক সুরক্ষা নেই। এই নতুন শ্রমকোড তাঁদের অধিকারের আরও ক্ষতি করবে। প্রথমত, ন্যূনতম মজুরি নেই। সরকার ন্যূনতম মজুরি বিধি কার্যকর করেনি, ফলে অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা আরও বেশি শোষিত হবেন। দ্বিতীয়ত, এদের জন্য স্বাস্থ্য পরিষেবার সুরক্ষা নেই। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য দেশে কোনও কার্যকর স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যবস্থা নেই। তৃতীয়ত, পেনশনের নিশ্চয়তা নেই। ফলে অসংগঠিত শ্রমিকদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত নয়, কারণ দেশের সরকার এদের জন্য অবসরকালীন পেনশনের ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত করেনি। চতুর্থত, মহিলা শ্রমিকরা অবহেলিত হবেন। মাতৃত্বকালীন সুবিধা কমানো হয়েছে এবং নারী শ্রমিকদের সুরক্ষার কোনও উল্লেখই এই কোডে নেই।
প্রতিরোধের প্রস্তুতি
শ্রমিকশ্রেণি জানে যে, একমাত্র সংগঠিত প্রতিরোধের মাধ্যমেই এই শ্রমকোড প্রতিহত করা সম্ভব এবং সেকারণেই তারা শ্রমকোডের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধের প্রস্তুতি গড়ে তুলছে। তাই প্রথম ধাপে আজ, ১ এপ্রিল শ্রমিকরা কারখানা চত্বর ছেড়ে রাস্তায় নেমে এই কালা শ্রমকোডের কপি পুড়িয়ে প্রতিবাদ জানাবে। আগামী ২০ এপ্রিল ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক ঐতিহাসিক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে চলেছে শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুর ও বস্তিবাসী সংগঠনের আহ্বানে। এই সমাবেশে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ জনগণ অংশ নেবেন। এই সমাবেশের মাধ্যমে শ্রমিক কৃষক খেতমজুর বস্তিবাসীরা যৌথভাবে সরকারের কর্পোরেট স্বার্থরক্ষাকারী নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে।
ব্রিগেডের এই মহাসমাবেশই হবে ২০ মে দেশজুড়ে সাধারণ ধর্মঘট ও হরতালের প্রস্তুতির এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। শ্রমিকদের দাবি স্পষ্ট— অবিলম্বে কালা শ্রমকোড প্রত্যাহার করতে হবে, অভিন্ন ন্যূনতম মজুরি চালু করতে হবে, শ্রমিকদের পেনশন সহ সামাজিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, সরকারি সম্পদের বেসরকারিকরণ বন্ধ করতে হবে এবং কর্পোরেট স্বার্থরক্ষাকারী নীতি পরিবর্তন করতে হবে। এই ধর্মঘট শুধু শ্রমকোডের বিরুদ্ধে নয়, বরং সমস্ত শ্রমিক বিরোধী ও জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে এক সর্বাত্মক প্রতিবাদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে।
যদি সরকার এই দাবি না মানে, তাহলে লাগাতার ধর্মঘট ও দেশব্যাপী প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এই ধর্মঘটের মাধ্যমে সরকারকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হবে, শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী নীতি বাতিল করতেই হবে, নয়তো দেশব্যাপী আন্দোলন আরও তীব্র হবে। প্রয়োজনে দেশজুড়ে লাগাতার ধর্মঘটের মাধ্যমে অর্থনীতিকে স্তব্ধ করে দেওয়া হবে।
কর্পোরেট শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান
এই শ্রমকোড কার্যকর হলে শ্রমিকশ্রেণির অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। এটি শ্রমিকদের রক্তচোষা আগ্রাসী লুটেরা লগ্নিপুঁজির নীতির প্রতিফলন। শ্রমিকশ্রেণিকে এখনই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, সংগঠিত হতে হবে এবং সর্বাত্মক লড়াই গড়ে তুলতে হবে।
শ্রমিক আন্দোলন কেবলমাত্র শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা করার লড়াই নয়, এটি দেশের গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইও বটে। তাই, বিজেপি সরকারের এই কর্পোরেট অনুগত নীতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া আর কোনও পথ নেই। এখন সময় এসেছে শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের, সময় এসেছে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার।
এই লড়াই শুধু শ্রমিকদের নয়, সমস্ত নিপীড়িত মানুষের। যখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে, বেকারত্ব সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে, সামাজিক সুরক্ষার কোনও গ্যারান্টি নেই, তখন এই আন্দোলন জনসাধারণের বৃহত্তর আন্দোলনের সাথে একীভূত হওয়া সময়ের দাবি। শ্রমিকশ্রেণির এই লড়াই আগামী দিনে দেশকে এক নতুন দিশা দেখাবে।
এই কালা শ্রমকোডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে এবং শ্রমিকশ্রেণির হকের দাবি আদায়ের লক্ষ্যে এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের ডাক এসেছে। শ্রমজীবী মানুষ যদি এখনই সঙ্ঘবদ্ধ না হয়, তাহলে কর্পোরেট রাষ্ট্রের আগ্রাসন আমাদের সব অধিকারগুলোই সম্পূর্ণভাবে কেড়ে নেবে। তাই আসুন, আগামী লড়াইকে ঐতিহাসিক করে তুলি— শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যই আমাদের মুক্তির পথ।
কালা শ্রমকোড বাতিল করতেই হবে! কর্পোরেট শাসন হটাতেই হবে!
Comments :0