Hate Speech

ঘৃণা ভাষণ, সংখ্যালঘুদের দানব সাজানোর জোরালো প্রয়াস

উত্তর সম্পাদকীয়​

রাম পুনিয়ানী

আরএসএস-বিজেপি এবং তাদের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন সংগঠন প্রতিটি ঘটনায় সংখ্যালঘুদের দানব সাজানোর কাজে ব্যবহার করে। যদিও ঘৃণা ছড়ানোর ভাষণ দেওয়া অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধানও আছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দোষীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। গত এক দশক ধরে একটি সাম্প্রদায়িক দল ক্ষমতায় থাকার কারণে ঘৃণার প্রচার চলছে জোরকদমে। এর ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব জোরালো হয়ে উঠছে। 
হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ গুলিতে যে ধরনের আলোচনা হয় এবং সাধারণভাবেই এমন মানসিকতা তৈরি হয়ে যাচ্ছে, যাতে সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করা একটা স্বাভাবিক বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এর মূলে রয়েছে ঘৃণা ছড়ানোর সেই ব্যবস্থা, যার ফলে নেতিবাচক সামাজিক ধারণা বিকশিত হয়। বন্ধুত্ব এবং সামাজিক সদ্ভাবের অবধারণা যা ভারতীয় সংবিধানের তিনটি মৌলিক ভিত্তির একটি— তা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে। 
নতুন নতুন বিষয় রোজ উত্থাপন করা হচ্ছে। আসলে এখন আর বিষয়টি শুধু উত্থাপনের মধ্যে সীমিত নেই। এখন তো সরাসরি ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলা হচ্ছে। যে সব কথা বলা হচ্ছে, তা ভুল ধারণার উপরে নির্মিত এবং সামাজিক বিভাজনকে আরও গভীর করছে। ‘‘আমরা দুই, ওরা পাঁচ, ওদের পঁচিশ’’, ‘‘ত্রাণ শিবির বাচ্চা উৎপাদনের কারখানা’’- মুঘল বাদশাহরা বহিরাগত ছিল, তারা হিন্দুদের সঙ্গে অন্যায় করেছিল। মন্দির ভেঙেছিল এবং তরোয়ালের জোরে ইসলামের প্রসার ঘটিয়ছিল। এই ধরনের স্লোগান এবং বক্তব্যের মাধ্যমে ঘৃণার ধারণা তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে। 
এখন এটাও বলা হচ্ছে যে, মুসলমানদের পোশাক দেখেই বোঝা যায় যে, তারা আমাদের গোমাতার হত্যাকারী এবং তারা লাভ জিহাদের মাধ্যমে আমাদের মেয়ে ও মহিলাদের নিজেদের জালে ফাঁসাচ্ছে। এখন তো সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে জিহাদের পুরো সিরিজ তৈরি করে ফেলা হয়েছে, যেখানে ল্যান্ড জিহাদ থেকে ভোট জিহাদ পর্যন্ত সব আছে। 
গত লোকসভা ভোটের প্রচারের সময়ে মোদী ঘৃণা ছড়ানোর ভাষণ দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও কসুর রাখেননি। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের হিসাব অনুযায়ী, ভোট প্রচারে মোদী ১১০টি ঘৃণা ভাষণ দিয়েছেন। রিপোর্ট অনুযায়ী ভাষণে মোদী ইসলামোফোবিক অর্থাৎ ইসলামের প্রতি ভীতি তৈরি করার মতো বক্তব্য রেখেছেন। এর একটি উদ্দেশ্য ছিল তাঁর রাজনৈতিক বিরোধীদের হামলা করা, মোদীর মতে বিরোধীরা মুসিলমদের অধিকারকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়। দ্বিতীয় উদ্দেশ্যটিই আসল, তা হলো মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে সংখ্যাগুরু হিন্দুদের মনে মুসলমানদের সম্পর্কে ভয় ধরানো। নির্বাচনের ভাষণগুলিতে মোদী মুঘল, মাটন, মুজরো, মঙ্গলসূত্র, মোষ, মন্দির কোনও কিছুই বাদ রাখেননি। বস্তুত, মুসলিমদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে এই সমস্ত কিছুর ব্যবহার করা যায়, তা ধারণার অতীত ছিল। 
মোদীর ভাষণের আরও একটি নমুনায় একইরকম ভীতি সঞ্চারকারী। কংগ্রেস মুসলিমদের তুষ্টিকরণের জন্য সংরক্ষণ দিতে চাইছে বলে প্রচার করে মোদীর দাবি, এটা ভারতের ইসলামীকরণ এবং দেশকে টুকরো টুকরো করার চেষ্টা। এটা তফসিলি জাতি, আদিবাসী এবং ওবিসিদের থেকে কংগ্রেসের সংরক্ষণ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা। যদিও এমন কোনও দাবি বা প্রতিশ্রুতি কংগ্রেসের পক্ষ থেকে করা হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী মোদী সহ বিজেপি নেতারা এই নিয়ে মিথ্যা প্রচার করেই চলেছেন। তারা বলছেন, যখন ইউপিএ সরকার ছিল তখন নাকি কংগ্রেস এমন চেষ্টা করেছে। বিচারপতি বর্মা কমিটি অথবা সাচার কমিটির রিপোর্টের মাধ্যমে তফসিলি জাতি, আদিবাসী এবং অন্যান্য অনগ্রসর অংশ বা ওবিসিদের সংরক্ষণ কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল। মোদী-শাহরা ভোট প্রচারে বলেছেন, ওই সময়ের অন্ধ্র প্রদেশের কংগ্রেস সরকার এবং বর্তমানের কর্নাটক সরকার এইভাবেই সংরক্ষণ কেড়ে নিয়ে মুসলিমদের দেওয়ার চেষ্টা করেছে, করছে। 
সম্প্রতি ঝাড়খণ্ড এবং মহারাষ্ট্রের বিধানসভা ভোটে ঘৃণা ছড়ানো ভাষণ সব সীমাই অতিক্রম করে গেছে। বিজেপি’র হিমন্তবিশ্ব শর্মার প্রচারের মুখ্য বিষয় ছিল তথাকথিত মুসলিম অনুপ্রবেশকারী। বিজেপি একটি অতি ঘৃণিত বিজ্ঞাপন দিয়ে দেখিয়েছিল, একটি বড় মুসলিম পরিবার একটি হিন্দু পরিবারের উপরে আক্রমণ করে দখল নিচ্ছে। আমরা সকলেই জানি, ঝাড়খণ্ডের সঙ্গে কোনও আন্তর্জাতিক সীমানা নেই। তাহলে এই মুসলমানরা কারা, যারা নাকি হিন্দুদের ঘরের দখল নিচ্ছে? নির্বাচন কমিশন এবারে ওই বিজ্ঞাপন সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। কিন্তু ওই ভিডিও তার উৎস ছাড়াও অন্যত্র থাকতে পারে। আরেকটি জঘন্য প্রচার ছিল, মুসলমান আদিবাসী মেয়েদের বিয়ে করে আদিবাসীদের জমির দখল নিচ্ছে। এই অভিযোগ প্রমাণ করার মতো কোনও তথ্য পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু তাতে কী আসে যায়! মানুষকে বিভাজিত করার চেষ্টা তো পূরণ হচ্ছিল। স্লোগান দেওয়া হয়েছে, মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরা আদিবাসীদের থেকে তাদের রুটি, বেটি, মাটি কেড়ে নিচ্ছে। এই বক্তব্য ছিল আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীর! 
এই নির্বাচনের প্রধান স্লোগান যোগী আদিত্যনাথ উপহার দিয়েছিলেন বিজেপিকে-‘বাঁটেঙ্গে তো কাটেঙ্গে’। অর্থাৎ হিন্দুদের এক থাকতে হবে। যোগীর বক্তব্য সমর্থন করে আরএসএস নেতা দত্তাত্রেয় হোসবালে বলেন, হিন্দু এক থাকলে সবার জন্য ভালো হবে। হিন্দু একতা স্থাপন করার জন্য সঙ্ঘ শপথ নিয়েছে। আদিত্যনাথের ‘বাঁটেঙ্গে কাটেঙ্গে’ স্লোগানকে খানিকটা সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রী মোদী ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’ স্লোগান দেন। মোদীর বক্তব্যের সার কথা ছিল, হিন্দুদের যদি মুসলমানদের থেকে সুরক্ষিত থাকতে হয়, তাহলে এক হতে হবে। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ল্যান্ড জিহাদ এবং ভোট জিহাদের কথা বলেছেন। বিজেপি কথিত ‘ভোট জিহাদ’র অর্থ হলো— মুসলিমরা এক জোট হয়ে বিরোধীদের ভোট দিচ্ছে। আর হিন্দুরা একজোট হয়ে বিজেপি-কে ভোট না দেওয়ায় নানা দলে ভোট ভাগ হয়ে যাওয়ায় বিরোধীদের সুবিধে হচ্ছে। মুসলমানদের সুবিধে হচ্ছে। অন্য স্লোগানের পাশাপাশি একথাও বলেছেন, রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রায় আরবান নকশাল এবং অতি-বামপন্থীরাও ছিলেন। এই সমস্ত কিছুর পরিণতি কী হয়েছে, তা ভোটের ফলে স্পষ্ট। সামাজিক ভাবনার বদলও সবাই দেখতে পারছেন। হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলি আর হিন্দু ঘরের ড্রইং রুমের আলোচনাও এখন এই অনুসারিই। 
হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থান এবং প্রসার নিয়ে দীর্ঘ সময় গভীর এবং বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়ন করেছেন ক্রিস্টোফ জেফরেলট। তিনি মার্চ-এপ্রিল ২০২৪-এ সিএসডিএস’র করা সমীক্ষার উদ্ধৃত করেছেন। এই সমীক্ষায় হিন্দুদের মুসলিমদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। সমীক্ষায় দেখা গেছে অধিকাংশ হিন্দু মনে করেন মুসলিমরা ততটা বিশ্বাসযোগ্য নন, যতটা অন্যরা। মুসলিমদের তুষ্টিকরণ চলছে ইত্যাদি। এই সমীক্ষা স্পষ্ট করে দেয় আমাদের সমাজ মুসলিমদের সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে চলে। গভীর সমীক্ষা হয়তো আমাদের সামনে এটা তুলে ধরতে সক্ষম হবে গত কয়েক দশকে এই ঘৃণার মনোভাব আরও গভীর আরও গুরুতর কেন হয়েছে। 
সবথেকে মজার বিষয় হলো, মোদী দাবি করেন তিনি সাম্প্রদায়িক ভাষণ দেন না। নির্বাচনী প্রচারে মুসলিম বিদ্বেষী বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী মোদী সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘‘যে দিন আমি (রাজনীতিতে) হিন্দু-মুসলিম নিয়ে কথা বলতে শুরু করবো, সেই দিনই সার্বজনিক জীবনের জন্য অযোগ্য হয়ে যাব। আমি কখনও হিন্দু-মুসলিম করবো না। এটা আমার সংকল্প।’’ এক জন ব্যক্তির বলা আর করার মধ্যে এত তফাৎ হতে পারে!
হিন্দুদের মধ্যে ব্যাপ্ত ভুল ধারণার জন্যই দেশের বাতাসে বিষ মিশছে। এর ফলে মুসলিমরা নিজেদের মহল্লার মধ্যে আরও কুঁকড়ে যাচ্ছে, সঙ্কুচিত হয়ে যাচ্ছে এবং ক্রমশ ‘দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক’-এ পরিণত হওয়ার নিকটবর্তী হয়ে উঠছে। 
এই বিভাজনকে কীভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব? আমাদের একটি বিকল্প ভাষ্য মানুষের কাছে নিয়ে যেতে হবে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও তার অমূল্য প্রাপ্তি আমাদের মানুষের সামনে হাজির করতে হবে। আমাদের সমন্বয়ী এবং বহুত্ববাদী সংস্কৃতির সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করতে হবে। সমস্ত ধর্মের মানুষই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছেন এবং সেই লড়াইয়ের ফল আমাদের সংবিধান। এই দেশকে রক্ষা করার জন্য সংবিধানকে রক্ষা করতে হবে। তার মূল ভাবনাকে রক্ষা করতে হবে, আরও প্রসারিত করতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment