ঈশিতা মুখার্জি
গত ২০ নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউ ইয়র্কের পূর্ব জেলায় মার্কিন অ্যাটর্নির অফিসে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ গৃহীত হয়। গৌতম আদানি এ দেশের সরকারের পিছনের স্তম্ভ কারণ সমস্ত সরকারি সম্পত্তি একটি একটি করে তার হাতে তুলে দিয়েছে মোদী সরকার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গৃহীত অভিযোগ মারাত্মক, অতীতে এর কোনও উদাহরণ আমাদের দেশে পাওয়া যায় না। অভিযোগটি হলো ভারত সরকারের বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্তৃপক্ষকে ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি ঘুষ দিয়েছে আদানি এবং তার সহকারীরা সৌর শক্তিতে মার্কিন বিনিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য। এর আগে ভারতের কোনও শিল্পপতির বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে কোনও অভিযোগ দায়ের হয়নি আর্থিক দুর্নীতির জন্য। এরকম অভিযোগ এই প্রথম হলো, যেখানে দেশের সরকারি কর্মকর্তারাও এই ঘুষ নিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। তবে যা জানা গেল এ হলো শুধু হিমশৈলের চূড়া। এখানে কিছু মার্কিন কোম্পানির বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে আদানি শিল্পগোষ্ঠী। আদানির সাথে প্রধানমন্ত্রী মোদীর যোগ স্পষ্ট কারণ আদানি সেই কোটিপতি কর্পোরেট শক্তি যারা মোদীকে ক্ষমতায় রাখার সমস্ত আর্থিক দায়দায়িত্ব বহন করে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিযুক্ত হলেও কোনোদিন দেশের মাটিতে আদানিকে স্পর্শ করা যাবে না, এমনই ইঙ্গিত বারবার দিয়েছে মোদী সরকার। এমনকি এত বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি নিয়ে সংসদ উত্তাল হলেও সেখানে আলোচনাও করতে দিল না এই সরকার।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কেন অভিযুক্ত হয়েছে এই শিল্পগোষ্ঠী? আমাদের দেশের মানুষের সাথে এই অভিযোগের সম্পর্ক কি এবং কতটা? এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই দেশের মানুষের জানবার অধিকার আছে। ঠিক কি ঘটেছিল আমাদের দেশে? ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাস এবং ২০২০ সালের জুলাই মাসের মধ্যে দেশের সৌর শক্তি কর্পোরেশন আদানি গ্রিন থেকে ৮ গিগাওয়াট এবং আজুরে পাওয়ার থেকে ৪ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার চুক্তি করে। এই চুক্তি অনুযায়ী এই ১২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ চড়া দামে সৌর শক্তি কর্পোরেশন দেশে বিক্রি করবে। ২০২০ সালে কর্পোরেশন এই চড়া দামে দেশের মধ্যে ক্রেতা খুঁজে পাচ্ছিল না। সেই সময়ে আদানি এবং তার ভাইপো সাগর আদানি, বিনীত জৈন এবং আদানি শিল্পগোষ্ঠীর অন্যান্যরা দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষকে ঘুষ দিয়েছিল উপযুক্ত ক্রেতা নিযুক্ত করার জন্য। ২০২১ সালের আগস্ট থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে গৌতম আদানি নিজে অন্ধ্র প্রদেশ সরকারের অনেক অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন। ভারত সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে প্রায় ২০২৯ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন আদানি, এমনটাই মার্কিন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৭৫০ কোটি টাকা অন্ধ্র প্রদেশের কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। ২০২১ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে সৌর শক্তি কর্পোরেশন থেকে ওডিশা, জম্মু কাশ্মীর, তামিলনাড়ু, ছত্তিসগড় এবং অন্ধ্র প্রদেশ বিদ্যুৎ কিনবে বলে চুক্তিবদ্ধ হয়। ২০২২ সালের এপ্রিল মাসে আদানি শিল্পগোষ্ঠী আজুরে গোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা করে কিভাবে আজুরে আদানি শিল্পগোষ্ঠী যে ঘুষ দিয়েছে তার জন্য আদানি গ্রিনকে ৬৩৮ কোটি টাকা তার ঘুষের ভাগ হিসাবে দেবে। ২০২২ সালের জুন মাসে আজুরে এবং আদানি শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যে এই টাকার ভাগ বাটোয়ারা সম্পূর্ণ হয়। ২০২৪ সালের মার্চ মাসে সৌর শক্তি কর্পোরেশনের আজুরে থেকে যে ২.৩ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ কেনার কথা ছিল তা আদানি গ্রিনের থেকে কিনবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। আজুরে পাওয়ার গ্লোবাল লিমিটেডের অফিস দিল্লিতে এবং এই কোম্পানি নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নথিভুক্ত।
এই সব তথ্য জানা গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আদালতে আনা এক অভিযোগের ভিত্তিতে। আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ এক চূড়ান্ত আর্থিক দুর্নীতির দলিল পাওয়া গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে; ভারতে নয়। এখানেই দেশের মানুষকে সরকার যে কি পরিমাণ ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত স্পষ্ট। এই অভিযোগে সাগর আদানির মোবাইল ফোনে ঘুষ সংক্রান্ত যে নোট পাওয়া গেছে তাতে এই ঘুষকাণ্ডের পূর্ণ নথি পাওয়া গেছে। এই নোটে জানা যায় কবে কোথায় কাকে কত ঘুষ দেওয়া হয়েছে এবং প্রতি গিগাওয়াট বিদ্যুতের বিক্রির জন্য কত পরিমাণ ঘুষ দেওয়া হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে এই বিষয়টি অপরাধ কারণ মার্কিন কোম্পানি ভারতের বাজারে প্রবেশের জন্য আদানি শিল্পগোষ্ঠী ঘুষ দিয়েছে এবং এই বিষয়টি মার্কিন কোম্পানির থেকে গোপনে রেখেছে, এটি মার্কিন কোম্পানিকে অন্ধকারে রেখে মাঝে এসে মুনাফার ভাগ নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে মনে করেছে মার্কিন কোম্পানি। মার্কিন কোম্পানির কাছে সমস্যা হলো এই যে, যদিও মার্কিন কোম্পানি চড়া দামে বিদ্যুৎ বিক্রির বিপক্ষে নয়; এই চড়া দাম তো বাজারের আসল দাম নয়, সে কথা মার্কিন কোম্পানি জানতে পারল না কেন। এই চড়া দাম তো হাঁকাতে বাধ্য করেছে আদানি গোষ্ঠী সরকারকে ব্যবহার করে ঘুষ দিয়ে। এরকম ঘটনা ঘটলে তো আদৌ বাজারের নিয়ন্ত্রণ সেই মার্কিন কোম্পানির হাতে থাকে না, বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আদানি গোষ্ঠীর হাতে। এখানেই মার্কিন দেশে অভিযুক্ত আদানি সংস্থা। আদানি সংস্থা ঘুষের বিনিময়ে মার্কিন কোম্পানিকে ভুল বুঝিয়েছে, বাজার সম্পর্কে ভুল তথ্য দিয়েছে বলে তার সম্পর্কে অভিযোগ মার্কিন দেশে।
কিন্তু আদানি গোষ্ঠী কি শুধু মার্কিন কোম্পানিকেই ঠকিয়েছে বলে এই ঘটনা জানাচ্ছে? আদানি গোষ্ঠী নিয়ে এর আগেও ২০২৩ সালে হিন্ডেনবার্গ নামে একটি সংস্থা একটি রিপোর্ট দেয়, যার ফলে আদানির বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে যে আর্থিক বাজারে ভুল তথ্য দিয়ে এই গোষ্ঠী শেয়ার বাজারকে প্রভাবিত করেছে। এই তথ্য সামনে আসার পর আদানি গোষ্ঠীর অসাধুতা প্রমাণিত হয়। আদানি গোষ্ঠীর আসাধুতা সত্ত্বেও মোদী সরকার ধীরে ধীরে আমাদের দেশের সব সম্পদ একটি একটি করে তুলে দিয়েছে এই অসাধু শিল্পগোষ্ঠীর হাতে। কোভিড অতিমারীর সময়ে ২০১৯ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে এই গোষ্ঠীর সম্পদ বৃদ্ধির হার ৮১৯%! আদানি শিল্পগোষ্ঠীর হাতে রয়েছে দেশের বেশিরভাগ বন্দর, বেশির ভাগ বিমানবন্দর, বিদ্যুৎ উৎপাদন, কৃষিজাত পণ্য, বহু খাদ্যপণ্য, এবং গণমাধ্যম। এই সব ক্ষেত্রে আদানি গোষ্ঠী প্রায় একচ্ছত্রভাবে একচেটিয়া প্রবেশাধিকার পেয়েছে তার অসাধুতাকে কাজে লাগিয়ে এবং মোদী সরকারকে সমর্থন জুগিয়ে।
২০১৪ সালে মোদী সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই এই আদানি গোষ্ঠীর উত্থান চোখে পড়ে। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার জন্য নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যে অর্থ তুলেছে তার ৫৫%ই জোগান দিয়েছে আদানি গোষ্ঠী। আবার পশ্চিমবঙ্গে বিজনেস সামিটের পৃষ্ঠপোষক এই আদানি গোষ্ঠী। সমস্যা এইখানেই। আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গে সবসময়ে নির্বাচিত কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের ওতপ্রোত যোগাযোগ যারা রাখে বা রেখেছে অতীতেও, তারা এখনও আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনোরকম তদন্ত প্রক্রিয়া চালাতে চায় না। হিন্ডেনবার্গ রিপোর্ট প্রকাশের সময়ে তো আদানির বিরোধিতাকে দেশদ্রোহিতা বলেছিল মোদী সরকার। এবারেও কোনোভাবেই সংসদে আলোচনা তুলতে দেয়নি মোদী সরকার। আমাদের রাজ্যেও আদানির হাতেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তুলে দিয়েছিলেন তাজপুর বন্দর, যা একসময়ে অতীতে সরকারের দায় হিসাবে গৃহীত হয়েছিল। এছাড়াও মানুষের ক্ষতিকারক দেউচা পাচামী খোলামুখ কয়লাখনিও তুলে দেওয়া হয়েছিল আদানির হাতে। এরকমটাই ঘটেছে সারা দেশ জুড়ে।
আদানি গোষ্ঠীর এই বাড়বাড়ন্ত, তার অসাধুভাবে আর্থিক বাজারকে প্রভাবিত করা, সরকারের প্রশাসনকে অসাধুভাবে প্রভাবিত করা। ম্যানুপুলেশন বা প্রভাবিত করে ভুল বার্তা দেওয়া আর্থিক বাজারকে অস্বচ্ছ করে। আদানির এই প্রক্রিয়া দেশের আর্থিক বাজারকে অস্বচ্ছ করেছে। এর সাথে সাথে দেশে সব ধরনের পরিকাঠামো, খাদ্য পণ্য, শক্তি, এই ধরনের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছে দেশের শাসক দল। এইভাবে দেশের সব সম্পদের নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে এই অসাধু শিল্পগোষ্ঠীর হাতে। ধীরে ধীরে আদানির সাম্রাজ্য দেশের মধ্যে বিস্তৃত হচ্ছে এবং দেশের মানুষের জীবন জীবিকার পথ সঙ্কুচিত হচ্ছে।
দেশের মানুষের বিপদ এখানেই যে, অসাধু উপায়ে ব্যবসা বা আসলে দেশের সম্পদ লুট করার কাজ যে করছে, তার সম্পর্কে অভিযোগ উঠেছে বিদেশের মাটিতে। দেশের মানুষের বা দেশের মানুষের দ্বারা নির্বাচিত সরকার এ বিষয়ে দায় নিতে নারাজ। আদানির বিরুদ্ধে এই অভিযোগের কেন সিবিআই তদন্ত হবে না, এর কোনও উত্তর নেই। বিদেশে যদি এ দেশের শিল্পগোষ্ঠী অভিযুক্ত হন, তাহলে তার সম্পর্কে কেন নিজের দেশে কোনও তদন্ত হবে না, দেশবাসীর কাছে এর কোনও উত্তর নেই। নির্বাচিত সরকার দেশের মানুষকে কি বোঝাবে? তারা তো নিজেরাই সহায়তা জুগিয়ে আদানি গোষ্ঠীর ব্যবসাকে অসাধু উপায়ে এইভাবে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দিয়েছে, যার আর্থিক অংশে লাভবান তারা নিজেরাও। এ কথা খুব ভালোভাবে জানা আছে আদানি শিল্পগোষ্ঠীর। তাই ক্রমাগত তারা জানিয়ে আসছে দেশের শেয়ার বাজারে এ নিয়ে কোনও প্রভাব পড়বে না, দেশের মানুষের এ নিয়ে উদ্বেগের কারণ নেই ইত্যাদি। আদানি এই মুহূর্তে সব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং যেহেতু এটি একটি অভিযোগ মাত্র এবং আদানি গোষ্ঠীকে কোনও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না, তারা দেশবাসীকে জানিয়েছে যে এ নিয়ে দেশের মাটিতে কোনও প্রভাব পড়বে না! কি আশ্চর্য! আর্থিক দুর্নীতি হলো, কিন্তু দেশের মানুষের উপর নাকি কোনও প্রভাব পড়বে না! অসাধু ব্যবসা, বিনিয়োগ এই সব কিছুর মধ্যে যে লুটের পরিমাণ আছে, সেই লুট তো হয়েছে দেশের মানুষের কাছে থেকেই— এ তো স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। দেশের মানুষকে লুট, বিদেশি সংস্থার কাছে ভুল তথ্য জোগান দেওয়া এবং আর্থিক উন্নয়নকে প্রভাব খাটিয়ে এমনভাবে দেখানো যাতে মনে হয় যে, সে ভালোভাবে চলছে। এই সব কিছুই আদানি গোষ্ঠীর প্রতিপত্তির মূল ভিত্তি। এগুলিই দেশের মানুষের প্রতিদিনের আর্থিক সঙ্কটের কারণ। এই সব ধরনের ঘটনাই একের পর এক ঘটে চলেছে। কিছু জানা যায়, বেশির ভাগটাই জানা যায় না। মোদী -আদানি আজ এক হয়ে গিয়ে দেশের মানুষকে আর্থিকভাবে ফাঁসিয়ে দিতে চাইছে— শুধুমাত্র মার্কিন সংস্থার বিরুদ্ধে নয়, একই সাথে দেশের মানুষের আর্থিক লুটও এইভাবে অব্যােহত রাখছে মোদী সরকার আদানির সহযোগিতায়।
Comments :0