Post editorial

ট্যাব কেলেঙ্কারি: সরষের মধ্যেই ভুত

উত্তর সম্পাদকীয়​

পার্থপ্রতিম বিশ্বাস
 

এ রাজ্যে শিক্ষায় দুর্নীতি কার্যত এক সংক্রামক ব্যাধির চেহারা নিয়েছে। স্কুল শিক্ষা, স্বাস্থ্য শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা প্রতিটি ক্ষেত্রেই দুর্নীতি এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে চলেছে। সরকার পোষিত শিক্ষার ওপরে যখন এরাজ্যের মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত পরিবারের কোটি কোটি পড়ুয়া নির্ভরশীল তখন সেই শিক্ষা ব্যবস্থাটাই আক্রান্ত হচ্ছে বারংবার দুর্নীতির দুরারোগ্য ভাইরাসে। ফলে এমন দুর্নীতির ধাক্কায় শিক্ষার ন্যূনতম পরিকাঠামোর কাঙ্ক্ষিত মান বজায় রাখা যেমন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে তেমনি সেই দুর্নীতির জাঁতাকলে পিষে যাচ্ছে মানুষের শিক্ষার অধিকার। একটা রাজ্যে নির্বাচিত সরকারের থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে ন্যূনতম যে আইনের শাসন প্রত্যাশা করে মানুষ সেটার জলাঞ্জলি ঘটছে বারবার। সরকারের সাথে যুক্ত নেতা মন্ত্রীরা মুখে ‘ জিরো টলারেন্সের’ কথা বললেও তার বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক উদ্যোগ উধাও। ফলে ফি বছর বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা উধাও হয়ে যাচ্ছে সরকার পোষিত ব্যবস্থায় দুর্নীতির গ্রাসে।  
এখন দেশ জুড়েই সরকারি প্রকল্পের উপভোক্তাদের হাতে টাকা পৌঁছানোর জন্য প্রযুক্তি নির্ভর উপায়ে অনলাইন ব্যবস্থায় তাঁদের ব্যাঙ্ক  আক্যাউন্টে পাঠানো হয়। আজকের উন্নত প্রযুক্তির যুগে ডিজিটাল ব্যবস্থায় আর্থিক লেনদেন দুর্নীতিতে দাঁড়ি টানবে কিংবা স্বচ্ছতা বাড়িয়ে তোলে এমনটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু সেই ধারণা সাধারণভাবে সত্যি হলেও এরাজ্যে যে ভিন্ন রূপ ধারণ করে  সেটা গত দশ বছরে বিভিন্ন সরকারি  প্রকল্পের অনলাইন লেনদেনে প্রমাণিত। ইতিমধ্যে একশো দিনের টাকা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভুয়ো ‘জব কার্ড’ এবং ভুয়ো আক্যাউন্ট  বানিয়ে সরকারি টাকার পাচার দেখেছে রাজ্যের মানুষ।  তার পর উন্নত ‘ জিপিএস ট্যাগিং’  ব্যবস্থাকে অকেজো প্রমাণ  করে গ্রামের দোতলা বাড়ির গোয়ালঘরকে বাসস্থান  দেখিয়ে আবাস যোজনার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রাজ্যের শাসক দলের নেতা কর্মীরা। আমফানের মতো ঘূর্ণিঝড়ে আসা কেন্দ্রীয় অনুদান একইভাবে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় অনলাইন ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় পৌঁছে যায়  গ্রামের তৃণমূলের নেতা কর্মীদের বাতানুকূল অট্টালিকা মেরামতির জন্য। 
সেই ট্র্যাডিশন মেনে এবার স্কুলশিক্ষার সরকারি প্রকল্পের ট্যাবের টাকা পড়ুয়াদের আক্যাউন্টের পরিবর্তে পৌঁছেছে  ঠগেদের ভুয়ো আক্যাউন্টে। ফলে রাজ্যের ষোলো লক্ষ স্কুল পড়ুয়াদের উদ্দেশ্যে ঘোষিত ৯০০ কোটি টাকার ‘ তরুনের স্বপ্ন ‘ প্রকল্প এখন রাজ্যবাসির স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কায়। কিন্তু সরকারি অনলাইন ব্যবস্থায় ঐ বিপুল অর্থভাণ্ডারে ‘সাইবার ক্রাইম’  ঘটিয়ে ভুয়ো আক্যাউন্টে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা প্রকাশ্যে আশায় সরকারি পোর্টালের নিরাপত্তা এবং কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। একাদশ – দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়াদের শিক্ষার প্রয়োজনে  কম্পিউটার ট্যাবলেট কেনার খরচ বাবদ মাথামিছু দশ হাজার টাকার এই প্রকল্পে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে রাজ্যের কোচবিহার থেকে কাকদ্বীপের স্কুল  পড়ুয়ারা। এই উদ্দেশ্যে সরকারি পোর্টাল খোলা হয়েছিল কেন্দ্রীয়ভাবে। যে পোর্টালে রাজ্যের বিভিন্ন স্কুলগুলি থেকে পড়ুয়াদের নাম ধাম ঠিকানা পরিচিতি সহ তাঁদের ব্যাঙ্ক  আক্যাউন্টের নম্বর আপ-লোড করার  কথা স্কুল কর্তৃপক্ষের। পড়ুয়াদের সেই তথ্য সঠিকভাবে যাচাইয়ের পর ট্যাবের বরাদ্দ সরকারি অনুদান চলে যাওয়ার কথা পড়ুয়াদের আক্যাউন্টে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে সেই নম্বর যাচাইয়ের পরিবর্তে পড়ুয়াদের  আক্যাউন্টের জায়গায়  গোছা গোছা ভুয়ো আক্যাউন্ট নম্বর ঢুকে পড়ল সেই সরকারি পোর্টালে। অর্থাৎ উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে পড়ার উপক্রম হলো সরকারি ব্যবস্থার ফাঁক গলে। 
আর এখানেই প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে সেই পোর্টালের তথ্য আদান প্রদানের স্বচ্ছতা এবং নিরাপত্তা নিয়ে। ইতিমধ্যেই প্রমাণিত যে সেই পোর্টালে পড়ুয়াদের এমন স্পর্শকাতর জরুরি তথ্য নিরাপদে রাখার যে ব্যবস্থা ছিল সেটি ভীষণ ঠুনকো এবং ত্রুটিপূর্ণ। যে কোনও মধ্য মেধার দুষ্কৃতী কিংবা হ্যাকার  ঐ পোর্টালে রাখা তথ্যকে  পরিবর্তন করে ফেলতে পারে অনায়াসেই। ফলে এমন সহজ পথে বিনা বাধায় এই ট্যাব দুর্নীতির জাল বিস্তার করেছে দুষ্কৃতীরা। এখনও পর্যন্ত এমন দু’হাজার ভুয়ো আক্যাউন্টের সন্ধান মিলেছে কারণ বহু স্কুলে একদল যোগ্য পড়ুয়ারা ট্যাবের টাকা পেলেও বাকিরা পায়নি বলে। ফলে সহজেই এবং দ্রুত এমন প্রাপ্তি অপ্রাপ্তির বিবাদ সংবাদ মাধ্যমে  চলে এসেছে । কিন্তু আদপে ঐ  লক্ষ লক্ষ ট্যাব গ্রাহকের তালিকায় দুধ এবং জলের পরিমাণ কতো সেটা চটজলদি ধরার কোনও উপায় নেই এই সরকারি বিলি ব্যবস্থায়। ফলে এই ট্যাব দুর্নীতির ব্যাপ্তি এবং গভীরতা অনুসন্ধানের জন্য ইতিমধ্যে পুলিশ ‘ সিট ‘ গঠন করেছে।  অনেকটাই ‘ চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ার’ মডেলে। কিন্তু অতীতে সারদা থেকে শিক্ষক নিয়োগের মতো আর্থিক দুর্নীতির তদন্তে গঠিত এমন ভূরি ভূরি ‘ সিটের ’  অশ্বডিম্ব প্রসবের চিত্র  দেখেছে রাজ্যের মানুষ। কারণ  প্রতিটি ক্ষেত্রেই চুরির সুত্র  আবিষ্কার হয়েছে অথচ চোর ধরা পড়েনি। এক্ষেত্রেও  তেমনটি হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। 
সরকারের জরুরি তথ্য নিরাপদে সুরক্ষিত  রাখার ক্ষেত্রে এই ট্যাব দুর্নীতি তুলে ধরেছে শিক্ষা দপ্তরের কর্মী সংখ্যার হাঁড়ির হালের ছবিটাও। স্কুলের প্রয়োজনীয় তথ্য সরকারি পোর্টালে তুলতে গেলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন গ্রুপ-সি কর্মীদের অথচ যার নিয়োগ  বন্ধ গত আট বছর ধরে। রাজ্যের ৫০% স্কুলে গ্রুপ-সি কিংবা  গ্রুপ- ডি পর্যায়ের কোনও কর্মী নেই। ফলে সেই সমস্ত স্কুলে ‘ জুতো সেলাই থেকে চণ্ডী পাঠ ‘ সবই করতে হয় স্কুলের শিক্ষকদের। সেই নিয়োগও বন্ধ হয়ে গেছে দীর্ঘকাল নিয়োগ দুর্নীতির ধাক্কায়। ফলে এই কর্মী সঙ্কটের আবহে যদি পড়ুয়াদের তথ্য বিভ্রাট ঘটে পোর্টালের সার্ভারে সেক্ষেত্রে তথ্য যাচাইয়ের খামতির দায় রাজ্যের সরকার অস্বীকার করতে পারে না। ফলে এমন দুর্বল প্রস্তুতি এবং পরিকাঠামো নিয়ে ৯০০ কোটি টাকা বিলি বন্দোবস্তের যে পরিকল্পনা তাতে যে গোঁড়ায় গলদ সেটা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট এই ট্যাব কেলেঙ্কারির ঘটনায়। কার্যত এমন অপ্রস্তুত ব্যবস্থার ফাঁক  গলে এমন কেলেঙ্কারি নাকি ইচ্ছাকৃতভাবেই সেই ব্যবস্থায় টাকা পাচারের জন্য  এই গলদ সেটাও হয়ে উঠছে বহুমুল্যের প্রশ্ন। এমনকি এই ট্যাব কেলেঙ্কারিতে ভুয়ো  আক্যাউন্টগুলি কমিশনের ভিত্তিতে  ব্যবহৃত হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠে এসেছে। এমনকি এই দুর্নীতিতে জামতাড়া গ্যাঙের মতো অসাধু প্রতারণা চক্র যুক্ত থাকার আশঙ্কা উঠে এসেছে  এই ট্যাব কেলেঙ্কারিতে। এই প্রেক্ষিতে ঐ সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নে বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর ফাঁদে ট্যাব দুর্নীতি ঘটেছে। 
সন্দেহ নেই হাল আমলে স্কুল শিক্ষার গুণমান উন্নয়নের লক্ষ্যে উন্নত প্রযুক্তি  ব্যবহারের সুযোগ বাড়ছে। সেক্ষেত্রে সরকারের প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়া উচিত স্কুল চত্বরে পড়তে আসা পড়ুয়াদের লেখাপড়ায় উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর পরিকাঠামো গড়ে তোলা। কিন্তু এরাজ্যের সরকারি বিদ্যালয়গুলিতে এমন প্রযুক্তি নির্ভর পরিকাঠামোর হাঁড়ির হাল। অজস্র শিক্ষক শিক্ষা কর্মীর শূন্য পদের পরেও  বিদ্যালয় কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় মাস মাইনের বাইরে চক-ডাস্টার– ইন্টারনেট, লাইব্রেরির মতো খরচের টাকা জোগানে ব্যর্থ রাজ্যের সরকার। উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলগুলিতে গাল ভরা আধুনিক বিষয় হিসাবে চালু হচ্ছে ‘ ডেটা সায়েন্স ‘ কিংবা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের’ মতো ঐচ্ছিক বিষয় অথচ ডজন ডজন স্কুলে কম্পিউটারের শিক্ষক পদ শূন্য। সিভিক পুলিশের মতো ভাড়া করা শিক্ষক দিয়ে চালানো হচ্ছে সেই সব বিষয়ের ক্লাস। এমন প্রেক্ষিতে একাদশ কিংবা দ্বাদশের পড়ুয়াদের বিলি করা সরকারি ট্যাবের কার্যকারিতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি ট্যাবের পরিবর্তে টাকা দেওয়ার মধ্যেও যে  শাসকের সস্তা রাজনৈতিক জনপ্রিয়তা আদায়ের চেষ্টা রয়েছে নতুন  প্রজন্মের ভোটারদের জন্য সেটাও স্পষ্ট হচ্ছে দিনে দিনে। 
কার্যত গত কয়েক বছরে বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বশাসনের প্রশাসনিক কাঠামো ভেঙে পড়ায় দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ ঘটছে দ্রুত লয়ে। সরকারি ব্যবস্থায় আনুগত্যের বিনিময়ে নষ্ট হচ্ছে প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং দায়বদ্ধতা। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শাসকের অনুগত মানুষ জনেদের যাঁদের সিংহভাগ হয় অযোগ্য নয় দুর্নীতিগ্রস্ত। ফলে মাসের পর মাস  রাজ্যের স্কুলের শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমনকি খোদ শিক্ষা মন্ত্রী জেল খাটছেন শিক্ষায় দুর্নীতির অভিযোগে। আজ এটা ক্রমশ স্পষ্ট হচ্ছে যে শিক্ষা প্রশাসনে বিকেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে কেন্দ্রীভবনের যে পথ দেশ কিংবা রাজ্যের সরকার গ্রহণ করেছে তাতে আরও বেশি করে গেড়ে বসছে দুর্নীতির ঘুঘুর বাসা।  বাম আমলের নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমুলক ব্যবস্থা চালু থাকলে অপ্রতুল পরিকাঠামোতেও  দুর্নীতি রোধের ভারসাম্যের ব্যবস্থা নিহিত ছিল। ফলে শিক্ষা ক্ষেত্রে চৌত্রিশ বছরের বাম আমলে বড় কোনও বেনিয়ম কিংবা দুর্নীতি মাথা তুলতে পারেনি অথচ আজ সেই ব্যবস্থার অবসানে গড়ে উঠছে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি। উন্নত  প্রযুক্তির ব্যবহার সব সময়ই প্রয়োজন কিন্তু তাঁর চেয়েও বেশি প্রয়োজন সেই প্রযুক্তি প্রয়োগের নীতি। সেই প্রযুক্তি প্রয়োগে চাই ইতিবাচক পরিবর্তন। চাই পরিবর্তনের দিশা এবং অভিমুখ নির্ধারণ। অন্যথায় সরকারের বদলির পোর্টালের মতো  ভ্রান্ত নীতিতে কুপোকাত হয়ে পড়েছে দূরের জেলার স্কুলগুলি। সেই পোর্টাল প্রণয়নে অপরিণত বুদ্ধির ঠেলায় গ্রামের বদলির ধাক্কায় স্কুলে স্কুলে বিভিন্ন বিষয়ের শূন্য পদ বাড়ছে আবার কোথাও নষ্ট হচ্ছে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের ভারসাম্য। ফলে আবারও সেই পুরানো প্রবাদ ফিরছে নতুন হয়ে। ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।  

Comments :0

Login to leave a comment