অনির্বাণ গাঙ্গুলি
৮ ডিসেম্বর, রবিবারের সকাল। পৃথিবীর প্রায় সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে শিরোনাম — বাশার আল-আসাদের নেতৃত্বাধীন সিরিয়ার বাথিস্ট সরকারের পতন হয়েছে, ‘হায়াত তাহরির টিভি আল-শাম’ (এইচটিএস) নামে পরিচিত তাকফিরি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ১১ দিনব্যাপী টানা আক্রমণের পরিণতিতে।
এই খবরে আমেরিকা ও তাদের দোসর দেশগুলোর উল্লাস উদ্যাপনে কোনও রাখঢাক নেই। তাদের রাষ্ট্র প্রধানদের প্রকাশ্য মন্তব্যেই স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, ইসরায়েল এবং অন্যান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সহায়তা ছাড়া এই ঘটনা ঘটানো সম্ভব ছিল না।
দামাস্কাসের পতন শুধু সিরিয়ায় আসাদ পরিবারের পাঁচ দশকের শাসনের সমাপ্তিই নয় বরং মধ্য প্রাচ্যে বাথ পার্টির প্রভাবেরও সমাপ্তি বলা চলে। এই বাথ পার্টি একটি প্যান-আরববাদী রাজনৈতিক দল, যা একটি একক আরব সমাজতান্ত্রিক জাতি গঠনের ভাবনার ভিত্তিতে চলে। সিরিয়ার দামাস্কাস শহরে মিশেল আফলাক এবং সালাহ আল-দিন বিতার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। এই দলের শাখা বিভিন্ন মধ্য প্রাচ্যের দেশে থাকলেও প্রধানত এটি সিরিয়ায় ১৯৬৩ সাল থেকে গত রবিবারের আগে পর্যন্ত এবং ইরাকে ১৯৬৮ থেকে ২০০৩ সালে সাদ্দাম হোসেন-এর ইরাক যুদ্ধে পরাস্ত হবার আগে পর্যন্ত শাসনকারী দল ছিল।
এই বাথিজম বা বাথ সমাজতন্ত্রের মতবাদ ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদ এবং শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের নীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। বাথিজম সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক নীতিগুলোর পক্ষেই সওয়াল করে এবং প্রাকৃতিক সম্পদের রাষ্ট্রীয় মালিকানা ও সুরক্ষানীতির ভাবনাকে গুরুত্ব দেয়। কৃষকদের মধ্যে জমি বিতরণ এবং পরিকল্পিত অর্থনীতির কথা বলে। ফলে অবধারিত এই মতবাদ হয়ে ওঠে পশ্চিমী পুঁজিবাদী দুনিয়ার চক্ষুশুল। তাই চলতে থাকে ধারাবাহিক অপপ্রচার ও আক্রমণ। গণবিধ্বংসী অস্ত্রভাণ্ডর মজুতের অজুহাতে, মিথ্যে অভিযোগ এনে যুদ্ধ লাগিয়ে সাদ্দাম সরকারের পতন ঘটিয়ে তাঁকে ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর পরই সিরিয়ার আসাদ সরকারকে নিশানা করে তারা।
আসলে সিরিয়ায় যা ঘটছে তা নিয়ে কোনও রহস্য নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার 'নতুন বিশ্ব ব্যবস্থা' গড়ে তোলার নামে দেশগুলোকে টুকরো টুকরো করা এবং বিশ্বকে ছোট ছোট অগুন্তি ভাগে বিভক্ত করাই ছিল পশ্চিমী পুঁজিবাদী দুনিয়ার লক্ষ্য। কেউ কেউ এটিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলেন— 'প্রত্যেক জাতির রাষ্ট্র গঠনের অধিকার আছে’। আসলে বিষয়টি পুরোপুরি একটি লুটের প্রক্রিয়া। বহুজাতিক একচেটিয়া প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজি প্রবাহ, শ্রমিকদের শোষণ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুটের ক্ষেত্রে কোনও সীমাবদ্ধতা রাখতে চায় না। এটি আসলে সেই পরিকল্পনাকে কার্যকর করারই ব্লু প্রিন্ট।
এটি অত্যন্ত পরিকল্পিত পদক্ষেপ। বড় একটি ষড়যন্ত্রের অংশ। যার গালভরা নাম রাখা হয়েছে ‘আরব বসন্ত’। সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ এবং জিহাদিদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অর্থ হলো এককথায় মধ্য প্রাচ্যের বিস্তৃত অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ন্যাটো, তুরস্ক এবং ইজরায়েল সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিপজ্জনক কর্মকাণ্ডের আরেকটি ধাপ। প্যালেস্তাইন জনগণের ওপর চলমান গণহত্যা, লেবাননের জনগণের ওপর আক্রমণ এবং ইরানকে লক্ষ্যবস্তু করার ধারাবাহিক প্রক্রিয়ারই অংশ এটা।
এই প্রক্রিয়ার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আসাদ। স্বাভাবিকভাবেই এই অঞ্চলের প্রতিক্রিয়াশীল সরকারগুলো এবং তুরস্কের শাসক এর্দোগানের চোখে আসাদ হয়ে ওঠেন ঘৃণার পাত্র। আসাদ যদি দৃঢ়ভাবে প্রতিরোধ না করতেন, তাহলে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এবং জিহাদি জোট পুরো অঞ্চলকে তাদের ইচ্ছামতো দখল করে নিত আর পশ্চিমী দুনিয়া তাদের মতো করেই অঞ্চলকে সাজিয়ে নিতে পারত অনেক আগেই। ইরান এবং রাশিয়া আসাদের এই প্রতিরোধকে সাহায্য করেছিল, তবে এক্ষেত্রে তাদের নিজেদের স্বার্থও জড়িত ছিল। এর ফলে সিরিয়াকে দখল করা যাচ্ছিল না।
তবে মূল সমস্যা হলো অন্য জায়গায়। বর্তমান আসাদ প্রশাসন তাদের মূল বাথ সমাজতান্ত্রিক নীতি থেকে অনেকটাই সরে আসে। জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকে নিজেদের প্রতিরোধের ভিত্তি করার পরিবর্তে ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাকে প্রাধান্য দেয়, বলা চলে উদার অর্থনৈতিক নীতির গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায়। তাই পুঁজিবাদের উদার অর্থনৈতিক নীতি চলতে থাকে আসাদ আমলে। যুদ্ধক্লান্ত সিরিয়ায় এমন অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োগ করা হয়নি যা শ্রমজীবী মানুষকে সাহায্য করবে। আসাদ প্রশাসন 'বিপদ কেটে গেছে' ভেবে নতুন উদার নীতির আশ্রয় নেওয়ার কারণেই জনগণের জীবন জীবিকার পরিস্থিতির অবনতি ঘটে এবং পরিণতিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়তে শুরু করে। মনে রাখা দরকার পুঁজিবাদে কোনও নীতি থাকে না, থাকে শুধুই প্রতিযোগিতা, সংঘাত এবং স্বার্থের অংশীদারিত্ব।
প্যালেস্তাইনের জনগণের কী হয়েছে? বর্তমান পরিস্থিতির জন্য প্যালেস্তাইনের প্রতিরোধকে দায়ী করে যাঁরা বলেন, 'ইজরায়েলকে প্ররোচিত না করলে এই প্রতি আক্রমণে তারা যেত না', তারাও খুব ভালো করেই জানেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের প্রকাশ্য সমর্থন এবং বাকি বিশ্বের লজ্জাজনক নীরবতার পেছনে নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করাই মূল কারণ। ইজরায়েল এবং ইহুদি পুঁজি সাধারণভাবে খুব শক্তিশালী অপরদিকে গাজার অধিকাংশ মানুষই দরিদ্র। অতএব নতুন বাজার তৈরি করার জন্যই প্রয়োজন নানা দেশের দখলদারি।
সেই লক্ষ্যে ইজরায়েল, গোলান মালভূমিতে দীর্ঘদিন ধরে সিরিয়ার ভূমি দখল করে আছে। ‘সন্ত্রাসবাদ’ এবং ‘জিহাদবাদের’ বিরুদ্ধে লড়াইয়ের নামে প্যালেস্তাইনের জনগণের উপর গণহত্যা চালানো সত্ত্বেও, সিরিয়ায় জিহাদিদের সাথে সহযোগিতা করতে তারা তাই পিছপা হয়নি। ইজরায়েলি সেনাবাহিনী ইতিমধ্যে সেখানে আক্রমণ শুরু করেছে এবং সিরিয়ার আরও ভূখণ্ড দখল করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
এখন বড় প্রশ্ন হলো সিরিয়ার জনগণ কী অবস্থান নেবে। তাঁরা কি সামনে এগিয়ে এসে ঘটনার গতিপথ পরিবর্তনের জন্য তাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করবে, যা বিপ্লবী ও মৌলিক পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে দেবে? নাকি তাঁরা তাদের শোষকদের অভিলাষের দয়ার উপর নির্ভরশীল থাকবে, যার পরিণতি হবে ভয়ঙ্কর, ধ্বংসাত্মক। মনে রাখতে হবে শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো এবং দেশকে রক্ষা করা অসম্ভব।
খবরে প্রকাশ দামাস্কাসের দরজায় কড়া নাড়ছে ইজরাইলের সেনাবাহিনী। বিগত ৪৮ ঘণ্টায় সিরিয়ার সাধারণ মানুষের ওপর ৩৫০ বারেরও বেশি বিমান হানা চালিয়েছে তারা। তাই জোট বেঁধে তৈরি হওয়া ছাড়া উপায় কি? আসাদ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন, কিন্তু দেশের মানুষগুলো কোথায় যাবেন! পশ্চিমী পুঁজিবাদী দুনিয়া আর একটা নতুন লুটের ক্ষেত্র তৈরিতে আপাতত সফল, কিন্তু সিরিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত গভীর অস্থিরতায় নিয়ে ফেলল।
Comments :0