Sikkim Tragedy

বিধ্বস্ত সিকিমে নিষিদ্ধ পর্যটকদের প্রবেশ

জাতীয়

আবহাওয়ার খানিকটা উন্নতি হতেই শুক্রবার সিকিমের প্রাকৃতিক দুর্যোগে আটকে পড়া পর্যটকদের উদ্ধারের কাজ পুরোদমে শুরু হলো। দুর্গম জায়গায় আটকে পড়া পর্যটকদের কপ্টারের মাধ্যমে এদিন উদ্ধার চলছে। বাগডোগরা থেকে লাচুং যাবার জন্য এদিন হেলিকপ্টার যাত্রা শুরু করেছে। খরস্রোতা তিস্তার তাণ্ডবে প্রতিবেশী রাজ্য সিকিম কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এখনও বহু মানুষের কোনও খোঁজ নেই। এই পরিস্থিতিতে পর্যটকদের জন্য সিকিমে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। 


মঙ্গলবার রাতের পর থেকে সিকিমের বিভিন্ন এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলো। শুক্রবারেও তা অনেক চেষ্টা করেও স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। সিকিমে বেড়াতে আসাটা এই সময়ে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। পুজোর মরশুমে সিকিমে বেড়াতে আসার জন্য দেশ-বিদেশের বহু পর্যটক বুকিং করে রেখেছিলেন। সিকিম সরকারের পক্ষ থেকে পর্যটকদের উদ্দেশে বুকিং বাতিল করার কথা এদিন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছাঙ্গু ও নাথুলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সিকিম পর্যটন দপ্তরের তরফেও এই বিষয়ে একটি নির্দেশিকা জারি করা হয়েছে। প্রকৃতির রোষে বিপর্যস্ত সিকিমে ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ও জলের তোড়ে তিস্তা নদী বক্ষে ভেসে যাওয়া ২২ জনের দেহ এখনও পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে। তিস্তার চরে দেহ আটকে থাকার আশঙ্কা করা হচ্ছে। শুক্রবার সকালে জলপাইগুড়ি থেকে আরও ৩টি দেহ উদ্ধার করা হয়েছে।  জলপাইগুড়ি তিস্তা নদীতে এখন মৃতদেহের ছড়াছড়ি। জেলার তিস্তা পাড়ে থাকা মাল থানা, ময়নাগুড়ি থানা এবং সদর ব্লকের কোতোয়ালি থানা এলাকা মিলিয়ে মোট ১৮টি দেহ এদিন উদ্ধার করলো পুলিশ। 


সিকিমে হড়পা বানে বানভাসি হয়েছেন সেনা জওয়ান থেকে শুরু করে পর্যটকসহ বহু সাধারণ মানুষ। নিখোঁজ সেনা জওয়ানদের খোঁজ চালানোর পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে উদ্ধারকার্য চালিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। এনডিআরএফ জোরকদমে উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। বানভাসি আশ্রয়হীন মানুষের জন্য থাকা, খাওয়াসহ প্রয়োজনীয় ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়েছে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে। সিংটামের বারদাংঙে খনন কার্য চালিয়ে মাটিতে চাপা পড়ে থাকা সেনাবাহিনীর গাড়ি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার অভিযান চালাচ্ছে তিরঙ্গা মাউন্টেন রেসকিউ টিম। মাউন্টেন ডগ নামিয়ে তল্লাশি চলছে। 
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ত্রিশক্তি কোরের জওয়ানরা ইতোমধ্যেই লাচেন, লাচুঙ, চাট্টেন, চুংথাঙ এলাকায় আটকে থাকা সহস্রাধিক পর্যটককে উদ্ধার করেছে। বিধ্বংসী তিস্তার জলের তোড়ে ভেসে গেছে ত্রিবেণী রিভার সাইড ক্যাম্পগুলি। ক্যাম্পগুলির কোনও চিহ্ন অবশিষ্ট নেই। সিকিমের মুখ্য সচিব ভিবি পাঠক জানিয়েছেন, মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, ফার্মেসি অ্যাসোসিয়েশনসহ অন্যান্য বেশ কিছু সংস্থাকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। 


মঙ্গলবার রাত থেকে সিকিম ও বাংলা যোগাযোগ রক্ষাকারী জাতীয় সড়ক পুরোপুরি বন্ধ থাকার কারণে এদিন বিকল্প পথে পর্যটকদের ফেরানো হচ্ছে। গ্যাঙটক, থেকে পেডং, আলগাড়া, লাভা, গোরুবাথান, ডামডিম, সেবক ঘুরে বিকল্প পথে শিলিগুড়িতে যাতায়াত করেছে গাড়িগুলি। গ্যাঙটক থেকে রানিপুল, সিংটাম, রংপো, নামথাঙ, নামচি, জোরথাং, সিংলা হয়েও আরো একটি রুটে এদিন যোগাযোগ রক্ষা করা গেছে। শিলিগুড়ি থেকে রঙপো পর্যন্ত বেশ কয়েক জায়গায় রাস্তা পুরোপুরিভাবে ধসে গেছে। শিলিগুড়ির অদূরে সেবক থেকে কালিঝোরার মাঝখানে জাতীয় সড়কের একটি বড় অংশ তিস্তার জলে ধসে গেছে।
অন্যদিকে কালিম্পঙের মাল্লি থেকে শুরু করে রঙপো পৌঁছানোর আগে পর্যন্ত রাস্তাতেও একাধিক জায়গায় ধস নেমেছে। একমুখী যান চলাচল শুরু করার লক্ষ্যে ১০নম্বর জাতীয় সড়ক মেরামতির কাজে হাত দেওয়া হয়েছে। তবুও কমপক্ষে ১০-১২দিনের আগে একমুখী যান চলাচলের উপযোগী করে তুলতে কোনোভাবেই জাতীয় সড়ক মেরামত করা সম্ভব নয় বলেই প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। 
সিকিম বিপর্যয়ে শিলিগুড়ির ৪নং ওয়ার্ডের মহারাজা কলোনির বাসিন্দা মহম্মদ মুক্তা’র বেঁচে ফিরলেও তিস্তা নদীর গ্রাসে হারিয়ে গেছে তাঁর তিন সন্তান। মৃত অবস্থায় এক ছেলেকে উদ্ধার করা গেলেও তলিয়ে যাওয়া দুই মেয়ের কোন খোঁজ নেই। একটি গাছের মগ ডালে উঠে গাছ জাপটে ধরে রয়েছেন এক ব্যক্তি। দুই পাশ জুড়ে ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা চালিয়ে গাছের নিচে দিয়ে বয়ে চলেছে তিস্তা। সিকিমের বিপর্যয়ের পরেই সোশাল মিডিয়া জুড়ে সেই ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। শিলিগুড়িবাসী ওই ব্যক্তি কর্মসূত্রে সিকিমের রঙপোতে থাকতেন। সেই রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় কোনও কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিস্তার নদীর জল ঘরের ভেতরে ঢুকে হাত ধরার আগেই তিন সন্তানকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সারা রাত গাছ জড়িয়ে রেখে প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন তিনি। চোখের সামনে তিনি একের পর এক তিন সন্তানের মৃত্যু দেখেছেন। কিছুতেই শান্ত হতে পারছেন না। ফেরার পর থেকে কেঁদেই চলেছেন। 


শিলিগুড়ির বাজার থেকে কাঁচা সবজি, ফল মূল, মাছ-মাংসসহ নানা সামগ্রী সিকিমে যায়। কিন্তু গত বুধবারের পর থেকে সিকিমে যানবাহন চলাচল পুরোপুরি বন্ধ থাকায় সমস্ত পণ্য সরবরাহ বন্ধ হয়েছে। সিকিমে পাঠাতে না পেরে কাঁচা সবজি ও মাছে পচন ধরতে শুরু করেছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েক কোটি টাকা বলে নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবসায়ীদের দাবি। এঘটনায় তাঁরা দারুণ উদ্বিগ্ন। কাজ নেই নিয়ন্ত্রিত বাজারের গাড়ির চালকদের। ঘুরপথে সিকিমে পৌঁছাতে খরচ অনেক। তাই বাজার চত্বরে গাড়ির লম্বা লাইন। ফলে গাড়ি চালকেরাও চিন্তিত। এরই মধ্যে সিকিমের হড়পা বানে তিস্তা নদীতে এসেছিল সেনাবাহিনীর মর্টার শেলসহ সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত প্রচুর বিস্ফোরক। নদী থেকে কুড়িয়ে বাড়িতে  জমা করে রাখা সেই শেল ফেটে বৃহস্পতিবার রাতে ক্রান্তি ব্লকের চাঁপা ডাঙ্গা পণ্ডিত পাড়া এলাকায় আইনুর আলম (৭) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ঘটনায় জখম হয় আরও ৫ জন। মর্মান্তিক ওই ঘটনার পর গ্রামের লোকজন যারা নদী থেকে ওই জাতীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে গেছিলেন তাঁরা বিপদের কথা চিন্তা করে তড়িঘড়ি তা তিস্তা নদীর চরে ফেলে আসেন। শুক্রবার  সিআইডি’র বম্ব স্কোয়াড এবং ব্যাঙডুবি সেনা ছাউনি থেকে সেনাবাহিনী ও পদস্থ আধিকারিকরা চাঁপা ডাঙ্গা গ্রামে আসেন। ক্রান্তি ফাঁড়ির পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে মর্টার শেলসহ সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত অন্যান্য বিস্ফোরক জাতীয় সামগ্রীর খোঁজে সেনাবাহিনী জোর তল্লাশি শুরু করেন। উদ্ধার হয় ৩০টি মর্টার শেল। প্লাবনের জলের তোড়ে তিস্তা নদীতে ভেসে আসা সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত সামগ্রীর খোঁজে শনিবারও ব্লকের বিভিন্ন এলাকায় এধরনের অভিযান চলবে জানিয়েছেন পুলিশ আধিকারিক মনসুর উদ্দিন। 
 

 

 

Comments :0

Login to leave a comment