অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়ালো বাংলাদেশ। উত্তাল জনরোষ ও গণবিক্ষোভের অঙ্গ শীর্ষে একরকম অসহায় অবস্থায় পদত্যাগ করে দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অবসান হলো হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামি লিগের ১৫ বছরের শাসনের। ভারতের সহায়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭১ সালে। চার বছর কাটতে না কাটতেই নিজের বাসভবনে আততায়ী আক্রমণে সপরিবারে নিহত হন বাংলাদেশের জাতির জনক মুজিবর। তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনা ও রেহানা সেই সময় বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের জনককেই যদি এভাবে খুন হয়ে যেতে হয় তাহলে বুঝতে হবে সেখানে মুক্তি যুদ্ধের চেতনা বিরোধী শক্তি এবং স্বাধীনতার শত্রুরা সক্রিয়। বস্তুত এই শক্তি বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্য চেতনা বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে এবং জাতীয় নির্মাণ ও দেশ গঠনে অন্তর্ঘাতের জমি তৈরি করে। এমন অপশক্তিকে পুষ্ট করে মৌলবাদী শক্তি। বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বিকাশে পথে পদে পদে বাধার পাহাড় সৃষ্টি করে এই শক্তি। ফলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঘটনার পর থেকে বিশৃঙ্খলা, অশান্তি, অস্থিরতা গ্রাস করে নবীন এই রাষ্ট্রকে। গণতান্ত্রিক পথে নির্বাচনের মাধ্যমে জনমতের ভিত্তিতে সরকার গঠন করে সুস্থির স্থায়ীভাবে দেশ পরিচালনার সুযোগই ছিল না। কখনো সেনা সরকার, কখনো মৌলবাদী স্বৈরাচারীদের সরকার তৈরি হয়েছে আবার প্রবল অসন্তোষ, অভ্যুত্থানে সেই সব সরকারের পতনও হয়েছে। দীর্ঘ অস্থিরতা, অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দেশটা স্থিতিশীল ২০০৯ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে জিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর। বস্তুত তারপর থেকেই গত ১৫ বছরই বাংলাদেশের উন্নয়ন তথা আর্থ-সামাজিক বিকাশের স্বর্ণযুগ হিসাবে পরিচিত হয়েছে। এই সময়ই দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হার সর্বোচ্চ হয়। বহু আধুনিক নির্মাণ দেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে। উন্নয়নের আন্তর্জাতিক মাপকাঠির অনেকগুলিতে দ্রুত এগিয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে ভারতকেও অনেকটা পেছনে ফেলে দিয়েছে।
বিরাট সাফল্যের পাশাপাশি গণতন্ত্রের পরিসরকে সঙ্কুচিত করে, স্বৈরাচারী প্রবণতা বেড়েছে। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ, ঔদ্ধত্য বেড়েছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা প্রকট হয়েছে। অর্থাৎ ক্ষমতা ধরে রাখার তাগিদে মানুষকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছে হাসিনার সরকার। তারই চরমমূল্য দিতে হচ্ছে এখন। মূল্য শুধু হাসিনা তার দলকে দিতে হচ্ছে না, আগামীদিনে সমগ্র দেশকে আরও কত মূল্য দিতে হবে কেউ জানে না।
সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ প্রবল হলেও হয়তো পরিস্থিতি এই জায়গায় যেত না যদি কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলন দমনে সরকার দমনমূলক পথ না নিত এবং আন্দোলনকারীদের জব্দ করতে দলীয় বাহিনীকে লেলিয়ে না দিত। সরকার যদি নমনীয় মনোভাব নিয়ে সহানুভূতিশীল মন নিয়ে সামাল দেবার চেষ্টা করত তাহলে এত মৃত্যুর মধ্যে আগুনে ঘৃতাহুতি হতো না। তেমনি মৌলবাদী-ফ্যাসিস্ত শক্তি এবং মুক্তিচেতনার বিরোধী শক্তি সমগ্র আন্দোলনে ঢুকে তাকে হিংসা ও অরাজকতার দিকে ঠেলে দিতে পারত না। তেমনি ছাত্র আন্দোলন গণআন্দোলনের চেহারা নিয়ে গণঅভ্যুত্থানের পরিস্থিতি তৈরি করতে পারত না।
হাসিনার বিদায়ে মৌলবাদের আস্ফালন বাড়বে। বাংলাদেশ আর একটি পাকিস্তান বা আফগানিস্তান হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হবে। মুক্তি যুদ্ধের চেতনাকে ম্লান করে ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের বিদায় ঘণ্টা বাজতে পারে। বাংলাদেশ যদি সেই পথে হাঁটে তাহলে ভারতের বিপদও বাড়বে। সেখানে মুসলিম মৌলবাদের আস্ফালন ভারতের হিন্দু মৌলবাদকে পুষ্টি জোগাবে। ভারতের সংখ্যালঘুদের জীবন-জীবিকা বিপন্ন ও দুর্বিষহ হয়ে উঠবে।
Editorial
ঘোর অনিশ্চয়তার পথে বাংলাদেশ
×
Comments :0