সেখ সাইদুল হক
কেন্দ্রীয় সরকার ওয়াকফ আইনের নাম পরিবর্তন করে ১৯৯৫ সালের ওয়াকফ আইনের উপর ৪০টি বেশি সংশোধনী এনে গত ৮ আগস্ট সংসদে উপস্থাপিত করেছিল। যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। যেখানে ক্ষমতার জোরে বিরোধীদের মতামত খারিজ করে তাতে শিলমোহর দেওয়া হয়েছে। গত ২ এপ্রিল লোকসভায় এবং ৩ এপ্রিল রাজ্যসভায় শরিক দলগুলির সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় সরকার ওই বিল সংসদে পাশ করিয়েছে। এখন রাষ্ট্রপতির সম্মতির অপেক্ষায়। ইতিমধ্যে ওই বিলের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মানুষেরা, সংখ্যালঘুরা এবং প্রগতিশীল ছাত্র-যুব সংগঠনগুলি দেশ জুড়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। তারা দাবি তুলেছে এই সংশোধনীগুলি দেশের সংবিধানের মর্মবস্তুকে এবং ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোকে আঘাতগ্রস্ত করেছে। এই পটভূমিকায় ওই সংশোধনীগুলি কেন তা বাতিল করতে হবে সে সম্পর্কে কিছু আলোকপাত করতে চাইছি। সংশোধনীগুলি বলার আগে ওয়াকফ কি এবং আমাদের দেশে ওয়াকফ গঠন ও আইন সম্পর্কে কিছু কথা বলে নিতে চাই।
ওয়াকফ কি?
ওয়াকফ কথাটি আরবি শব্দ। অর্থ হলো ধর্মীয় বা দাতব্য বা সেবামূলক উদ্দেশ্যে কোনও কিছু বিধিবদ্ধ করা বা গচ্ছিত রাখা। তার থেকে ওয়াকফ সম্পত্তির ধারণা এসেছে। যার লক্ষ হলো আল্লাহ নামে উৎসর্গ করে কোনও সম্পত্তি মুসলিম জনসাধারণের উন্নয়নকল্পে এবং ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে নিঃশর্তে গচ্ছিত রাখা। ১৯৫৪ এবং ১৯৯৫ সালের আইনে বলা হয়েছে স্থায়ীভাবে উৎসর্গ করে এবং ইসলামী নীতি মেনে কোনও ব্যক্তি যখন তার স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি দান করেন তাদের বলা হয় ওয়াকফ। যিনি দান করবেন তাকে ঐ সম্পত্তির আইনত মালিক এবং সুস্থ মস্তিষ্কের হতে হবে। কোনও সম্পত্তি একবার ওয়াকফ হিসাবে মনোনীত করা হলে এটি আর ফেরত নেওয়া যাবে না, বিক্রি করা যাবে না, উপহার দেওয়া যাবে না বা অন্য নামে দানপত্র করা যাবে না, কিংবা উত্তরাধিকার হিসাবে সন্তান-সন্ততিরা পাবে না। এসবই সাধারণ ওয়াকফের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ওয়াকফ করা যায় যা পারিবারিক গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ। এগুলিকে বলা হয় ওয়াকফ-উলাল-আওলাদ।
এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, প্রথম ওয়াকফ গঠন হয় হজরত মহম্মদের জীবদ্দশায় এবং তাঁর পরামর্শে। মুখাই-রিক নামে একজন ইহুদি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হজরত মহম্মদকে ৭ টি ফলের বাগান দান করতে চাইলে হজরত মহম্মদ তাঁকে পরামর্শ দেন ওয়াকফ তৈরি করে ঐ সম্পত্তি আল্লাহর নামে উৎসর্গ করে ইসলামের সেবায় ব্যবহার করতে। আব্দুল্লাহ বিন ওমর খাইবার এলাকায় তার একটি বড় সম্পত্তি হজরত মহম্মদকে দান করতে চাইলে, তিনি তাঁকে ওয়াকফ গঠন করে ইসলামী জনগণের সেবার ব্যবহার করতে বলেন। এইভাবেই বিভিন্ন দেশে দেশে ওয়াকফ গঠিত হয়েছে।
ভারতে ওয়াকফ গঠন ও আইন রচনা–
ভারতে ওয়াকফ গঠিত হয় মধ্যযুগে ইসলামের আগমনের পরে। সুলতানি আমলে, মুঘল আমলে দিল্লি, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাবে, মুলতানে, নিজামশাহের আমলে অবিভক্ত অন্ধ্রে, নবাব শাহী আমলে বাংলায় এবং অন্যান্য রাজ্যে বহু ওয়াকফ সম্পত্তি গঠিত হয়। এইসব ওয়াকফ সম্পত্তি ব্যবহৃত হতো দাতব্যমূলক কাজে এবং মুসলমান জনগণের সেবায়। ঐ অর্থে তৈরি করা হতো মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কবরখানা এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্র নির্মাণ। সেই ধারা এখনো অব্যাহত।
ভারতে ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা এবং পরিমাণ নিয়ে নির্দিষ্ট কোনও তথ্য নেই। কেননা দেশে সে ধরনের বিজ্ঞানসম্মত কোনও সমীক্ষা হয়নি। আন রেজিস্টার্ড বহু ওয়াকফ আছে। তবে সাধারণভাবে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিল সূত্রে জানা যায় সারা দেশে কমবেশি ৮ লক্ষ ৭০ হাজার ওয়াকফ সম্পত্তি আছে এবং সেগুলিতে মোট জমির পরিমাণ ৯ লক্ষ ৪০ হাজার একরের মতো। এর বাজার মূল্য ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। ওয়াকফ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম অব ইন্ডিয়ার তথ্য অনুযায়ী দেশের স্থায়ী সম্পদ বিশিষ্ট ওয়াকফের সংখ্যা ৮ লক্ষ ৭২ হাজার ৩২৮ টি এবং অস্থায়ী সম্পদ বিশিষ্ট ওয়াকফ সংখ্যা হলো ১৬,৭১৩ টি। এর মধ্যে ডিজিটাল রেকর্ডভুক্ত করা সম্ভব সম্ভব হয়েছে ৩ লক্ষ ২৯ হাজার ৯৯৫ টি ওয়াকফের। পশ্চিমবাংলায় ১ লক্ষের বেশি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। যার মধ্যে রেকর্ড ভুক্ত ৮০ হাজারেরও বেশি। যেটা বাম আমলে হয়েছিল। দেখা যাচ্ছে দেশে প্রতিরক্ষা ও রেল দপ্তরের পরে সবচেয়ে বড় জমির মালিকানা হলো ওয়াকফ সম্পত্তি। সেই সম্পত্তিতে এখন নজর পড়েছে কর্পোরেটর মালিকদের। এবং তাদের সেবক হলেন মোদী। পশ্চিমবাংলা সহ বহু রাজ্যে ওয়াকফ সম্পত্তিতে অবৈধ দখলদারি হয়েছে কিংবা বেআইনিভাবে বিক্রি হয়েছে। কোথাও সরকার নিজেই ওয়াকফ সম্পত্তি বিক্রি করেছে বা লিজ দিয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ অন্ধ্র প্রদেশে চন্দ্রবাবু নাইডু এবং ওয়াই এস রেড্ডি সরকার, দরগা হোসেন শাহ আলির ওয়াকফ সম্পত্তি বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থাকে স্বল্পমূল্যে লিজ দিয়েছে। দিল্লিতে এবং উত্তরাখণ্ডে একই কাজ হয়েছে। মোদী সরকার কর্পোরেট তোষণ এবং সাম্প্রদায়িক বিভাজনের মিশেল বানিয়ে সরকার চালাচ্ছে। সেই লক্ষ্য পূরণেই ওয়াকফ আইন সংশোধনী বিল এনেছেন।
ইসলামী নীতিতে ওয়াকফ পরিচালিত হতো। পরে ওয়াকফের ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যে হস্তক্ষেপ না করে ওয়াকফ সম্পত্তির ব্যবহারের ও কাজের মধ্যে স্বচ্ছতা আনতে ব্রিটিশ শাসকেরা ১৯৩২ সালে প্রথম নির্দিষ্টভাবে মুসলমান ওয়াকফ আইন তৈরি করে। দেশ স্বাধীন হলে ভারত সরকার ঐ আইনের পরিবর্তন ঘটিয়ে ১৯৫৪ সালে ওয়াকফ আইন তৈরি করে। পরে ১৯৫৯, ১৯৬৪, ১৯৬৯, ১৯৮৪ সালে কিছু কিছু সংশোধন করা হয়। পরে যৌথ সংসদীয় কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯৯৫ সালে নতুন ভাবে ওয়াকফ আইন তৈরি করে। বর্তমানে এই আইনকেই প্রিন্সিপাল আইন বলা হয়। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার সংসদীয় সিলেক্ট কমিটির সুপারিশের উপর ভিত্তি করে ওই আইনের বেশ কিছু সংশোধনী যুক্ত করে। ১৯৫৪ এবং ১৯৯৫ সালের আইনের ভিত্তিতেই রাজ্যে রাজ্যে ওয়াকফ বোর্ড গঠিত হয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ১৯৯৫ সালের আইনের উপর ৪০টির বেশি সংশোধনী এনেছে।
বর্তমান সংশোধনীগুলিতে কি আছে -
এবার আমরা আলোচনা করব কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের ২০২৪ সালের মূল সংশোধনীগুলিতে কি আছে এবং কেন তা বাতিল চাইছি।
১) সংশোধনীতে বলা হয়েছে ওয়াকফ আইন WAQF Act কথাটির পরিবর্তে এই আইনটির নাম হবে ''Unified Wakf Management, Empowerment, Efficiency and Development Act''। বিলের ১৩(২এ) অংশে বলা হয়েছে বোহরা সম্প্রদায় এবং আফগানি সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব রাখতে পৃথক পৃথক বোর্ড করা হবে। অর্থাৎ বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গি হতে মুসিলম জনসাধারণকে ভাগ করতে চাওয়া হয়েছে। বর্তমান বোর্ডগুলি সমগ্র মুসলিম জনগোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের উন্নয়নে কাজ করে।
২) ওয়াকফ বোর্ডগুলি তদারকি করে রাজ্য সরকার। এই বিল প্রণয়নের সময়ে কেন্দ্র সরকার রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে আলোচনা করেনি। কৃষিনীতি (বর্তমানে বাতিল), শ্রমনীতি, এমন কি শিক্ষা নীতি রচনায় কেন্দ্র একই পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। মোদীর এই পদক্ষেপে রাজ্যগুলির ক্ষমতাকে খর্ব করেছে।
৩) বিলে বলা হয়েছে ৫ বছর ধরে ইসলাম ধর্ম পালন করছেন কেবল এমন ব্যক্তিই ওয়াকফ সম্পত্তি দান করতে পারেন। ১৯৯৫ সালের আইনে বলা ছিল যে কোনও ব্যক্তি তা করতে পারেন। এটা তার সাংবিধানিক অধিকার। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ হতে সেই অধিকারকে খর্ব করতে চাওয়া হয়েছে যাতে অমুসলিমরা কেউ ওয়াকফে সম্পত্তি দান না করেন।
৪) ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে ওয়াকফ বোর্ড সমীক্ষা করে ঠিক করতে পারবে কোনটা ওয়াকফ সম্পত্তি। প্রস্তাবিত বিলে সেই সংস্থান তুলে দিয়ে বোর্ডের ক্ষমতা খর্ব করে জেলাশাসকদের হাতে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। জেলাশাসকেরা সরকারী সম্পত্তিরও রক্ষক। সরকার কোনও ওয়াকফ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করলে জেলাশাসক কোন দিকে দাঁড়াবেন? বিলে আরও বলা হয়েছে যে কোনও ওয়াকফ সম্পত্তির নথি সহ রেজিষ্ট্রকরণ বাধ্যতামূলক এবং তা করতে হবে জেলাশাসকের কাছে। কেন এটা হবে? মৌখিক অনুমতির ভিত্তিতে বহু ওয়াকফ তৈরি (Wakf by use) হয়েছে এবং তা লাগু আছে। সেগুলির তাহলে কি হবে?
৫) বিলে বলা হয়েছে কোনও ওয়াকফ সম্পত্তি সরকারের অধীনে থাকলে তা আর ওয়াকফ সম্পত্তি থাকবে না। তা কেন হবে? মালিকানা কেন ওয়াকফ হারাবে? বরং সরকারের দেখা উচিত যেসব সরকারি সম্পত্তির মালিকানা ওয়াকফের নামে আছে অথচ সরকার ভোগ করছে তার মধ্যে যেগুলি ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব তা দিতে হবে।
৬) ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে ওয়াকফ সম্পত্তি সার্ভে করার জন্য ওয়াকফ বোর্ড সার্ভে কমিশনার, অতিরিক্ত সার্ভে কমিশনার নিযুক্ত করবে। বর্তমান বিলে বলা হয়েছে জেলা শাসক সে কাজ করবেন। ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতাকে খর্ব করে জেলাশাসকের মাধ্যমে কেন্দ্র ওয়াকফ সম্পত্তির ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ চাপাতে চাইছে।
৭) বিলে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলে দু’জন মহিলা সদস্য থাকবেন। অথচ ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে ''at least two women members'' অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের আইনে দুইয়ের বেশি থাকারও সুযোগ রাখা ছিল। এখন বলা হচ্ছে দু’জন থাকবেন। এটা কেন?
৮) ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে কেন্দ্রীয় ওয়াকফ কাউন্সিলের সদস্যরা মুসলিম সম্প্রদায়ের হবেন। অথচ বিলে বলা হয়েছে ঐ কাউন্সিলে অন্তন্ত দু’জন অমুসলিম থাকবেন। কেন? ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য? নাকি ওয়াকফ কাউন্সিলের সংখ্যালঘু চরিত্র ধীরে ধীরে বাতিল করার জন্য। যদি ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্য হয় তাহলে রামমন্দির ট্রাস্ট বডিতে কিংবা অন্যান্য মন্দির ট্রাস্ট বডিতে ২ জন মুসলিম রাখা হবে তো?
৯) ১৯৯৫ আইনে বলা ছিল ওয়াকফ সম্পত্তি বিষয়ে যে সব ট্রাইবুনাল গঠিত হবে সেখানে মুসলিম আইন সম্পর্কে দক্ষতা আছে এমন ব্যক্তিকে রাখতেই হবে। বিলে এই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হয়েছে। লক্ষ্যটা কি বুঝতে অসুবিধা হয় না।
১০) পূর্বের আইন মোতাবেক রাজ্য সরকার ওয়াকফ বোর্ডের সদস্য হিসাবে সাংসদ ও বিধায়ক ক্ষেত্র হতে মুসলিম সাংসদ ও বিধায়কদের মধ্য হতে মনোনীত করতো। বর্তমানে বিলে বলা হয়েছে মুসলিম হতে হবে এমন নয়, যে কোন সাংসদ, বিধায়ক থাকতে পারবেন। মন্দির ট্রাস্ট বডিতে এই ফর্মুলা মানা হবে তো?
১১) ১৯৯৫ সালের আইনে বলা আছে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ তৈরি হলে রাজ্য সরকারগুলি ওয়াকফ ট্রাইবুনাল তৈরি করবে এবং ৭(১) ধারায় বলা আছে সেই ট্রাইব্যুনালের রায় চূড়ান্ত। বর্তমান বিলে ৭(১) ধারাকে তুলে দেওয়া হয়েছে। ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলাশাসকদের। এটা কেন হবে?
১২) বিলে বলা হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার রেজিস্ট্রিকৃত ওয়াকফ সম্পত্তির হিসাব পরীক্ষা করার বিষয়ে আইন প্রণয়ন করতে পারবে। ১৯৯৫ সালের আইনে ওয়াকফ বোর্ড এবং রাজ্য সরকার এই কাজ করতো। এটা রাজ্য সরকারের কাজের উপর এবং ওয়াকফ বোর্ডগুলির ক্ষমতার উপর সরাসরি হস্তক্ষেপ।
কেন এই সংশোধনীগুলি সংবিধান বিরোধী–
প্রস্তাবিত সংশোধনীগুলি সংবিধান প্রদত্ত ধর্মীয় স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারকে লঙ্ঘন করেছে। সংবিধানের এই বিলে ওয়াকফ সম্পত্তি ও তার পরিচালনায় মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার কেড়ে নিতে চাওয়া হয়েছে। যা লঙ্ঘন করেছে সংবিধানের ২৫ নং ধারাকে। ওয়াকফ বোর্ড এবং ওয়াকফ কাউন্সিলে অমুসলমিল সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির যে ব্যবস্থা করা হয়েছে এই বিলে তা সংবিধানের ১৪ ও ১৫ ধারাকে লঙ্ঘন করেছে। ৫ বছর ইসলাম ধর্ম পালন করছেন এমন ব্যক্তিই দান করতে পারবেন। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘুদের নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় প্রমাণ করতে বাধ্য করার যে ব্যবস্থা করা হয়েছে তা সংবিধানের ২৬ ধারার পরিপন্থী। ঐ ধারায় দেশের প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীকে নিজস্ব ধর্মীয় বিষয়গুলি পরিচালনার অধিকার দেওয়া হয়েছে।
সরকারের যুক্তি এবং যুক্তির অসাড়তা–
সরকার দাবি করছে গরিব সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে নাকি ওয়াকফ সংশোধনী বিল আনা হয়েছে। এর চেয়ে হাস্যকর আর কি হতে পারে? বর্তমান মোদী সরকার গোরক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের নিশানা বানিয়েছে। নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে। অভিবাসন আইন তৈরি করেছে। উপাসনাস্থল আইনকে নস্যাবৎ করে সংখ্যালঘুদের নিশানা বানিয়েছে। আর তারাই কিনা দাবি করছে গরিব সংখ্যালঘুদের উন্নয়নের লক্ষ্যে এই সংশোধনী বিল। সঙ্ঘ সেবকদের হাতে একলাখ, পেহেলু খাঁ, জুনেদ, আফজারুল সহ আরও অনেকে খুন হয়েছেন। এরা কি গরিব সংখ্যালঘু ছিল না? খুনিদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? সরকার দাবি করছে ওয়াকফ সম্পত্তি হতে আয় বাড়িয়ে মুসলিম সমাজে মহিলা ও শিশুদের উন্নয়নের জন্য নাকি এই আইন আনা হয়েছে। এটাও হাস্যকর যুক্তি। বিলকিশ বানুর ধর্ষণকারীদের ও তার সন্তানদের হত্যাকারীদের মুক্তি দিতে যে সরকার উদ্যোগী হয়েছিল তাদের মুখে এই কথা কি মানায়? বরং ওয়াকফ সম্পত্তিকে রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য, দখল মুক্ত করার জন্য এই সব ভনিতা না করে ভালো হতো যদি কেন্দ্রীয় সরকার ২০০২ সালে জয়পুরে অনুষ্ঠিত ওয়াকফ সম্মেলনের সুপারিশগুলি কার্যকর করতো। এই প্রসঙ্গে সাচার রিপোর্টের কিছু কথা উল্লেখ করা যায়, যেখানে বলা হয়েছে যে বেদখল হওয়া ওয়াকফ সম্পত্তির পুনরুদ্ধারের জন্য পাবলিক প্রেমিসেস এভিকশন অ্যাক্ট চালু হওয়া দরকার। ওয়াকফ নিয়ে কমবেশি সব মুসলিমদের উদ্বেগ ও স্পর্শকাতরতা আছে। তাই রাজ্য সরকার এবং সংখ্যালঘু প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে কেন্দ্রীয় স্তরে National Wakf Development Corporation এবং রাজ্যস্তরে State Corporation গঠন করা উচিত
আমাদের দাবি ও করণীয় কাজ–
তাই আমাদের দাবি এই বিল বাতিল করতে হবে এবং ওয়াকফ বোর্ড এবং ওয়াকফ কাউন্সিলে মুসলিম আইন সম্পর্কে জ্ঞান আছে কেবল এমন ব্যক্তিদের বা অফিসারদের বসানো উচিত। ওয়াকফ সম্পত্তি সংখ্যালঘু জনগণের উন্নয়নেই ব্যবহার করা দরকার। ওয়াকফ বিল বাতিলের দাবিতে আদালতে যাওয়া উচিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইতিমধ্যেই সুপ্রিম কোর্টে এই বিষয়ে দুটি মামলা রুজু হয়েছে। পাশাপাশি ওয়াকফ সংশোধনীগুলির বিরুদ্ধে কেবল মুসলিমদেরই রাস্তায় নামলে হবে না, কেননা সেক্ষেত্রে সঙ্ঘ পরিবার চাইবে মুসলিম বিরোধী হিন্দুত্ববাদী জিগিরকে আরও তীব্র করতে। তাই সব অংশের ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষকে জোটবদ্ধ করে পথে নেমে এই বিল বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হতে হবে।
Comments :0