তিনি বলেন, ‘‘কেউ জানে না কোথা থেকে কি পাওয়া গিয়েছে। হয়তো ওরাই গাড়ি থেকে নিয়ে এসে দেখিয়েছে। কোনও প্রমাণ নেই।’’
বগটুইয়ের পর মুখ্যমন্ত্রী নিজে বলেছিলেন সব বেআইনি অস্ত্র উদ্ধার করতে হবে। শুক্রবারের ঘটনা প্রমান করে দিয়েছে তার মুখের কথা আর কাজে কোন মিল নেই। কি করে প্রশাসনের নজর এড়িয়ে বিপুল এই অস্ত্র মজুত হলো সেই নিয়ে কোন কথা বললেন মুখ্যমন্ত্রী। বললেন না যারা এর সাথে যুক্ত তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তিনি দলনেত্রীর ভূমিকা পালন করলেন অপরাধীদের আড়াল করতে।
শুক্রবার এই প্রসঙ্গে তৃণমূল নেতা তথা ব্যারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী পার্থ ভৌমিক বলেন, শেখ শাহজাহানকে যেহেতু দল সাসপেন্ড করেছে তাই তার বিষয় দল কোন কথা বলবে না। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের কাছে শাসক দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ জানানো হয়েছে যে পরিকল্পিত ভাবে দ্বিতীয় দফার ভোটের দিন এই তল্লাসি করা হয়েছে নির্বাচন প্রভাবিত করার জন্য। তারা কমিশনের কাছে আরও দাবি করেছে যাতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারি সংস্থার গতিবিধির ওপর তারা নিয়ন্ত্রণ আনে।
মমতা ব্যানার্জির স্নেহধন্য শেখ শাহজাহানকে বাঁচাতে কোটি টাকা খরচ করে যখন সরকার সুপ্রিম কোর্টের দরজায়, সেই সময়েই শাহজাহান-ঘনিষ্ঠ তৃণমূল কর্মীর বন্ধ, পরিত্যক্ত বাড়িতে মিলল আস্ত এক অস্ত্রভাণ্ডারের খোঁজ। কী নেই সেই ভাণ্ডারে? শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত একদিকে সিবিআই, অন্যদিকে এনএসজি-সিআরপিএফ’র যৌথ তল্লাশি অভিযানে ইজরায়েলে তৈরি অত্যাধুনিক রোবটিক ডিভাইসও নামানো হলো ময়দানে। সাম্প্রতিক অতীতে এমন দৃশ্য এই রাজ্যের মানুষ দেখেননি।
ধৃত শাহজাহানের পেল্লাই রাজপ্রাসাদ থেকে কয়েকশো মিটার দূরের মাছের ভেড়িবেষ্টিত গ্রামে, শাহজাহান-ঘনিষ্ঠ পঞ্চায়েত সদস্য হাফিজুল খানের আত্মীয় তৃণমূল কর্মী আবু তালেব মোল্লার বাড়ির মেঝে খুঁড়ে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র আর বিস্ফোরকের পরিমাণ দেখে তাজ্জব হয়ে গিয়েছেন তল্লাশীকারীরাও। রাতে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র তরফে প্রেস বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়, এখনও পর্যন্ত আবু তালেব মোল্লার বাড়ির মেঝে খুঁড়ে উদ্ধার হয়েছে ৩টি বিদেশি রিভলবার, ১টি দেশি রিভলবার, ১টি পুলিশের রিভলবার, ১টি বিদেশি পিস্তল, ১টি দেশি পিস্তল, ১২০টি নাইন এমএম বুলেট, ৫০টি ৪৫ ক্যালিবর কার্তুজ, ১২০টি নাইন এমএম কার্তুজ, ৫০টি ০.৩৮০ কার্তুজ, ৮টি ০.৩২ কার্তুজ। অর্থাৎ মোট ২২৮টি কার্তুজ, ১২০টি বুলেট এবং দেশি ও বিদেশি মিলিয়ে ৭টি পিস্তল ও রিভলবার। শুধু তা নয়, বিপুল পরিমাণে দেশি বোমা এবং বোমা তৈরির মশলাও উদ্ধার হয়েছে।
শুক্রবার প্রথমেই তদন্তকারীরা শেখ শাহজাহানের অতি ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা হাফিজুল খানের আত্মীয় তৃণমূল কর্মী আবু তালেব মোল্লার বাড়িতে যায়। মূল রাস্তা থেকে প্রায় ২০০ মিটার ভিতরে মাছের ভেড়িবেষ্টিত বাড়িটি। সেখানে যাওয়ার একটিই সরু ইট পাতা রাস্তা রয়েছে। বাড়িটি ছিল তালাবন্ধ এবং বিদ্যুৎহীন অবস্থায়। সিবিআই’র আধিকারিকরা সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ বিভাগে খবর পাঠান। দ্রুততার সঙ্গে বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যবস্থা করার পর তালা ভেঙে ঘরে ঢোকেন তদন্তকারীরা। এরপরে শুরু হয় ঘরের মেঝে খোঁড়ার কাজ। উদ্ধার হয় দেশি, বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র সহ বিপুল কার্তুজ, বোমার ভাণ্ডার। বাড়িটি সিআরপিএফ’র অফিসার ও জওয়ানরা ঘিরে ফেলেন। এরপর মেটাল ডিটেকটর দিয়ে মেছোঘেরির আশপাশে খোঁজ শুরু হয়। আনা হয় স্থানীয় নির্মাণ শ্রমিকদের। আবু তালেবের বাড়ির আশপাশে খোঁড়ার কাজ শুরু হয়। ইতিমধ্যে বিকাল ৪টে ১০ মিনিট নাগাদ এনএসজি’র কমান্ডোদের বিশাল বাহিনী ঘটনাস্থলে আসে। তাঁরা একে একে আবু তালেবের ঘরে প্রবেশ করতে থাকেন। উদ্ধার হয় একটি বাক্স।
কেন এনএসজি-কে খবর দিয়ে আনতে হলো সিবিআই-কে? তবে কি বাক্সের ভিতরে মারাত্মক বিস্ফোরক কিছু রাখা আছে? এনএসজি’র বাহিনীর মূলত দু’টি ভাগ। একটি এনএসজি কমব্যাট ফোর্স, আরেকটি বম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। সন্দেশখালিতে এনএসজির বম্ব ডিসপোজাল এবং ডিটেকশন স্কোয়াডকে নিয়ে আসা হয়। তল্লাশিতে আনা হয়েছিল স্নিফার ডগ, আনা হয়েছিল মাইন ডিটেক্টরও। নামানো হয় রোবটিক ডিভাইস। অত্যাধুনিক এই ডিভাইস যে সরবেড়িয়ার মতো গ্রামের ইট বিছানো রাস্তাতেও ঘুরে বেড়াতে পারে, এই দৃশ্য দেখতে হয়েছে সন্দেশখালির বাসিন্দাদের। এনএসজি সাধারণের প্রবেশ নিষেধ করে দেয়। সিবিআই আধিকারিক ও জওয়ানদের এবং তাঁদের ব্যবহৃত গাড়ি সরিয়ে দিয়ে গোটা এলাকার দখল নেয়। রোবট প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়।
গ্রামের আশপাশের বাড়ি খালি করে দেওয়া হয়। বাড়ির ভিতরে এবং আশেপাশে বিস্ফোরক লুকানো আছে কি না বা কীভাবে সেগুলিকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, তার তৎপরতা শুরু হয়।
আবু তালেবের বাড়ির উঠোনে মাটির ঘর আছে। সেখানে বিস্ফোরক থাকতে পারে আশঙ্কা করে মাটির ঘরে ঢোকানো হয় রোবট। আধ ঘন্টা পর রোবটটি একটি ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে আসে। সমস্ত বিষয়টি ক্যামেরাবন্দি করেন এনএসজি’র কম্যান্ডোরা। সাংবাদিক সহ সবাইকে নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে বলা হয়। সেখানে বালির বস্তা নিয়ে আসা হয় বিস্ফোরক থাকার আশঙ্কায়। বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করার জন্য দূরে একটি বাড়িতে এনএসজি’র কমান্ডোরা আশ্রয় নেন। রিমোট চালিত রোবট ব্যাগটিকে ৪০০-৪৫০ মিটার দূরে রেখে ফিরে যায়। সন্ধ্যার দিকে বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয় করা হয়। তবে তদন্তকারীরা রাত পর্যন্ত সেখানে রয়েছেন।
তবে কি আরও কোনও ঠিকানায় হতে পারে অস্ত্রভাণ্ডারের খোঁজে তল্লাশি? গত ৫ জানুয়ারির হামলার ঘটনা কি এই অস্ত্রভাণ্ডার লুকানোর জন্যই? শাহজাহানহীন সন্দেশখালিতে ভোটের সময়ে ব্যবহারের জন্যই কি এই অস্ত্র, বোমা রাখা হয়েছিল? উঠছে একাধিক প্রশ্ন। তবে শাসক দল বা প্রশাসনের তরফে এই নিয়ে শুক্রবার রাত পর্যন্ত সেভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেওয়া হয়নি।
Comments :0