Post editorial

আর জি করের লড়াই অনন্য কেন?

উত্তর সম্পাদকীয়​

বৃন্দা কারাত


ধর্ষণে আক্রান্তদের জন্য বিচারের লড়াইতে সাধারণভাবে আমাদের যে অভিজ্ঞতা, আর জি করের ঘটনাটি তার তুলনায় বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যে অনন্য। রাজনৈতিক পক্ষপাত নির্বিশেষে গোটা দেশে সাধারণ মানুষের এমন প্রতিক্রিয়া শেষ দেখা গিয়েছিল ২০১২ সালে, দিল্লির নির্ভয়া’র ঘটনায়। ইতিমধ্যে ধারাবাহিকভাবে চলা যৌন হেনস্থার বিরুদ্ধে মহিলা কুস্তি খেলোয়াড়দের লড়াইতে দেশজুড়ে সমর্থন তৈরি হয়েছিল। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি এর থেকে আলাদা। ধর্ষণ ও খুনের যে ভয়ঙ্কর ঘটনার আড়াই মাস পরেও জনমানসে এর বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া বজায় রয়েছে, তা এককথায় অসাধারণ ও অনন্য। এই লড়াইয়ের ভিত ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে এবং এতে মানুষের অংশগ্রহণ অনেকটাই স্বতঃস্ফূর্ত। বিস্তৃত বলতে আমি সামাজিক অর্থে বলতে চাইছি। এই আন্দোলন শহরকেন্দ্রিক এবং এতে অংশগ্রহণ মূলত মধ্যবিত্তের হওয়া সত্ত্বেও সমাজের অন্যান্য অংশের মানুষের উপরেও তার গভীর প্রভাব পড়েছে, লড়াই ক্রমশ গ্রামীণ এলাকায় ছড়িয়েছে। এই লড়াইতে মহিলাদের এবং ছাত্র-যুব সমাজের অংশগ্রহণ উল্লেখযোগ্য। এক স্বতস্ফূর্ত সংগ্রাম হিসাবেই একে বিবেচনা করা যায়। 
এমন আন্দোলন কেন এবং কীভাবে সংগঠিত হলো? তৃণমূল কংগ্রেসের একজন সাংসদ জহর সরকার এই ঘটনার প্রেক্ষিতে পদত্যাগ করেছেন। তিনি নিজেই নিজের দলের বিরুদ্ধে ভয়ঙ্কর অভিযোগ জানিয়েছেন। তাঁর কৌশলি ব্যাখ্যা এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন অভয়ার (নির্যাতিতার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত নাম) বিচারের দাবিতে যতটা সোচ্চার, রাজ্য সরকারেরও বিরুদ্ধেও ততটাই নির্দিষ্ট। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা সহ সার্বিক দুর্নীতি এবং দলের একাংশের নেতৃত্ব যেভাবে দোর্দণ্ডপ্রতাপ ও প্রভাবশালী হয়ে উঠেছে, তাকেই তিনি জনরোষের অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। 
প্রভাবশালী রাজনীতি ও যৌন নিপীড়নের আন্তঃসম্পর্ক
জহর সরকার গণবিক্ষোভের পিছনে কারণ হিসাবে যা যা উল্লেখ করেছেন তার মধ্যে দিয়েই অনেক কিছু বোঝা যায়। গত দশ বছর যাবত দুর্নীতি ও প্রভাবশালীদের রাজনীতির সাথে মহিলাদের যৌন নিপীড়নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে। একদিকে দুর্নীতি আরেক দিকে প্রভাবশালী, এই দু’টিই দুর্বৃত্তায়নের সাথে সরাসরি যুক্ত। রাজ্য জুড়ে তৃণমূলের নেতা নেত্রীরা যত বেশি দুর্বৃত্তদের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছে, মহিলারা বিশেষ করে কমবয়সি মেয়েদের নিরাপত্তা ততই বিপদসঙ্কুল হয়েছে। প্রভাবশালী রাজনীতির মধ্যেই যৌন নিপীড়নের অনুষঙ্গ থাকে। এক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই ঘটেছে। এই রাজনীতির প্রথম শিকার হয়েছে বামপন্থীরা। তখনও বামপন্থী দলগুলির মহিলা কর্মী সমর্থকরাই ছিলেন আক্রমণের বিশেষ লক্ষ্য। ঐ সময় একজন তৃণমূল সাংসদ প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, তার বাহিনী মহিলা সিপিআই(এম) কর্মীদের ধর্ষণ করবে। এভাবেই অত্যাচার চালানোর লাইসেন্স দেওয়া হলো এবং সরকারের পক্ষ থেকে অত্যাচারীদের পাশে থাকার বার্তাও গেল। কিন্তু ব্যাপারটা শুধু বিরোধী রাজনৈতিক কর্মীদের বেলাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। আর জি করের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিটির বিরুদ্ধে অনেক আগেই থানায় অভিযোগ ছিল যে, সে নিজের সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর উপরে ভয়াবহ অত্যাচার করত। এমন রেকর্ড থাকা ব্যক্তিকেই পুলিশের তরফে সিভিক ভলান্টিয়ারের কাজে যুক্ত করে হাসপাতালের সর্বত্র ঘুরে বেড়ানোর অধিকার দেওয়া হলো। কেন? 
আগে জনসমক্ষে মহিলাদের যৌন নিপীড়নের ঘটনায় পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ মানুষই প্রতিরোধের কাজে এগিয়ে যেতেন। এহেন বিবেকের তাড়না এখনও মানুষের মধ্যে রয়েছে, কিন্তু আজকের পরিস্থিতিতে যেভাবে গুন্ডাদের রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা সমর্থন ও ব্যবহার করছে, সেটাই আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে। আজও পশ্চিমবঙ্গে নিপীড়নের ঘটনার প্রতিবাদে সংগঠিত মানুষকে সমর্থনের বদলে আক্রমণ, হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে। এমন পরিবেশেই দুর্বৃত্তরা ফুলেফেঁপে ওঠে। 
যৌন নিপীড়নের একের পর এক ঘটনায় দেখা যাচ্ছে যারা নিপীড়নের শিকার তাদের বা সেইসব পরিবারের সদস্যদের স্থানীয় তৃণমূল নেতারা মধ্যস্থতা করে ঝামেলা মিটিয়ে নেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছে, বাধ্য করেছে। অনেকক্ষেত্রে অভিযুক্ত কিংবা অপরাধীদের সাথে সরাসরি তৃণমূলের যোগাযোগ রয়েছে। এসমস্ত ঘটনায় অপরাধীদের দায়মুক্ত করতে পুলিশ যে নির্লজ্জ ভূমিকা নিয়েছে তারই প্রভাবে মহিলাদের উপরে নিপীড়নের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে। সন্দেশখালীর ভয়াবহ ঘটনার সময় নির্যাতিতা মহিলারা থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে যিনি সংশ্লিষ্ট তৃণমূলী দুর্বৃত্তদের নেতা, তার থেকেই অনুমতি ও পরামর্শ নিতে পুলিশ বলেছিল। আর জি করের ঘটনাতে স্পষ্ট হল প্রকাশ্যে অপরাধের ঘটনা বাড়তে বাড়তে এখন সরকারি কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত তা প্রসারিত হয়েছে। কর্মরত মহিলাদের জন্য কাজের পরিবেশ হয়েছে অসহনীয়। যদি একজন সরকারি চিকিৎসক সরকারি হাসপাতালে কাজ করার সময়ই সুরক্ষা না পান, তবে আর কোন জায়গা সুরক্ষিত থাকে? 
রাজ্যজুড়ে যে বিক্ষোভের পরিস্থিতি তাতে মহিলাদের এমন স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণ কি? তিলোত্তমার (নির্যাতিতার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত আরেকটি নাম) মধ্যে তাঁরা নিজেদের খুঁজে পাচ্ছেন, নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে নিতে চাইছেন কিংবা নিজের পরিচিত কারও অভিজ্ঞতার কথা মনে পড়ছে তাঁদের। আমিই সে, সেই মেয়েটিই এখন আমি কিংবা তার সাথে যা ঘটেছে তেমনটা আমার সাথেও ঘটতে পারে, এই অনুভূতিই তাদের আন্দোলনে টেনে এনেছে। এটাই এই লড়াইয়ের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। তিলোত্তমার জন্য লড়াইতে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক মহিলা নিজের জন্যও লড়াই করছেন। তাই এই রাজ্যে মহিলাদের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতার জন্যই ন্যায়বিচারের সংগ্রামে সকলে শামিল হয়েছেন। 
কোনও একক ব্যক্তির বিকৃত মানসিকতার বিষয় না
এই আন্দোলনকে কোনও একটি পার্টির অধীনস্থ রাজনৈতিক আন্দোলন বলা যায় না। কিন্তু এটি অবশ্যই একটি রাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলন। কারণ এর ভিত্তি হলো আর জি করের ঘটনা আদৌ কোনও একজনের বিকৃত মানসিকতার বিষয় নয়। এর জন্য দায়ী আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ একটা ব্যবস্থা, যা তৃণমূল জমানায় পশ্চিমবঙ্গকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এই ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের সাথে অপরাধী ও দুর্নীতিগ্রস্তদের যোগসাজশ যেভাবে উন্মোচিত হয়েছে তাতে কারোরই আর সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। ন্যায়বিচারের লড়াই এখন এই পরিস্থিতির জবাব চাইছে, উপযুক্ত শাস্তিরও দাবী জানাচ্ছে।
একটি পরিবারের মনোবল
এই আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করার অন্যতম একটি কারণ নির্যাতিতার পরিবারের ভূমিকা। বাবা মায়ের জন্য সন্তান হারানো সবসময়ই দুঃখের, আর যে পরিস্থিতিতে তাঁরা নিজেদের কন্যাকে হারিয়েছেন, তার বেদনা কোনোকিছুর সাথেই তুলনীয় নয়। ন্যায়বিচারের দাবিতে আন্দোলন যে ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে, জনমানসে এই লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন যেভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তার অন্যতম কারণ ঐ পরিবারের দৃঢ় অবস্থান। প্রথম থেকেই তাঁরা একটি প্রশ্নে অটল রয়েছেন - নিজেদের মেয়ের জন্য ন্যায়বিচার চান। পরিবারটির আত্মমর্যাদাবোধ, স্থানীয় শাসকদের বাধা, হুমকি ইত্যাদির মোকাবিলা করে তাঁদের দৃঢ় অবস্থান সকলকেই অনুপ্রাণিত করেছে। আন্তরিক সমবেদনা জানানোর জন্য কিছুদিন আগেই আমি পরিবারটির সাথে দেখা করি, তিলোত্তমার কাকীমার সাথেও আমার কথা হয়। একথা ঠিকই যে নির্যাতনের অন্যান্য ঘটনার ক্ষেত্রেও বাবা মায়েরা অসাধারণ সাহসিকতার পরিচয় রেখেছেন যেমন নির্ভয়ার বেলায় তার মা আশা দেবী করেছিলেন। এই ঘটনায় জড়িত অপরাধচক্রের সাথে রাজ্য সরকারের সরাসরি যোগাযোগ এবং দোষীদের আড়াল করতে তাদের চেষ্টা তিলোত্তমার বাবা মায়ের সামনে এক অভূতপূর্ব বাধার প্রাচীর তুলেছিল, যার বিরুদ্ধে তাঁদের লড়াই অনেক ঘটনার তুলনায় অন্য এক মাত্রায় পৌঁছেছে। 
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তরফে তাঁরা নিজেদের মেয়ের খুনের ঘটনা জানতে পারেন। সেই মুহূর্ত থেকেই তাদের লড়াই শুরু। গোটা সরকারি ব্যবস্থাটা তাঁদের ওপর ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছিল মুখ বন্ধ করার জন্য। সকাল আটটা নাগাদ নির্যাতিতার মা নিজের মেয়েকে পরপর দু’বার ফোন করেন। কথা হয়নি। তাঁর মা জানিয়েছেন যে তিনি মনে করেছিলেন, তাঁদের মেয়ে হয়ত রোগীদের নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুন হওয়ার অনেক পরে হাসপাতাল থেকে টেলিফোন মারফত তাঁদের কাছে খবর আসে। পরপর তিনবার ফোন এবং তিনবার তিন রকম কথা। প্রথমে বলা হয়, ‘এখনই আসুন, আপনাদের মেয়ে অসুস্থ’, দ্বিতীয়বার ‘আপনাদের মেয়ের শারীরিক অবস্থা সঙ্কটজনক’ এবং তৃতীয় ফোনে বলা হয়, ‘আপনাদের মেয়ে মৃত, সে আত্মহত্যা করেছে’। একবার ভাবুন, বাবা মায়ের কি মানসিক অবস্থা হয়, যাদের একঘণ্টার মধ্যে এমন ভিন্ন ভিন্ন কথা শুনতে হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর এক ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে একটি ঘরে তাঁদের বসিয়ে রাখা হয়। মেয়েকে দেখতে দেওয়া হয় না। মেয়েটির মা পুলিশের হাতে পায়ে ধরে মেয়েটিকে দেখার জন্য আর্তি জানান, অনুমতি মেলে না। পরে তাঁকে আলাদা করে (মেয়ের বাবাকে অন্যত্র রেখেই) নিজের মেয়ের মৃতদেহ দেখতে দেওয়া হয়, কিন্তু নিজের স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয় না। এই সময় তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হাসপাতালে এসে পৌঁছান। তাঁদের আবার মৃতার মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কিসের ভয় পাচ্ছিলেন? হতবাক, শোকাহত এবং অসহায় বাবা মাকে, তাঁদের নিজেদেরই পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের থেকে জোরপূর্বক আলাদা করে রাখার কি এমন প্রয়োজন ছিল?  
এরপর মৃতার বাবা মাকে ময়না তদন্তের কাগজপত্রে সই করানো হয়। তার মা চেয়েছিলেন এই ময়নাতদন্ত অন্য কোথাও হোক। কর্তব্যরত পুলিশ কর্মীদের তিনি সেকথা জানিয়েওছিলেন। একথা জানানোর পরেও পুলিশ কাগজপত্রে তাঁদের সই করতে বাধ্য করে। ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে রাখা হয়। পরিবারের কাউকে সেই অ্যাম্বুলেন্সে বসতে দেওয়া হয়নি, অথচ অযাচিতভাবে জনৈক স্থানীয় তৃণমূল কাউন্সিলর অ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার এর পাশে বসে পথনির্দেশ দিতে শুরু করেন। 
নির্যাতিতার অভিভাবকরা অন্য একটি হাসপাতালে পুনরায় ময়নাতদন্তের অনুমতি চেয়েছিলেন। তাদের সে অনুমতি দেওয়া হয়নি। স্থানীয় থানায় পৌঁছে পুনরায় ময়নাতদন্ত না হওয়া অবধি মৃতদেহের সৎকার করা উচিত হবে না বলেও তাঁরা জানান। ঐ পরিস্থিতিতে পরিবারটির এমন মনোবল অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তাঁদের আবেদন অস্বীকার করেন। হতোদ্যম হয়ে তারা বাড়ি পৌঁছে দেখেন অ্যাম্বুলেন্সটি ইতিমধ্যেই তাঁদের বাড়ির বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। 
ততক্ষণে এলাকায় বিশাল পুলিশ বাহিনী মোতায়েন হয়ে যায়। কাউকেই বাড়ির আশেপাশে ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি, ভিতরেও ঢুকতে দেওয়া হয়নি। নিজেদের বাড়ির মধ্যে মেয়ের মৃত্যুর শোকপালনের জন্য জরুরি সময়টুকুও পুলিশ তাঁদের দেয়নি। পুলিশ বলে দেয়, জরুরি সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা ইতিমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে এবং গভীর রাতে তাঁরা তাদের মেয়ের মরদেহ সৎকার করতে বাধ্য হন। এ কাজে শ্মশানের কাগজপত্রে পরিবারের অনুমতি ছাড়া স্থানীয় তৃণমূল নেতারা নিজেরাই সইসাবুদ করে দেন।
গোটা প্রক্রিয়াটাই সরাসরি আইন বিরোধী। ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় আক্রান্ত একটি পরিবারের উপর যা চলে, তা কার্যত মানবতার হত্যা। এসবই হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী ও সরকারের শীর্ষস্থানীয় আধিকারিকদের নির্দেশে। হাথরসের ঘটনার সময়ও উত্তরপ্রদেশের বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী একই কাজ করেছিলেন। তখনও পরিবারের আপত্তি সত্ত্বেও নির্যাতিতার মরদেহ জোর করে সৎকার করা হয়েছিল। এক্ষত্রেও এমনই ঘটে কারণ তৃণমূল সরকারের কিছু লুকানোর ছিল। 
সেই থেকে এখনও পর্যন্ত পরিবারটির উপর একাধিকবার নানাভাবে চাপ এসেছে, যদিও তাঁরা কোনোভাবেই আপোস করেননি এবং নিজেদের মেয়ের জন্য ন্যায়বিচারের দাবিতে অনড় রয়েছেন। তাঁদের এই মনোবলই হাজার হাজার মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। রাস্তায় ভিড় করে ‘আমরা ন্যায়বিচার চাই’ (উই ওয়ান্ট জাস্টিস) সোচ্চারে উচ্চারিত এই স্লোগানের প্রকৃত অনুপ্রেরণাও আসলে তাঁরাই। সততার সাথে, আত্মমর্যাদা বজায় রেখে, শান্ত অথচ দৃঢ় থেকে তাঁরা যে অবস্থান নিয়েছেন, তিলোত্তমার ন্যায়বিচারের দাবিতে চলা আন্দোলনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ সেটাই। জুনিয়র ডাক্তারদের তরফে পেশ করা দশ দফা দাবিসনদের প্রতিও তাঁরা সমর্থন জানিয়েছেন। মেয়েটির মায়ের বক্তব্য – ‘আমার মেয়ের মতো অন্যান্য মেয়েদের সুরক্ষা-নিরাপত্তার প্রশ্নে এসবই গুরুত্বপূর্ণ দাবি। কাজের জায়গায় অন্য কোনও মেয়েকে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হতে দেওয়া যাবে না। আমার মেয়ে মারা গেছে, কিন্তু এই দাবিগুলো পূরণ হলে অন্যরা বাঁচবে’।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ – নির্যাতিতা মেয়েটি
মেয়েটি তার বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাঁর মায়ের বক্তব্য অনুযায়ী ছোট থাকতেই, তৃতীয় বা চতুর্থ শ্রেণির সময় থেকেই সে চিকিৎসক হতে চাইত। মেয়েটির বাবা পেশায় একজন দরজি, তাঁর সামান্য উপার্জনের উপরই গোটা পরিবারটি নির্ভরশীল ছিল। এখনও পরিবারটির স্কুল ইউনিফর্ম সেলাইয়ের একটি ছোট ব্যবসা রয়েছে। আর্থিক অনটনের মধ্যে থেকেই মেয়েটি নিজের অধ্যবসায়ের জোরে স্থানীয় বাংলা মাধ্যম স্কুলে পাঠ শেষে, ডাক্তারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিল। উদয়াস্ত পরিশ্রম করেই পরিবারটি নিজেদের মেয়ের চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে সফল হয়েছিল। প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথমবারের চেষ্টাতেই সে উত্তীর্ণ হয়, কল্যাণী মেডিক্যা ল কলেজে ভর্তি হয়। এমবিবিএস কোর্সে ভর্তি হওয়ার প্রথম দিনটি সেই পরিবারের জন্য ছিল সবচেয়ে আনন্দের দিন। পালমোনোলোজি বিভাগে নিজের স্পেশাল পেপার সহ মেয়েটি তার এমবিবিএস ডিগ্রী অর্জন করেছিল। 
ঐ সময়ই কোভিড মহামারী ছড়িয়ে পড়ে। এমবিবিএস পাশ করে আর জি কর কলেজে যুক্ত হওয়ার পর দু’বছর মেয়েটি কোভিড আক্রান্তদের চিকিৎসায় নিজেকে সম্পূর্ণরূপে নিয়োজিত করেছিল। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তাঁর মা উল্লেখ করেছেন, কোনও রোগী মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে সে নিজে গাড়ি চালিয়ে রোগীর সঙ্গে দেখা করত এবং তাঁকে সাহস জোগাত। তিনবার সে নিজেই কোভিড আক্রান্ত হয়েছিল। রোগীর প্রতি দায়বদ্ধ ও আন্তরিক হওয়ার কারণেই এটা ঘটেছিল। পরিবারটির সাথে আমার দেখা করতে যাওয়ার ঠিক আগের দিনই আর জি করে জুনিয়র চিকিৎসক হিসাবে কর্মরত তিলোত্তমার অধীনে ভর্তি থাকা এক অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তি অনেক দূর থেকে তাঁর মায়ের কাছে সমবেদনা জানাতে এসেছিলেন। মেয়েটির মৃত্যুর পর থেকে গত দুই মাসে অনেক রোগী তাঁর বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং মৃতা চিকিৎসকের প্রতি নিজেদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেছেন। মৃতার সহকর্মী চিকিৎসকরাও তাঁদের জানিয়েছেন যে, তিলোত্তমা রোগীদের স্বার্থে অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রম করত, অসুস্থদের যথাযথ সেবার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় নিজের কাজের সময়ও সে অনেকটা বাড়িয়ে নিয়েছিল। 
অসুস্থ ও রোগীদের প্রতি নিবেদিত প্রাণ এমন এক তরুণী চিকিৎসককে নৃশংসভাবে ধর্ষণ ও খুন করা হলো। দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থা ও প্রাতিষ্ঠানিক অপরাধের শিকার হতে হলো তাঁকে। 
আজকের পরিস্থিতিতে উত্তাল গণআন্দোলনের প্রধান দবিই হলো তিলোত্তমার জন্য ন্যায়বিচার। একে কেন্দ্র করেই আগামীদিনে আন্দোলনকে নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। নির্যাতিতার জন্য ন্যায়বিচারের লড়াইতে জুনিয়র ডাক্তাররা নিজেদের ভবিষ্যৎ বাজি রেখে লড়াই করছেন। তাদের সেই লড়াই আরও সমর্থ হোক, ঐ দাবীতে সকলের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম আরও শক্তিশালী হোক।

 

Comments :0

Login to leave a comment