Post editorial women labour

শ্রমজীবী মহিলাদের প্রতি বৈষম্য ক্রমে তীব্র হচ্ছে

সম্পাদকীয় বিভাগ

মধুজা সেনরায়
 

দিন দুয়েক হলো, একটা খবর ভাইরাল হয়েছে সোসাল মিডিয়ায়। পৌলমী অধিকারী — দেশের হয়ে খেলা একজন ফুটবলার, মহিলা ফুটবলার, মাত্র ২৪ বছর বয়সে খেলা ছেড়ে দিয়ে এখন জোম্যাটোতে চাকরি করে বাড়ি বাড়ি খাবার পৌঁছে দেয়। এই বিশ্বায়িত কাজের বাজারে পৌলমীদের একটা গালভরা নাম আছে — গিগ কর্মী। পৌলমী জানিয়েছেন, ও খেলা চালাতে চায়। কিন্তু তার পেট চালানোর জন্য একটা চাকরি ভীষণ দরকার। তাই কিছু না পেয়ে এই চাকরিটা নিয়েছেন — কতকটা বাধ্য হয়েই। সংবাদমাধ্যমের সামনে খেদের সঙ্গে তুলে ধরেছেন মহিলা ফুটবলাদের সাথে পুরুষ ফুটবলারদের পার্থক্যের কথা। গুরুত্ব দেওয়া, যত্ন নেওয়ার প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য উঠে এসেছে ওর কথায়।
আসলে যে দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের কাছে মেয়ে সন্তানের থেকে ছেলে সন্তানের গুরুত্ব বেশি সে দেশের ফুটবল কর্তারা যে এমন একচোখা হবেন এতে আর আশ্চর্যের কী আছে। কিন্তু পৌলমীর ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে আরও কিছু বাস্তব সত্যকে তুলে ধরেছে। সারা ভারত জুড়ে কাজের সুযোগ এখন এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, পেট চালাতে সংসার টানতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনোরকমে একটা কাজের সন্ধানে দৌড়ে চলেছেন। সেখানে সম্মানজনক কাজের শর্ত, সামাজিক সুরক্ষা কোনও কিছুই আর বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে না। এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় আমাদের দেশে কাজের বাজার এমনিতেই খারাপের দিকে এগছিল, বেকারত্ব বাড়ছিল। কোভিড অতিমারী যেন এই অবস্থায় আগুনে ঘি ঢাললো। কয়েক কোটি লোকের চাকরি গেল। আর এই চাকরি হারানোর বাজারেও মহিলারা এগিয়েই থাকলেন। শুধুমাত্র প্রথম লকডাউনে কাজ হারালেন ৪৭% মহিলা শ্রমিক। পুরুষেরা যথারীতি বহু যোজন পেছনে। শতাংশের বিচারে মাত্র ৭% পুরুষ শ্রমিক কাজ হারালেন। ২০১০-২০২০ এই এক দশকে কর্মরত মহিলার সংখ্যা আমাদের রাজ্যে প্রতিদিন কমেছে। ২০১০ সালে যেখানে ২৬% মহিলা কর্মরত ছিলেন, ২০২০ যেখানে এই হার ১৯%-এ এসে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন চলতি আর্থিক বর্ষে এই সংখ্যা আরও কমবে। কারণ, কাজের খোঁজে মেয়েদের দৌড়ে শ্লথ হয়েছে চোখে পড়ার মতন। কাজের খোঁজ করা মেয়েদের সংখ্যা ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২১ সালে প্রায় তিরিশ লক্ষ কমেছে। শুনতে অবাক হলেও এটাই সত্যি যে, গ্রামীণ ভারতের তুলনায় শহুরে ভারত মহিলাদের কর্মসংস্থানের তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে।


এতো গেল কাজ পাওয়া — না পাওয়ার খতিয়ান। কিন্তু যে মেয়েরা কাজ করেন, তারা কেমন আছেন? আমাদের দেশের প্রায় ৪৮ শতাংশ মহিলা রোজগেরে শ্রমিক হলেও দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে তাদের অবদান মাত্র ১৭%। এই একটা তথ্যই দেখিয়ে দেয় মজুরির বাজারে মেয়েদের অবস্থান ঠিক কোথায়। আসলে এই দেশের শ্রমজীবী মহিলাদের অধিকাংশই ‘ইনফরমাল সেক্টরে’ কাজ করে থাকেন। সারা বিশ্বের নিরিখে মহিলারা কুড়ি শতাংশ কম মজুরি পান পুরুষদের তুলনায়। মহিলাদের দ্বারা পরিচালিত এন্টারপ্রাইজগুলির ৯০ শতাংশই ছয়জনের কম শ্রমিক নিয়ে পরিচালিত এবং ৮১% ক্ষেত্রে বাড়ি থেকেই এই সংস্থাগুলি পরিচালিত হয়। এই বিশ্বের ৩১ শতাংশ মহিলা গৃহস্থালির মজুরিবিহীন কাজেই তাদের শ্রমশক্তি ব্যয় করে থাকেন। সারা বিশ্বের মতন আমাদের দেশেও মহিলারা সাধারণভাবে কম মজুরির এবং কম উৎপাদনশীল কাজেই ব্যয় করে থাকেন। মহিলা ও পুরুষ শ্রমিকের এই মজুরি-পার্থক্যের একটা বড় কারণ হলো, মজুরিবিহীন গৃহস্থালির কাজে মহিলারা পুরুষদের তুলনায় প্রায় দশগুণ বেশি সময় ব্যয় করেন। কাজের বাজারের অংশগ্রহণের সমগ্র চিত্রটিকে একটা পিরামিডের আকারে প্রকাশ করলে দেখানো যাবে আমাদের দেশ তো বটেই সারা বিশ্বেই ক্যাজুয়াল, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকেরা পিরামিডের নিচের দিকেই থাকবেন। আর এই স্তরেই মহিলাদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি।
আমাদের রাজ্যে জনসংখ্যার বিচারে মহিলা শ্রমিকের অনুপাত মাত্র ২৩.১%। সারা দেশের গড়ের তুলনায় প্রায় সাড়ে পাঁচ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছি আমরা। আর যে মহিলারা কাজ করেন তাঁরা অধিকাংশই কম মজুরিতে এমনকি মজুরিবিহীন ক্যাজুয়াল ওয়ার্কের সাথে অথবা অসং‍‌গঠিত ক্ষেত্রের কাজের সাথে যুক্ত। এই রাজ্যে চা শিল্প, বিড়ি শিল্প এবং জরি, নির্মাণ, মৎস্যজীবী এই ক্ষেত্রগুলিতে বিপুল সংখ্যক মহিলারা কাজ করেন। শুধু চা এবং বিড়ি শিল্পের ক্ষেত্রে অধিকাংশই হলেন মহিলা শ্রমিক। এছাড়াও প্রায় সাড়ে চার লক্ষ মহিলা আশা, আইসিডিএস, মিড ডে মিলের মতন প্রকল্পগুলির সাথে যুক্ত। এক বড় অংশের মহিলা গৃহপরিচারিকা এবং আয়ার কাজের সাথে যুক্ত।
প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মজুরি বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। বিড়ি শিল্পের ক্ষেত্রে মহিলাদের মজুরি দেওয়া হয় বান্ডিল হিসাবে। আর পুরুষদের দিনপ্রতি। গৃহস্থালির কাজ সামলে খুব স্বাভাবিকভাবেই মহিলাদের কাজের পরিমাণ কম হয়।


সংগঠিত শিল্পে কর্মরত মহিলাদের সংখ্যা কমে যাওয়ার প্রভাব সরাসরি এসে পড়ছে গৃহ-সহায়িকাদের ওপর। গৃহ-সহায়িকারা বহু ক্ষেত্রেই নিজেদের কাজ হারিয়ে আয়ার কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন কোভিডের সময়। এবং মহামারীর সময়ে একটা বড় অংশ এইভাবে ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার হয়ে উঠেছেন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার ১৮৯তম শ্রম সুপারিশ অনুযায়ী এদের ন্যূনতম মজুরি ঠিক করতে হবে। আমাদের দেশের এবং রাজ্যের সরকার এখনও পর্যন্ত এনিয়ে আলোচনা করে উঠতে পারেনি, আন্তর্জাতিক শ্রম কনভেনশনের ৪৫ এবং ৪৬তম সুপারিশ মেনে প্রকল্প কর্মীদের শ্রমিকের মর্যাদা দেওয়ার দাবি আমাদের বহুদিনের। কিন্তু ভারতবর্ষের সরকার এখনও পর্যন্ত তা করেনি। উপরন্তু প্রতিদিন বরাদ্দ কমছে এই প্রকল্পগুলিতে মোদী সরকারের আমলে। এই প্রকল্পগুলির নানান গালভরা নাম দিয়ে আসলে প্রকল্পগুলিকে বেসরকারী স্বেচ্ছাসবী সংস্থার হাতে তুলে দিতে চাইছে দেশের সরকার। কম ভাতায় যথেচ্ছ পরিমাণ খাটিয়ে নেওয়া হয় প্রকল্প কর্মীদের। আমাদের রাজ্যের সরকার কাজের শর্তের কোনোরকম তোয়াক্কা না করেই নির্বাচনী ডিউটি, দুয়ারে সরকার, আবাস যোজনার মতন কাজগুলি একের পর এক চাপিয়ে চলেছে। এর জন্য কোনও অতিরিক্ত ভাতারও ব্যবস্থা নেই। উপরন্তু এদের দিয়ে আবাস যোজনার কাজ জোর করে করিয়ে এই প্রকল্পকর্মীদের বিপদে ফেলেছে রাজ্যের সরকার।
কেন্দ্রের সরকার ৪৪টি শ্রম আইনের মধ্যে ২৯টিকে বেছে নিয়ে ৪টি শ্রমকোড তৈরি করেছে। এই কোডে ন্যূনতম মজুরি গ্যারান্টি করার প্রশ্নে যেমন শিথিলতা আছে তেমনই সমকাজে সমবেতনের কথাও সুনিশ্চিত করা হয়নি। খুব স্বাভাবিকভাবেই মহিলা শ্রমিকদের মজুরি বৈষম্যের বিরুদ্ধের লড়াইটা আইনগতভাবে শক্তিহীন হবে এই কোড লাগু হলে। মহিলা শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আরও একটি বড় বিষয় হলো মাতৃত্বকালীন ছুটি। বামপন্থীদের দীর্ঘ লড়াইয়ের ফলে প্রথম ইউপিএ সরকারের আমলে শুধুমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রে ১৮০ দিন মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার সুরক্ষিত করা গিয়েছিল। অসংগঠিত ক্ষেত্রে নয়। নতুন শ্রমকোডে এই মাতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধার ক্ষেত্রে একশো দিনের কাজের কর্মী, আশা, আইসিডিএস, মিড ডে মিল কর্মী বিড়ি শ্রমিক প্রমুখ আগেও এই সুবিধা পেতেন না, এখনও পাবেন না। মাতৃত্বকালীন ছুটির সুবিধা সঙ্কুচিত হওয়ায় সংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করা মহিলারাও অনেকেই এই সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। যে আশা দিদিরা সারাবছর মা ও শিশুর খেয়াল রাখেন, গর্ভবতী মহিলাদের যত্ন নেন, যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের সংখ্যা বেড়েছে তাদেরই কিনা মাতৃত্বকালীন ছুটি নেই। এমনকি প্রকল্প কর্মীদের ক্ষেত্রে বোনাস, ছুটি, মেডিক্যাল লিভ এসবের সুবিধাও নেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে।


মহামারী পরবর্তী সময়ে দাঁড়িয়ে মহিলাদের অবৈতনিক কাজের পরিমাণ শুধু বৃদ্ধি পায়নি, এর সাথে কাজের শর্ত হিসাবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বেশ কিছু অমানবিক এবং মহিলাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক শর্তও। মহারাষ্ট্রের আখের খেতে, তামিলনাড়ুর পোশাক ‍‌শি‍‌ল্পে মহিলারা নৃশংসতার স্বীকার হন। তাঁদের থেকে বেশি কাজ আদায় করে নিতে তাদের জরায়ু কেটে বাদ দেওয়া হয় কোথাও কোথাও বা তাদের বন্ধ্যাকরণ করানো হয়। আবার মহারাষ্ট্রের আখের খেতে স্বামী-স্ত্রী মিলে একটি ইউনিট ধরা হয়। নতুন শ্রমকোডে এ ধরনের ঘটনা আটকাতে কোনও ব্যবস্থা তো নেওয়া হয়ইনি, উপরন্তু কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি আটকা‍‌নোর জন্য মহিলাদের জন্য কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তার সামাগ্রিক বিষয়টিকেই নয়া শ্রমকোড থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু রাতের কাজের ক্ষেত্রে মহিলাদের যে রক্ষাকবচগুলি ছিল নয়া শ্রমকোডে তাও অনুল্লিখিত। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি আটকাতে বর্তমানে আইনেও যা ব্যবস্থা রয়েছে তা সব জায়গায় প্রয়োগ করা যায়নি। বহু ক্ষেত্রেই দেখা যায় আইসিসি নেই বা থাক‍‌লেও কাজ হারানোর ভয় লোকলজ্জার ভয়ে মুখ বুজে মেনে নেন মেয়েরা। আমাদের দা‍‌বি শুধুমাত্র অফিসগুলিতেই নয়, সিআইটিইউ’র সর্বভারতীয় সিদ্ধান্ত মেনে ইউনিয়নগুলির অভ্যন্তরেও আইসিসি তৈরি হোক। সাইবার ‍বুলিং সহ‌ বিভিন্ন যৌন হয়রানি ও মহিলাদের প্রতি হিংস্রতা বন্ধে বিশেষ আইন তৈরি করতে হবে। সমস্ত কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের জন্য পৃথক টয়লেট ও বিশ্রাম কক্ষের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বহু মহিলা সেলস, মার্কেটিং এবং গিগের অন্তর্গত পেশায় নিযুক্ত। এঁদের কথা মাথায় রেখে পরিচ্ছন্ন শৌচালয়ের সংখ্যা বাড়াতে হবে। স্যানিটারি ন্যাপকিনের ভেন্ডিং মেশিন বসিয়ে কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের বিনামূল্যে স্যানিটারি ন্যাপকিন দিতে হবে। কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বন্ধে শক্তিশালী আইন তৈরি করতে হবে সরকারকে। সারা দেশ ও রাজ্য জুড়ে শ্রমজীবী মহিলাদের বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েই ন্যূনতম মজুরি, সামাজিক সুরক্ষা সহ মোট ২৪ দফা দাবি নিয়ে এ রাজ্যের ১২তম শ্রমজীবী মহিলা কনভেনশন সংগঠিত হতে চলেছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে আলাদা করে শ্রমজীবী মহিলা কনভেনশন কেন? মহিলা শ্রমিকদের বিশেষ অসুবিধা ও বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে আলোচনা করতে এবং ট্রেড ইউনিয়নের অভ্যন্তরে মহিলা শ্রমিকদের আরও বেশি করে সংগঠিত করতেই এই কনভেনশন। আমাদের সমাজের শ্রমজীবী মহিলারা সাধারণত দুভাবে শোষিত হন। এক, শ্রমিক হিসাবে; দুই, নারী হিসাবে। মহিলাদের সম্পর্কে মার্কসবাদের এই মৌলিক বোঝাপড়াকে সঙ্গে রেখেই আমরা এগতে চাই। আরএসএস- বিজেপি’র মনুবাদী ধারণার উলটো অবস্থানে দাঁড়িয়ে আমরা বিশ্বাস করি নারী ও পুরুষের ‍‌মিলিত সংগ্রামেই উন্নততর হবে সংগঠন, বদলাবে সমাজ।
 

Comments :0

Login to leave a comment