অন্যকথা — মুক্তধারা, বর্ষ ২
চৈত্রশেষের গাজন
পল্লব মুখোপাধ্যায়
‘গাজন’ এক লোকউৎসব। নিম্নবিত্ত শ্রেণীর মানুষের মধ্যে এর প্রচলন বেশি | চৈত্র
সংক্রান্তি থেকে শুরু করে আষাঢ়ী পূর্ণিমা পর্যন্ত সংক্রান্তি কিংবা পূর্ণিমা তিথিতে এ
উৎসব উদযাপিত হয়। গাজন উৎসবের নেপথ্যে কৃষক সমাজের এক সনাতন বিশ্বাস
কাজ করে। চৈত্র থেকে বর্ষার প্রারম্ভ পর্যন্ত সূর্য যখন প্রচন্ড উত্তপ্ত থাকে
তখন সূর্যের তেজ প্রশমন ও বৃষ্টি লাভের আশায় অতীতে কোনও এক সময় কৃষিজীবী
সমাজ এ অনুষ্ঠানের উদ্ভাবন করেছিল। চড়ক, গাজন উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ। এ
উপলক্ষে এক গ্রামের শিবতলা থেকে শোভাযাত্রা বের করে গ্রামান্তরের শিবতলায় নিয়ে
যাওয়া হয়। এ অনুষ্ঠান সাধারণত তিন দিনব্যাপী চলে। চৈত্র সংক্রান্তির গাজন
উপলক্ষে কোথাও কোথাও লোকনৃত্য প্রদর্শিত হয় |
গাজন উৎসবের মধ্যে প্রতিফলিত বাংলার প্রাণ, বাংলার লৌকিক সংস্কৃতি। সাহিত্যেও
গাজনের উল্লেখ মেলে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'পথের পাঁচালী'তে গ্রামবাংলায়
গাজন উৎসবের উল্লেখ রয়েছে। তিনি লিখেছেন, 'চড়কের আর বেশি দেরি নাই। বাড়ি বাড়ি
গাজনের সন্ন্যাসী নাচিতে বাহির হইয়াছে। দুর্গা ও অপু আহার নিদ্রা ত্যাগ করিয়া
সন্ন্যাসীদের পিছনে পিছনে পাড়ায় পাড়ায় ঘুরিয়া বেড়াইল।'
এ সময়ে গ্রামবাংলার আকাশবাতাস ঢাকের বাজনা আর গাজনগীতিতে মুখরিত হয়।
গ্রামীণ মানুষজন মেতে ওঠে গাজন উৎসবে। কোথা থেকে এল গাজন শব্দটি? কেউ বলেন,
'গর্জন' শব্দ থেকে 'গাজন' এসেছে। অন্য মত হল, গাঁয়ের মানুষের মানে গাঁয়ের জনের
উৎসব, তাই গাঁজন বা গাজন।
চৈত্র মাসেই গাজনের ধুম। গাজনের শেষ দিনের অনুষ্ঠান চড়ক। গ্রামের কৃষিজীবী,
শ্রমজীবী সমাজের মানুষ গাজন-এর আয়োজন করেন।
কলকাতার দুজায়গায় চড়ক-গাজন খুব ভালো ভাবে হয় | একটি উত্তরে ছাতুবাবু-লাটুবাবুর
বাজারে, অন্যটি দক্ষিণে কালীঘাট অঞ্চলে। কলকাতার এ দুটি জায়গা ছাড়াও হাওড়ার
বাগনান, নদিয়ার শান্তিপুরে এবং বর্ধমানের অম্বিকা কালনাতেও গাজন খুব বর্ণময়।
কলকাতার গাজন-চড়কএর উল্লেখ হুতোম প্যাঁচার নকশায় রয়েছে । এরও আগে এর
উল্লেখ রয়েছে দেওয়ান রামকমল সেনের লেখায়। এশিয়াটিক সোসাইটির সচিব রামকমল
সেন লিখেছেন, চড়ক শব্দটি এসেছে চক্র থেকে, যা চক্রাকারে ঘোরে। চড়কগাছে কিন্ত
এই বৃত্তকার ঘোরার বিষয়টি রয়েছে।
গাজনের সং জনপ্রিয় একটি বিষয় । এটি গাজনের বিশেষ রীতি। গাজনে নানা গান গীত হয়।
অনেকেই বহুরূপী সেজে নানা গান করেন। চড়কের অনুষ্ঠানের সঙ্গে এই সব সং-এর গান
জুড়ে গিয়ে এক আলাদা সংস্কৃতি তৈরি করেছে। সব মিলে গাজনের গান-বাজনা বাঙালির
লোকসংস্কৃতির সঙ্গে সমাজসংস্কৃতির সঙ্গে ওত:প্রোত ভাবে জুড়ে গিয়েছে। কাজী
নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, 'গাজনের বাজনা বাজা/কে মালিক, কে সে রাজা/কে দেয় সাজা
মুক্ত স্বাধীন সত্যকে রে?' পরাধীন যুগে বীর যোদ্ধাদের কাছে এই গাজনের গান হয়ে
উঠেছিল স্বাধীনতার প্রতীক। গাজনের গান তাই কবির কাছে মুক্তিরই দ্যোতক ছিল।
Comments :0