রূপান্তরকামী হওয়ার কারণেই ছোট্টবেলায় বন্ধ হয়েছিল বাড়ির দরজা। ছেলেদের অনাথ আশ্রমে পড়াশোনা করা সুমন আজ সেট উত্তীর্ণ হয়েছেন। রূপান্তরিত হয়েছেন সুমনায়। সমাজের অঙ্ক মেলানোর লক্ষ্যেই চলছে তাঁর কঠোর লড়াই। সম্প্রতি প্রকাশ পেয়েছে রাজ্যের কলেজগুলিতে অধ্যাপনার যোগ্যতা অর্জনকারী স্টেট এলিজিবিলিটি টেস্ট বা সেট পরীক্ষার ফলাফল। আর তাতে নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন নদীয়ার বাসিন্দা সুমন প্রামাণিক, এবার তিনি কলেজে পড়ানোর অপেক্ষায়। তবে ছোটবেলায় আর পাঁচটা মানুষের মতো তাঁর লড়াইটা সহজ ছিল না। সমাজের সঙ্গে একাধিক লড়াই করে বড় হয়ে নিজের পরিচয় নিজের হাতেই গড়তে হয়েছে তাঁকে।
ছোটবেলায় আর পাঁচটা শিশুর মতোই বড় হচ্ছিলেন সুমন। তবে বাড়ির বড় সন্তান হওয়ায় তাঁকে নিয়ে একটু বাড়তি আশাই ছিল পরিবারের। কিন্তু ছোটবেলা থেকেই তাঁর স্বভাব ছিল অনেকটাই মেয়েদের মতো। তাই অচিরেই তাঁর জন্য বন্ধ হয়ে গেল বাড়ির দরজা। দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়াশোনা করার সময় তার ঠাঁই হলো নদীয়ার করিমপুরের একটি অনাথ আশ্রমে, যেটি ছিল শুধুমাত্র ছেলেদের জন্যই। সেখানে জুটেছে বন্ধুদের কাছ থেকে শুধুমাত্র বঞ্চনা ও অবহেলা। তবে শত বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও তাঁর নিজের লড়াই ও সঙ্গে পড়াশোনা চালিয়ে গিয়েছেন নিরন্তর। ছোটো থেকেই সুমনা পড়াশোনায় ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। ক্লাসে বরাবরই ভালো নম্বর পেতেন তিনি। মাধ্যমিকে ৮২শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করে শুরু হলো তাঁর জীবনের আরেক অধ্যায়। মাধ্যমিক দেওয়ার পরই তাঁর নিজের বাড়ি করিমপুর ছেড়ে তিনি চলে আসেন কৃষ্ণনগরে।
প্রথমদিকে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের বাড়িতে কিছুদিন আশ্রয় পেলেও, খুব বেশিদিন তাও জোটেনি। দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় থেকেই নিজের পেটের ভাতের জোগান নিজেকেই করতে হয়েছে। গৃহশিক্ষকতা করেই নিজের খরচ জোগানো, সঙ্গে লেখাপড়া সবই করেছেন তিনি। যদিও এই কঠিন সময়ে তিনি তাঁর পাশে পেয়েছেন এমন কিছু মানুষকে, যাঁরা মানসিকভাবে তাঁকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছেন। এরপর উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়ে অঙ্কে সাম্মানিক স্নাতক হন সুমনা। পাশাপাশি চলেছে তাঁর জীবনের চরম পর্যায়ের লড়াই। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে ছিল নারীত্বের ছোঁয়া, সেটা তিনি বুঝতে পারেন নবম শ্রেণিতে থাকতেই। তারপরই তিনি হয়ে ওঠেন সুমন থেকে সুমনা। তবে এখানেই শেষ নয়। এরপরেও জীবনে একাধিক লাঞ্ছনা পোহাতে হয়েছে তাঁকে।
এরপর কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্কে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করে রূপান্তরকামী হিসেবে প্রথম অঙ্কে গোল্ড মেডেল লাভ করেন সুমনা। সুমনা এদিন জানান, তাঁর নাম প্রথম সুপারিশ করেন অপর একজন সফল রূপান্তরকামী অধ্যাপিকা মানবী বন্দ্যোপাধ্যায়। স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শেষ করে বিএড করার পর দীর্ঘ ৫বছরের প্রচেষ্টায় সম্প্রতি তিনি সেট উত্তীর্ণ হন। একটি কলেজে অতিথি অধ্যাপিকা হিসেবেও বছরখানেক শিক্ষকতা করেন তিনি। পাশাপাশি হাতের কাজেও অত্যন্ত সুনিপুণ তিনি। মাটির মূর্তি তৈরি করতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। রূপান্তরকামী হিসাবে একদিনের জন্য লোক আদালতের বিচারকও হয়েছিলেন তিনি।
সুমনার কথায়, রূপান্তরকামী মানেই শুধুমাত্র রাস্তার সিগন্যালে কিংবা ট্রেনে বাসে দাঁড়িয়ে তালি বাজিয়ে ভিক্ষা করবে— এই ধারণাকে শেষ করতে অনেক দূর পর্যন্ত হাঁটতে চাই। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শহরের অনেকেই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ রয়েছেন, তাঁদের পড়াশোনা বা স্বনির্ভর হওয়াটা ভীষণভাবে জরুরি।
Being transgender doesn't mean begging by clapping at the signal.
রূপান্তরকামী মানে সিগন্যালে তালি বাজিয়ে ভিক্ষা করা নয়, অধ্যাপনার যোগ্যতা আদায় করে বলছেন সুমনা

×
Comments :0