লুট প্রতিরোধের লড়াইয়ে ফিরছে মানুষ বরেন সরকার: বড়জোড়া
জমানা বদলে বাঁকুড়ার সুখা মাটির জেলার কৃষিতেও এখন থাবা কর্পোরেটের। জমানা বদলের আগে যা সুরক্ষিত ছিল, তা উধাও। বিপন্ন কৃষি রক্ষায় ফের জোট বাঁধছে মানুষ। লুট রুখতেই প্রতিরোধ। রুটিরুজি নিশ্চিত করতেই লুট প্রতিরোধের লড়াইয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে মানুষকে। বাঁকুড়া জেলার সিপিআই(এম) ২৪তম জেলা সম্মেলন সেই বার্তা দিচ্ছে। বুধবার বড়জোড়ায় কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি এবং কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নগরে শুরু হয়েছে সম্মেলন। জেলার অন্যতম শিল্প শহর বলে খ্যাতিলাভ করেছিল যে বড়জোড়া, সেই শিল্প শহর এখন ধুঁকছে। গোটা রাস্তা এদিন সেজে উঠেছে লাল পতাকায়। শ্রমিক-কৃষকের যে সুরক্ষা কেড়ে নিয়েছে শাসক লুটেরারা তা আবার ফিরিয়ে আনার শপথ। সম্মেলন মঞ্চের নাম হয়েছে কমরেড বাসুদেব আচারিয়ার নামে।
এদিন সম্মেলনে পার্টির রক্তপতাকা উত্তোলন করেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য অমিয় পাত্র। শহীদ বেদীতে মাল্যদান করেন সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ। শোক প্রস্তাব পেশের পর সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। দেবলীনা হেমব্রম, পুর্ণিমা বাগদি, সৌমেন্দু মুখার্জি এবং সেখ ইউনিসকে নিয়ে সভাপতিমণ্ডলী গঠন করা হয়েছে।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের নয়া উদারবাদী নীতি দেশের বাজারকে কর্পোরেটে জন্য যে লুটের ক্ষেত্র করেছে তাতে শামিল রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেসেও। কীভাবে শুখা জেলা বাঁকুড়ার কৃষির বাজার কর্পোরেট রাঘববোয়ালের হাতে তুলে দিয়েছে তা উদ্বোধনী ভাষণে বলেন সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আভাস রায়চৌধুরি। তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার কৃষকদের জন্য যে কৃষি বাজার সুরক্ষিত রেখেছিল ক্ষমতায় এসেই তৃণমুল সরকার ২০১৪ থেকে ২০১৭ সালে সেই বাজার ক্রমশ কর্পোরেট রাঘববোয়ালদের জন্য অবাধ করে দেয়। ছোট কৃষকদের কাছে সেই বাজারে যাওয়ার ক্ষমতা কার্যত কেড়ে নেওয়া হয়। মোদী কৃষি কর্পোরেট হাতে তুলে দেওয়ার যে নীতি নিয়েছেন তা রাজ্যে কার্যকর করছে তৃণমূল। বামফ্রন্ট কৃষকদের স্বার্থে যেসব সুরক্ষা চালু করেছিল তা একে একে কেড়ে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। তার অনেক উদাহরণের মধ্যে রয়েছে কৃষি বাজার।’’
রায়চৌধুরি বলেন, ‘‘রাজ্যে ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি তাঁর ভাষণে বামফ্রন্টের কৃষকদের জমি বন্টনের কর্মসূচিকে ‘জমি ডাকাতি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। সেই দিন বোঝা গিয়েছিল জমি চোর জোতদার জমিদারদের পক্ষেই রয়েছে তৃণমূল সরকার। তাদের স্বার্থেই কাজ করবে। তৃণমুল জমানায় সর্বত্র লুট চালিয়ে একদল নব্য ধনী তৈরি হয়েছে, তারা গ্রামে গ্রামে জমি হাঙড় হয়েছে।’’ তিনি জানান, ‘‘মোদী-শাসনে দেশে মুষ্টিমেয় ধনী ধনকুবের হয়েছে। তাদের হাতে দেশের সব সম্পদ জড়ো হয়েছে। নানা লুট চালিয়ে তাদের হাতে দেশের সম্পদ কুক্ষিগত হচ্ছে। এতে সাধারণ মানুষের আয় কমছে। দেশের সম্পদের অংশ কমে গিয়েছে তাঁদের। এরফলেই দেখা যাচ্ছে, আয় কমে বাড়ছে গরিবি। দারিদ্র এবং অনাহার চরম আকার নিয়েছে। তিনটি ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বে সবথেকে এগিয়ে। তা হলো দারিদ্র, বেকারি এবং অনাহার। মোদীর নীতি রাজ্যে বর্তমান সরকার কায়েম করায় একই পরিণাম হয়েছে রাজ্যেও।’’ তিনি বলেন, ‘‘রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার ভুমি সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে চাষযোগ্য জমি ৯৭ শতাংশ প্রান্তিক কৃষকদের কাছে বিলি করেছে। সেই জমি আবার জমি ভাঙরদের হাতে ফিরে যাচ্ছে।’’
বর্তমান উদারনীতি হাল ব্যখ্যা করতে গিয়ে রায়চৌধুরি বলেন, ‘‘যে বাজারকে দেবতা বলে বাজার নীতি চালু করেছে উদারবাদীরা, সেই বাজর আজ সঙ্কটে পড়েছে। উদারবাদীরা একে ব্যবস্থার অভ্যন্তরীণ সঙ্কট বলে বোঝাতে চাইছে। আসলে ঘটনা হলো বাজারে গরিব মানুষ নেই। বেশিরভাগ মানুষের আয় নেই তার গরিব হয়ে পড়ছেন। ফলে বাজারে থেকে তারা ক্রমশ বেরিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অল্প কিছু কর্পোরেট এই ব্যবস্থায় লাভ তুলছে। তাই কাজ হারানো, আয় কমে যাওয়া অবস্থাটা বহাল থাকুক তা তারা চাইছে। দেশের সরকার সেই বিপুল মুনাফা তোলা কর্পোরেটদের স্বার্থে কাজ করে চলেছে। এখন চলছে বিভাজনের রাজনীতি। সাম্প্রদায়িক ইস্যুতে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরিতে কর্পোরেট ও হিন্দুত্ববাদী জোটের অভিযান চলছে।’’
‘দেশের এই চরম বৈষম্যের নীতি পালটাতে আমাদের লড়াই’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘‘সমাজের এই শোষণ নীতি বদলের যে লড়াই তার কোনও শর্টকাট পথ নেই। তবে হতাশার কোনও জায়গা নেই। লাগাতার এই লড়াই আমাদের চালিয়ে যেতে হবে। দেশের বাস্তবতার বিশ্লেষণ করে তাতে সব সম্ভাবনা খুঁজে বের করতে হবে। মোদী ৪০০ পেরোনোর হুঙ্কার দিলেও বিজেপি ৪০০ পেরোতে পারেনি, এনিয়ে অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, ‘বিজেপি হেরেছে মানুষ চায়নি বলেই’। এটাই হলো বাস্তবের মধ্যে সম্ভাবনার জায়গা। এই সম্ভাবনা সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার মতো মজবুত সংগঠন গড়ে তুলতে হবে।’’
এদিন খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশের পর তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। জেলা সম্পাদক অজিত পতি সম্পাদকীয় রিপোর্ট পেশ করে জেলা কিংবা রাজ্যে ক্ষমতা বদলের ফলে কর্মসংস্থানে যে চরম সঙ্কট নেমে এসেছে তা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘‘জেলায় শ্রমিকদের আয় কমেছে। দারিদ্র অনাহার বাড়ছে। যে নতুন কর্মোদ্যোগ শুরু হয়েছিল বামফ্রন্ট আমলে জমানা বদলের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ বন্ধ হয়ে গেছে। কৃষি শ্রমিকের মজুরি বিপুল হারে কমেছে। যেমন বাঁকুড়া দক্ষিণে কৃষি শ্রমিকের মজুরি কমে হয়েছে দৈনিক ১২০ থেকে ১৩০ টাকা, সেখানে দক্ষিণে সেই শ্রমিকের মজুরি কমে হয়েছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। ফলে জেলায় পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বিপুল হারে বেড়ে গেছে। নগরায়ন বেড়ে চলায় কাজের খোঁজে গ্রামের মানুষ শহরে ভিড় করছেন। কিন্তু তাঁদের যাতায়াত, থাকার ব্যবস্থার পরিকাঠামো গড়ে ওঠেনি।’’ তিনি জানান জেলায় তৃণমূল আমলেয় ৮৭০ থেকে ৮৭৫টি স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। গত পাঁচ বছরে স্কুলে কোনও নতুন নিয়োগ হয়নি। এতে শিক্ষক না থাকার কারণেই স্কুল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তিনি জানান, জেলায় তৃণমূল-বিজেপি’র এই সময়ে বামপন্থীদের আক্রমণের হার কমলেও তাঁদের ক্ষমতা কমেনি। এখনও জঙ্গলমহলে তৃণমূল বাহিনীর তৎপরতা রয়েছে। সরকারের জনবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘জেলার ১৯০টি গ্রাম পঞ্চায়েতের দু’-একটি বাদ দিলে সব কয়েকটি পঞ্চায়েতে আমরা ডেপুটেশন দিয়েছি।’’ সাম্প্রদায়িক প্রচার চালিয়ে বিভেদ তৈরির চেষ্টার বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা জানিয়ে তিনি রাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘‘গ্রামসি রাষ্ট্রের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছিলন, রাষ্ট্র একসময় উৎপীড়নের পক্ষে সম্মতি তৈরির প্রক্রিয়া চালায়। বর্তমানে রাজ্যে তা চলছে।’’
এদিন জেলার শিল্প সম্ভবনা, কর্মসংস্থান দেশ ও রাজ্যে প্রস্তাব পেশ হয়। এদিন প্রতিনিধিরা তাঁদের আলোচনায় সন্ত্রাস কবলিত এলাকায় আন্দোলন গড়ে থোলা সম্ভব হচ্ছে বলে জানান। জঙ্গলমহলের চারটি থানা রানিবাঁধ, সারেঙ্গা, রায়পুর, সিমলাপালে আন্দোলনের প্রসার ঘটছে বলে প্রতিনিধিরা উল্লেখ করেছেন।
CPI(M)
শুরু সিপিআই(এম) বাঁকুড়া জেলা সম্মেলন
×
Comments :0