বিমান বসু
১৯২০ সালে আজকের দিনে অর্থাৎ ১৭ অক্টোবর প্রবাসে সোভিয়েত রাশিয়ার উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ শহরে কমরেড মানবেন্দ্রনাথ রায়ের নেতৃত্বে সাত জন নেতার উদ্যোগে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়েছিল। ঐ সভা থেকে সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন মহম্মদ সাফিক সিদ্দিকি।
একথা উল্লেখ থাকে যে, প্রবাসে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পর পরই রাতারাতি ভারতের বিভিন্ন স্থানে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠেনি। কারণ, কমিউনিস্ট পার্টি কোনও স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠে না। কিন্তু প্রবাসে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠার পর ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে যে সমস্ত বিপ্লবী মনোভাবাপন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের অনেকেই ধীরে ধীরে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে পার্টি গড়ার প্রাথমিক কাজ শুরু করেন।
ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নথিতে দেখা করা যায়, ১৯২২ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে বঙ্গ প্রদেশে ‘আত্মশক্তি’, ‘ধূমকেতু’, ‘দেশের বাণী’, ‘নয়া যুগ’, বম্বে থেকে ‘সোশালিস্ট’, মাদ্রাজের ‘লেবার গেজেট’, ‘নবযুগম’ এবং ‘ইনকিলাব’ ও ‘কীর্তি’পত্রিকা পাঞ্জাব থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই সব পত্রিকা স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপ্লবীদের সঙ্ঘবদ্ধ হতে এবং কমিউনিস্ট ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হতে সাহায্য করেছে।
অদ্ভুতভাবে লক্ষ্য করা যায়, ১৯২০ সালের মে মাসে সওকত ওসমানি কানপুর থেকে এবং মুজফ্ফর আহ্মদ কলকাতা থেকে গ্রেপ্তার হন। কয়েকদিন পর গুলাম হোসেন লাহোর থেকে গ্রেপ্তার হন। সকলকেই বিনা বিচারে আটক রাখা হয়েছিল।
উল্লেখ থাকে যে, জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বিপ্লবীদের নেতৃত্ব শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে ১৯২০ সালেই নিখিল ভারত শ্রমিক সংগঠন গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী নেতৃত্বের প্রচ্ছন্ন পৃষ্ঠপোষকতায়। আবার কানপুরে ১৯২৫ সালের ডিসেম্বর মাসে কমিউনিস্টরা সম্মেলন সংগঠিত করেছিল। এই সম্মেলন থেকে মুজফ্ফর আহ্মদকে বাংলায় কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। উল্লেখ্য, মুজফ্ফর আহ্মদ কানপুর ষড়যন্ত্র মামলায় বিনা বিচারে বন্দি থাকার সময় প্যারোলে মুক্তি পেয়ে সোজা কানপুর সম্মেলনে যোগ দিয়েছিলেন। এখনকার ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) এই কানপুর সম্মেলনকেই ভারতের বুকে প্রথম কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ে উঠেছিল বলে ঘোষণা করে।
প্রসঙ্গত, ভারতের বুকে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রবাসে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠাকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) বিগত দিনে প্রতিষ্ঠা দিবস হিসাবে ঘোষণা করেছে। ভারতের বুকে তৎকালীন সময়ে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম, বিশেষ করে আমেদাবাদ কংগ্রেসে এম এন রায়ের তৈরি করা পূর্ণ স্বরাজের প্রস্তাব পেশ, দীর্ঘ সময় ধরে বিপ্লবী কার্যকলাপ, দলিলপত্র ও বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামের বাস্তবসম্মত পর্যালোচনার মধ্য দিয়েই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী), ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবরকেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস বলে ঘোষণা করেছিল। একারণেই আমরা ১৭ অক্টোবর আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করে আসছি।
এই ছোট্ট লেখায় বিগত ১০৪ বছর কেন, সাম্প্রতিক সময়েরও পার্টির সফলতা ও বিফলতা নিয়ে কোনও পর্যালোচনায় ব্রতী হতে চাইছি না। শুধু উল্লেখ করতে চাই, আমাদের পার্টির প্রবীণ সদস্যরা পঞ্চাশের দশক ও ষাটের দশকে অনেক রক্তক্ষয়ী আন্দোলন সংগ্রামের সাক্ষী, কারণ তাঁরা প্রায় সকলেই ঐ সব আন্দোলন সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। তুলনামূলকভাবে যাঁরা প্রবীণ নন, তাঁরাও আন্দোলন সংগ্রামের পাশাপাশি সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে থেকে নতুন ধরনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন। কিন্তু এখনকার সময়ে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সঙ্ঘের প্রভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের সাম্প্রদায়িকীকরণের বিভেদকামী রাজনীতিকে পরাস্ত করতে অবশ্যই গণতন্ত্রপ্রিয় প্রগতিশীল সব অংশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কাজে বেশি গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। এই কাজ কোনও স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়ায় সম্ভব নয়। সক্রিয়ভাবে এই কাজে যুক্ত হতে হবে। আবার আমাদের রাজ্যে আরএসএস’র প্রচ্ছন্ন সমর্থনে রাজ্য সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী, স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে ছোট বড় সব আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে। সদ্য প্রয়াত আমাদের পার্টির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি একটা কথা বলতেন, ‘ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ময়দান প্রসারিত করতে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ও তৃণমূল উভয়ের বিরুদ্ধেই যুগপৎ লড়াই সংগ্রামে অংশ নিতে হবে।’
আজ আমাদের পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসে সকল পার্টিসদস্য যাঁরা স্বাস্থ্যের কারণে ঘরবন্দি নন বা অন্য কোনও কারণে চলাফেরা করতে অসুবিধা হয়, তাঁদের বাদ দিয়ে সকলকেই সংগ্রামের ময়দানে শামিল হতে হবে। শারীরিকভাবে সক্ষম সমস্ত পার্টিসদস্য, এরিয়া কমিটির সদস্য থেকে জেলা কমিটির সদস্য সহ, সকলকেই পার্টির প্রতিষ্ঠা দিবসে সাচ্চা কমিউনিস্ট হয়ে গড়ে ওঠার শপথ নিতে হবে।
Comments :0