CPIM KOLKATA

নিজস্ব রাজনৈতিক বোধ নিয়ে রাজ্যে বামপন্থীদের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে

রাজ্য কলকাতা

 প্রসূন ভট্টাচার্য: কলকাতা 


দক্ষিণপন্থীদের দেখানো অন্ধগলিতে ঢুকে বামপন্থীরা কখনোই পথ হারাবে না, নিজস্ব রাজনৈতিক বোধ নিয়েই রাজ্যে বামপন্থীদের পুনর্জাগরণ ঘটাতে হবে। সোমবার সিপিআই(এম)’র কলকাতা জেলা সম্মেলনের অধিবেশনে একথা বলেছেন পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। বিজেপি’কে রুখতে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের যৌক্তিকতা, বাংলাদেশের ঘটনাবলী নিয়ে যুদ্ধজিগির কিংবা আর জি করের ন্যায় বিচারের আন্দোলনের ফলাফল সহ প্রতিটি বিষয়ে দক্ষিণপন্থীদের দেখানো হতাশাঘেরা অন্ধগলি প্রত্যাখ্যান করতে বলেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, ক্ষুদ্র অন্ধকূপে ডুবিয়ে রাখার মতো প্রচারে বামপন্থীরা ভেসে যায় না। কারণ বামপন্থীদের বিশ্ববীক্ষা আছে, হুজুগে রাজনীতি করার প্রয়োজন আমাদের হয় না। 
এদিন কলকাতা জেলা সম্মেলনের শেষ পর্বে পর্যবেক্ষণ দিতে গিয়ে মহম্মদ সেলিম বাংলাদেশ নিয়ে বামপন্থীদের বিরুদ্ধে কুৎসা প্রচার, ইন্ডিয়া মঞ্চের কার্যকারিতা এবং আর জি কর আন্দোলনের কার্যকারিতা নিয়ে হতাশাজনক অপপ্রচারগুলি শুধু খণ্ডনই করেননি, দক্ষিণপন্থীদের এই প্রচারগুলি কীভাবে মানুষকে একটি নির্দিষ্ট হুজুগে মাতিয়ে সংগ্রাম বিমুখতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তাও ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেছেন, আগে যারা বলছিল সিপিআই(এম) তো শূন্য, ওদের আন্দোলন কই! আর জি কর আন্দোলনের পরে তারাই বলছে, লাভ কী হলো! সিপিআই(এম)’র ভোট বাড়লো কই! যেন আর জি কর আন্দোলনে চেপে আমরা রাতারাতি নবান্নের চোদ্দতলায় বসতে চেয়েছিলাম! 
আর জি করে নিহত তরুণী চিকিৎসকের ন্যায় বিচারের দাবিতে তোলপাড় করা আন্দোলনের ইতিবাচক দিকগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেন, আর কোন আন্দোলনে টানা চার মাস ধরে মানুষের এমন ঢল নেমেছে? বহুস্তরীয়ভাবে, ঝান্ডা ছাড়া নাগরিক আন্দোলনে, লাল ঝান্ডা নিয়ে আন্দোলনে ঢেউ তুলে মানুষ শুধু শামিলই হননি, এই আন্দোলন নতুন ভাষা, নতুন স্লোগান, নতুন সৃজনশীল পন্থা জাগিয়েছে। যে বামপন্থী পরিমণ্ডলকে মমতা ব্যানার্জি নিকেশ করে দিয়েছেন ভেবেছিলেন, সেই বামপন্থী পরিমণ্ডলের জন্যই আর জি কর আন্দোলনে বিজেপি ঘেঁষতে পারেনি, আবার তৃণমূলও নিহত তরুণীর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারেনি। এত সহজে এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে? আন্দোলনে ঢেউয়ের মতো ওঠানামা থাকতে পারে, কিন্তু ইতিমধ্যেই আর জি কর আন্দোলনের ঢেউ ধাক্কা মেরে অনেক নুড়ি পাথর পলি সরিয়ে দিয়েছে, চলার নতুন পথ বের করে দিয়েছে। নতুন উদ্যমে সেই পথে এগিয়ে যেতে হবে। 
একইভাবে সর্বভারতীয় স্তরে বামপন্থীদের তাগাদায় বিজেপি বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ গঠনের ফলে মোদীর নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, কেউ কেউ এখনও কংগ্রেস বা আইএসএফ’র ভূমিকা দেখিয়ে আমাদের রাজনৈতিক লাইন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। অন্যদের দল তো আমরা নিয়ন্ত্রণ করি না। কিন্তু এরাজ্যে তৃণমূল এবং বিজেপি’র বিরুদ্ধে আমরা একাই লড়তে পারবো, এমন মুর্খের মতো ভাবনা আমাদের নেই। ভবিষ্যতে কে নড়বড় করবে তা নিয়ে ভাবছি না, আমরা নিজেদের পার্টিকে মজবুত করে, বামফ্রন্ট, বামফ্রন্টের বাইরের বামপন্থী ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দল এবং অন্যান্য তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী সবাইকে একত্রিত করার চেষ্টা করে যাবো। লড়াইয়ের প্রতি আন্তরিকতায় কোনও উন্নাসিকতা আমরা রাখছি না। 
বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণের ঘটনা নিয়ে সিপিআই(এম)’র প্রতিবাদী ভূমিকার উল্লেখ করার পাশাপাশি সেলিম সতর্ক করেছেন, বাংলাদেশের জামাত হোক, ভারতের আরএসএস হোক, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা করতেই হবে। কমিউনিস্টদের বিশ্ববীক্ষা আছে, মতাদর্শ থেকেই আমরা এর বিরোধিতা করবো। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার অন্যায়কে ধর্মের চশমা দিয়ে বাছাই করা চলে না। চট্টগ্রামের পোস্টার দেখিয়ে আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের বিধানসভা নির্বাচন পার করতে চাইছে বিজেপি আর তৃণমূল। বাংলাদেশী বিদ্বেষ আর আতঙ্ক জাগানো হচ্ছে, যুদ্ধজিগির তোলা হচ্ছে এমনভাবে যেন রিকশায় চেপে ভারত দখল করতে চলে আসছে। আমরা এইসব হুজুগে ভেসে যেতে পারি না। পাক-অধিকৃত কাশ্মীর দখলমুক্ত করার প্রচার চালিয়ে, পাকিস্তানে ঢুকে মারার হুমকি দিয়ে বিজেপি ভোটে জিতেছিল। তখন যেসব মিডিয়া প্রচার চালিয়েছিল এখন কাশ্মীর নিয়ে তারা কোনও খবর প্রচার করে? আফগানিস্তানের কথা এখন কেউ মনে রাখে! 
পালটা প্রশ্ন তুলে সেলিম বলেছেন, বিশ্বগুরু বলে দাবি করা মোদীর সরকার কী করছে বাংলাদেশ নিয়ে? সার্ক-কে সক্রিয় করতে বড় দেশ হিসাবে ভারত কী ভূমিকা পালন করছে? এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনকে ঘিরতে আমেরিকা এখানে হস্তক্ষেপ করছে। অথচ ভারত প্রতিবেশী দেশগুলির থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে কেন? বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করলে ভারতের লাভ হবে, নাকি ক্ষতি হবে? এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বামপন্থী রাজনৈতিক বোধে বিবেচনা না করে অজান্তেই দক্ষিণপন্থীদের প্রচার খিলানের ইট হয়ে যাওয়ার ভুল আমরা করতে যাবো না। যারা ভিয়েতনাম-কিউবায় সাম্রাজ্যবাদী থাবার বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে বিদ্রুপ করে, যারা প্যালেস্তাইনে গণহত্যাকে দেখতে পায় না, যারা আমাদের ক্ষুদ্রতায় ডুবিয়ে রাখতে চায়, তারা আজকে যেভাবে বাংলাদেশকে দেখাবে, আমরা সেইভাবে দেখবো না।
সম্মেলনে খসড়া রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ওপরে আলোচনা শেষে কল্লোল মজুমদার জবাবী ভাষণ দিয়েছেন। তিনিও বলেছেন, বিজেপি-তৃণমূল মিডিয়ার মাধ্যমে কোনও সাম্প্রদায়িক প্রচারকে জনপ্রিয় করে তুললেও বামপন্থীরা সেই পথে হাঁটবে না। বামপন্থীরা অগ্রণী চেতনা নিয়েই এগোবে, এমনকি প্রতিকূলতা দেখা দিলেও তার থেকে উত্তরণ ঘটাবে। ১৯৬২ সালের চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের সময়েও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে আক্রমণ শানানো হয়েছিল, জনবিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হয়েছিল। তখনও আমরা প্রতিকূলতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছি, এখনও বামপন্থার জাগরণ ঘটিয়েই মানুষকে সংগঠিত করবো। 
এদিন সম্মেলন মঞ্চে সমীর মৈত্র তাঁর পেনশন তহবিল থেকে ১০ হাজার টাকা গণশক্তি পত্রিকার জন্য, ১০ হাজার টাকা জ্যোতি বসু সমাজচর্চা ও গবেষণা কেন্দ্রের জন্য এবং ৫০ হাজার টাকা পার্টির কলকাতা জেলা কমিটির তহবিলে সাহায্য করেছেন। 

Comments :0

Login to leave a comment