‘আমাদের দল গরিব, বাকিদের মতো এত টাকা পয়সা নেই’ বারেবারে দাবি করেন মুখ্যমন্ত্রী। ফলাও করে সংবাদমাধ্যমেও তা প্রচার হয়।
তবে সেই ‘গরিবের দলের’ অডিট রিপোর্টের তথ্য বলছে অন্য কথা। বৈভব এখন আকাশ ছুঁয়েছে। সেই আকাশে ওড়ার খরচও কোটি কোটি টাকা! যদিও এসবই ঘোষিত হিসাব। নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া অডিট রিপোর্ট। যা ইতিমধ্যেই কমিশনের ওয়েবসাইটে আপলোড করা হয়েছে।
নির্বাচন কমিশনের কাছে দাখিল করা মুখ্যমন্ত্রীর ‘গরিব দল’র অডিট রিপোর্ট বলছে, গত আর্থিক বছরে শুধুমাত্র বিমান, হেলিকপ্টারে খরচ হয়েছে ৩৫ কোটি ৫৯ লক্ষ ৭৪ হাজার ২৭১ টাকা। গত বছরে শুধু আকাশে উড়েই তৃণমূল সাড়ে ৩৫ কোটি টাকা উড়িয়েছে।
তার আগের বছর আবার বিধানসভা ভোট ছিল। তখনও হেলিকপ্টারে করে মমতা ব্যানার্জি, অভিষেক ব্যানার্জিরা রাজ্য ঘুরেছিলেন। ২০২০-২১’ আর্থিক বছরের অডিট রিপোর্ট বলছে হেলিকপ্টারের পিছনে তৃণমূল খরচ করেছে ১৮ কোটি ৯৬ লক্ষ ৫৬ হাজার ৯৭৫ টাকা। প্রায় ১৯ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেষ দুই বছরে শাসক তৃণমূল কেবলমাত্র আকাশে উড়তেই ৫৪ কোটি টাকার বেশি খরচ করেছেন।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ইতিহাসে হেলিকপ্টারে করে কলকাতা থেকে চন্দননগরে মুখ্যমন্ত্রী বা শাসক দলের সাংসদের কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি প্রাইভেটে জেটে করে যাওয়ার নজির ছিল না। গত এক দশকে তা সহজলভ্য হয়েছে। আর ‘গরিবের দল’, ছবি বিক্রির টাকায় চলা দলের অডিট রিপোর্ট বলছে হেলিকপ্টারের পিছনেই ৫৪ কোটি টাকার বেশি খরচ করা হয়েছে।
এমনকি নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া ২০২১-২২’র অডিট রিপোর্ট বলছে তৃণমূলের তরফে নির্বাচনী খাতে ব্যয়ের হিসাবে দেখানো হয়েছে ১৩৫ কোটি ১২ লক্ষ ৮৮ হাজার টাকা। তার মধ্যে শুধু হেলিকপ্টার খরচই ৩৫ কোটির বেশি। আর নির্বাচনে সহায়ক পরিষেবা (সাপোর্ট সার্ভিস ফর ইলেকশন) খাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩৯ কোটি ৩৬ লক্ষ! ভোটের সময় দলের প্রচারের জন্য শুধুমাত্র বৈদ্যুতিন চ্যানেলে বিজ্ঞাপন বাবদ খরচ করা হয়েছে ১১ কোটির বেশি টাকা!
তবে আকাশে ওড়ার খরচ অর্থাৎ হেলিকপ্টার চড়ার বিল তৃণমূল সবথেকে বেশি মিটিয়েছে ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে। লোকসভা ভোটের বছর। জেলায় জেলায় হেলিকপ্টার করেই ঘুরে বেড়িয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া অডিট রিপোর্ট বলছে ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে শুধুমাত্র বিমান, হেলিকপ্টারের পিছনেই তৃণমূল খরচ দেখিয়েছেন ৪৩ কোটি ৫২লক্ষ ৬৮ হাজার ২১২ টাকা! তার আগের বছর অর্থাৎ ২০১৮-১৯ আর্থিক বছরে যদিও আকাশে ওড়ার খরচ একটু কম ছিল। ৭ কোটি ১৭ লক্ষ ৩৪ হাজার টাকার মতো।
অর্থাৎ শেষ চার বছরে শুধু হেলিকপ্টার চড়ার পিছনেই ‘গরিবের দল’ তৃণমূল কংগ্রেস খরচ করেছে ১০৫ কোটি টাকা!
মুখ্যমন্ত্রীর পাশাপাশি মূলত অভিষেক ব্যানার্জির হেলিকপ্টার চড়ার খরচই দাঁড়িয়েছে ১০০ কোটির বেশি! কিছুদিন আগেই প্রাইভটে জেট নিয়ে উত্তরবঙ্গ সফরে গিয়েছিলেন ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি। ভাইপো সাংসদ উত্তরবঙ্গ সফরে শিলিগুড়ি গিয়েছিলে বিলাসবহুল প্রাইভেট জেট নিয়ে। ‘বাজপাখি’র মতো দেখতে সেই প্রাইভেট জেট। তিনদিন ধরে সেই প্রাইভেট জেট বাগডোগরা বিমানবন্দরে পার্কিং করা ছিল। বিলাসের যাবতীয় ব্যবস্থা আছে ওই বিমানে। ভাড়া ৩১ লক্ষ টাকা। স্রেফ শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য হেলিকপ্টার খরচ ৩১ লক্ষ টাকা!
ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া মমতা ব্যানার্জির দলের অডিট রিপোর্টের সামনে এসেছে ২০২১-২২ আর্থিক বছরে তৃণমূলের মোট আয়ের ৯৬ শতাংশ এসেছে কেবলমাত্র নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। শুধুমাত্র একটি আর্থিক বছরে ৫২৮ কোটি ১৪ লক্ষ ৩০ হাজার টাকা তৃণমূলের কোষাগারে ঢুকেছে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে। নির্বাচনী বন্ড চালু হওয়ার পর থেকেই দেখা গিয়েছে বিজেপি’র পরে গোটা দেশে শাসক তৃণমূলের তহবিলেই নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে কর্পোরেট চাঁদার সিংহভাগ ঢুকেছে।
২০২০ সালের অক্টোবর মাসের ১৯ থেকে ২৮—এই দশদিনেই কলকাতার এসবিআই’র প্রধান শাখা থেকে বিক্রি হয়েছে ৩৬ কোটি টাকার নির্বাচনী বন্ড। এক কোটি টাকার ৩৫টি বন্ড এবং দশ লক্ষ টাকার ১০টি বন্ড বিক্রি হয়েছে কলকাতা থেকে। ২০২১’র ভোটে পশ্চিমবঙ্গে বিপুল টাকার স্রোতেই ইঙ্গিত ছিল তা। ২০১৯ সালের মে মাসের ৬ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত দেশের ৯টি শহরে এসবিআই ৮২২ কোটি টাকার বেশি নির্বাচনী বন্ড বিক্রি করেছিল। তাতে সবচেয়ে বেশি টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়েছিল কলকাতায়। মে মাসের প্রায় কুড়ি দিনে এসবিআই’র কলকাতা ওই শাখা থেকে ৩৭০ কোটিরও বেশি টাকার নির্বাচনী বন্ড বিক্রি হয়ে। ২০১৮ সাল থেকে নির্বাচনী বন্ড প্রকল্প আনার পরে সবথেকে বেশি লাভবান দল হলো বিজেপি, তারপরেই তৃণমূল কংগ্রেস।
অডিট রিপোর্টের তথ্য বলছে ২০১৯-২০ আর্থিক বছরে তৃণমূল কংগ্রেসের তহবিলে প্রায় ১০০ কোটি টাকা ঢুকেছিল নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে।
এর আগেও তৃণমূলের আয়-ব্যয়ের রিপোর্ট নিয়ে বিতর্ক দেখা দিয়েছিল। ২০১০-২০১৪ সাল পর্যন্ত শাসক তৃণমূলের আয়-ব্যয়ের নথি তলব করেছিল কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই। সেই সূত্রেই আসে চিট ফান্ড কাণ্ডের ‘বৃহত্তর ষড়যন্ত্র’র তদন্তে। তাতেও দেখা গিয়েছিল অনুদান খাতে তৃণমূলের আয় প্রতি বছর লাফিয়ে বেড়েছে। ২০১২-১৩ সালে তৃণমূলের সেই অনুদান বাবদ আয় বেড়ে দাঁড়ায় ৩৫ লক্ষ ১৫ হাজার টাকা। ঠিক তারপরের বছরই অনুদানের পরিমাণ একলাফে বেড়ে দাঁড়ায় ৯ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা। ওই ২০১৩-১৪ সালের অডিটে ধরা পড়েছিল একই দিনে দু’কোটি টাকা অনুদান নেওয়ার তথ্যও।
তৃণমূলের নির্বাচনী বন্ডে আয় বৃদ্ধির সঙ্গেই তবে কী কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে শিখণ্ডী, ভুয়ো সংস্থার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার যোগসূত্র আছে? গোরু, কয়লা কারবারের মাধ্যে কোটি কোটি টাকা পাচারের তদন্ত শুরু হওয়ার পরেই তৃণমূলের কোষাগারে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে আয়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করার পিছনেই এই প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে।
Comments :0