পরিমল ব্যানার্জি
১৯৯১ সাল থেকে নয়া উদার অর্থনীতি চালু হবার পর শ্রমিক শ্রেণি ও দেশবাসীর উপর রাষ্ট্রের আক্রমণের বিরুদ্ধে সিআইটিইউ সহ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি লাগাতার লড়াই চালিয়েছে। দেশে ২১টি সাধারণ ধর্মঘট পেরিয়ে আমরা ২২তম সাধারণ ধর্মঘটের মুখোমুখি। এদেশের শ্রমিক শ্রেণির আহ্বান ধর্মের নামে বিভেদ নয়, ধর্মঘটেই ঐক্য গড়ো, লুটেরাদের কবল থেকে দেশ-রাজ্য রক্ষা করো, ৯ জুলাই দেশব্যাপী ধর্মঘট সফল করো।
মোদী সরকারের জনবিরোধী, দেশ বিরোধী, সীমাহীন কর্পোরেট লুটের অধিকার দেওয়া আর্থিক নীতির ফলে শ্রমিক, কৃষক সহ সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকা বিপন্ন। ওষুধ সহ নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের রেকর্ড ভাঙা মূল্যবৃদ্ধি, তীব্র বেকারি, সামান্য মজুরি জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছে।
আরএসএস-বিজেপি’র গত ১০ বছরের শাসনে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য তীব্র হয়েছে। দেশে ক্ষুধা, অপুষ্টি, বেকারি সর্বকালীন রেকর্ড অতিক্রম করেছে। দেশের রাষ্ট্রায়ত্ব লাভজনক শিল্প, কলকারখানা নামমাত্র মূল্যে কর্পোরেট কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। ব্যাঙ্ক, বীমা, রেল, প্রতিরক্ষা, কয়লা ইস্পাত, বিদ্যুৎ, বিমান, বিমান বন্দর, ডক-পোর্ট, টেলিফোন, খনি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জঙ্গল, পাহাড়, ডুংরি, নদী, আকাশ কোনো কিছুই এই তালিকা থেকে বাদ যাচ্ছে না। সরকার খোলাখুলি আদানি-আম্বানি সহ দেশি বিদেশি পুঁজিপতিদের হয়ে জনগনের সঙ্গে বেইমানি করছে।
বিদ্যুৎ
বিদ্যুৎ শিল্পের বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে শ্রমিক কর্মচারীরা জানকবুল লড়াই করছেন। পিছনের দরজা দিয়ে বিদ্যুৎ ক্ষেত্রকে বিক্রি করার জন্য প্রিপেড স্মার্ট মিটার চালু করছে। কেরোসিন দুর্মূল্য, এবার সাধারণ মানুষকে আলোর থেকে আক্ষরিক অর্থে অন্ধাকারের দিকে নিয়ে যেতে চায় দুই সরকার। ধর্মঘট সফল করেই রুখে দিতে হবে এই অপপ্রয়াস।
ব্যবসা ও সাধারণ মানুষ
২০০৮ থেকে বিশ্বজোড়া মহামন্দার পরিস্থিতিতে গত ১০-১৫ বছরে মানুষের আয় কমেছে, করোনার আঘাতে এই আয় আরো তলানিতে। নোটবন্দি জিএসটি সহ বিভিন্ন করের চাপে ছোট বড়ো ব্যবসায়ী সহ জনগন নাজেহাল। অপরদিকে ধান্দাবাজ দুর্নীতিগ্রস্ত বন্ধু কর্পোরেট সহ অতি ধনী ব্যবসায়ীদের ১৬ লক্ষ কোটি টাকা ঋণ মকুব ও ট্যাক্স কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আইন করে অপরাধের দায় থেকে রেহাই দেওয়া হয়েছে। এরাই নির্বাচনী বন্ডের নামে বিজেপি তৃণমূলকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে।
শ্রমিক
ন্যূনতম মজুরি নেই, মজুরি বাড়ছে। বরং দামের চাপে প্রকৃত মজুরি কমছে। দীর্ঘ লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে শ্রম আইন আদায় করেছিল শ্রমিক শ্রেণি, মালিক শ্রেণির স্বার্থে সেই ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে ৪টি শ্রমিক বিরোধী শ্রমকোড তৈরি করেছে। এর ফলে ৮ঘন্টা কাজের অধিকার, ন্যূনতম মজুরির অধিকার, ক্ষতিপূরণের অধিকার, ইউনিয়ন গড়ার অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার সব কিছুই আক্রান্ত। এক কথায় শ্রমিকদের দাসশ্রমিকে পরিণত করা লক্ষ্য। রাজ্য সরকার এই ষড়যন্ত্রে নিষ্ঠুর ভাবে শামিল। ।
কৃষক
নব্বইয়ের দশকে চালু জনবিরোধী কর্পোরেটমুখী উদার অর্থনীতির হাত ধরে কৃষি ও কৃষক সমাজের উপর আক্রমণ নতুন রূপ নেয়। কৃষক বিরোধী আইন সংসদে পাশ করিয়েছিল, ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলনের চাপে এই আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ফসলের দাম থেকে ঋণ মকুব, কৃষি উপকরণের দাম কমানো কিছুই পাওয়া যায়নি। বিপর্যস্ত দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা। একমুঠো ভাত, দুটো রুটির জন্য জনগনকে নির্ভর করতে হবে পুঁজিপতিদের মর্জির উপর।
খেতমজুর
কাজ নেই খেতমজুরদের। বামপন্থী সাংসদদের চাপে চালু ১০০ দিনের কাজ রাজ্যের দুর্নীতি আর কেন্দ্রের পরিকল্পিত চক্রান্তে বন্ধ। যদিও আইনি লড়াইয়ে আদালত ১ আগস্ট ২০২৫ থেকে আবার কাজ শুরু করতে বলেছে। কিন্তু এই দুই সরকার পদে পদে বাধা সৃষ্টি করবেই।
শিক্ষা
দেশে ও রাজ্যে স্কুল বন্ধ করে জনশিক্ষার কাঠামো ভাঙা হচ্ছে। খুলছে বেসরকারি স্কুল, পরের লক্ষ্য কর্পোরেট স্কুল। সেখানে শিক্ষকদের মাইনে নেই কিন্তু ছাত্র ছাত্রীদের খরচ করতে হবে বিপুল টাকা। এদিকে এরাজ্যে নতুন নিয়োগ নেই। বরং তৃণমূলের দুর্নীতিতে কাজ হারাচ্ছেন কর্মরত শিক্ষক শিক্ষাকর্মীরা। ক্যাম্পাসে আক্রান্ত ছাত্র- ছাত্রীরা। তার সাম্প্রতিক উদাহরণ, জেএনইউ, যাদবপুর, কসবা, আরজি কর সহ অসংখ্য।
স্বাস্থ্য
ওষুধ কোম্পানির নির্বাচনী বন্ডের নামে বিজেপি-তৃণমূলকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছে। সরকারি হাসপাতালের চরম সংকট। বেসরকারি হাসপাতালে লুট। আক্রান্ত শ্রমজীবী গরিব মানুষ।
কর্মসংস্থান
সব বেকারের কাজ, ২৬ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি, ১০ হাজার টাকা পেনশন, সর্বজনীন সামাজিক সুরক্ষা, প্রকল্প ও চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের স্থায়ীকরণ, বুনিয়াদী ক্ষেত্রকে রাষ্ট্রায়ত্ব রাখার দাবিও তলছে ধর্মঘট। দেশ এবং রাজ্যের সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য ধর্মঘট।
সংবিধান
আরএসএস আবার বলেছে দেশের সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র শব্দ দু’টি বাদ দিতে হবে। এই অভিপ্রায় দেশ বিরোধী, জনস্বার্থ বিরোধী, শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য বিরোধী। শ্রমকোড থেকে কৃষিআইন, ন্যায় সংহিতা সহ সব ক্ষেত্রেই কোম্পানির স্বার্থে অনেক রক্ত-প্রাণের বিনিময়ে। অনেক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত সংবিধান আজ আক্রান্ত। তাই এই ধর্মঘট সংবিধান রক্ষার, দেশ রক্ষার, মানুষকে রক্ষার ধর্মঘট।
Comments :0