তৃণমূল-বিজেপি’কে ভোটে জেতানোর কারিগর প্রশান্ত কিশোরের নাম দুই রাজ্যের ভোটার তালিকায় থাকলেও যারা সংশোধন করতে পারেনি, তারা ভোটার তালিকা থেকে গরিবের নাম বাদ দিতে কাগজ দেখাতে বলছে কোন স্পর্ধায়? শুক্রবার বহরমপুরে সাংবাদিকদের কাছে এই প্রশ্ন তুলে সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম বলেছেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে আমরাও চাই নির্ভুল ভোটার তালিকা তৈরি হোক, যারা মারা গিয়েছে কিংবা যাদের নাম একাধিক জায়গায় রয়েছে সেগুলি বাদ দিতে হবে। সরকার চাইলেই এ কাজ করতে পারতো। নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছ থেকে, শ্মশান কবরস্থান থেকে মৃতদের নামের তালিকা সংগ্রহ করে নিয়ে মৃতদের নাম বাদ দিতে পারতো। তার বদলে জীবিতদের নাম, প্রকৃত ভোটারদের নাম বাদ দিতে তাঁদের নাগরিকত্বের প্রমাণ চাইছে। প্রশান্ত কিশোরে নাম দুই রাজ্যের ভোটার তালিকায় রয়েছে, সেটা বাদ দিতে পারে না, আর যে গরিব মানুষের ঘর নদী ভাঙনে ভেঙে যাচ্ছে, বন্যায় ভেসে যাচ্ছে, তাদের কাছে কাগজ দেখতে চাইছে!
এদিন মুর্শিদাবাদের বেলডাঙায় প্রয়াত সিপিআই(এম) নেতা কমরেড শাফিকুর রহমানের স্মরণসভায় এসআইআর ঘিরে আরএসএস বিজেপি এবং তৃণমূলের মেরুকরণের রাজনীতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন মহম্মদ সেলিম। ঐতিহাসিকভাবে নাগপুরের হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যর বিপদ স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রয়াত কমরেডের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য বিভাজনের রাজনীতি মোকাবিলার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, আরএসএস কখনোই দেশের বহুত্ববাদকে স্বীকার করে না, তারা বরাবরই দেশের চরিত্র বদল করে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতে চায়, হিন্দু ছাড়া বাকিদের ভোটাধিকার কেড়ে নিতে চায়। ফ্যাসিস্তদের মতই আরএসএস-বিজেপি সর্বজনীন ভোটাধিকার কেড়ে এক একদল মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করতে চায়। এখন এসআইআর ঘিরে সেই কারণেই মানুষের মধ্যে বিভাজন করতে চাইছে। আমরা বামপন্থীরা কোনোভাবেই এই উদ্দেশ্য সফল হতে দেবো না। ওরা মানুষকে আতঙ্কিত করতে চাইছে, আমরা বামপন্থীরা মানুষের পাশে থেকে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করবো।
এদিনই বহরমপুরে সাংবাদিকদের সেলিম বলেছেন, আরএসএস বরাবর হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্থানের ধারণা ভারতে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। ভাষা, ধর্ম, খাদ্য, পোশাক ইত্যাদি দেখিয়ে মানুষের মধ্যে ফারাক তৈরি করে একদল দেশবাসীকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক করতে চাইছে। ভোটার তালিকায় বাবা মায়ের নাম থাকলেও এই জন্যই সোনালি বিবিকে জোর করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে। শুধু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নয়, উদ্বাস্তুদেরও বেনাগরিক করছে বিজেপি। সমস্ত নাগরিকদের সম্পর্কে সন্দেহ জানিয়ে সবাইকে অপমান করা হচ্ছে।
এই সন্দেহ এবং আতঙ্কের পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি এবং তৃণমূল পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের মধ্যে রাজনৈতিক মেরুকরণ করছে বলেও সতর্ক করেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, উদ্বাস্তু, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, চর এলাকার বাসিন্দা, স্বল্পশিক্ষিত সব ধরনের প্রান্তিক মানুষকে এসআইআর’র নামে যখন কাগজ দেখানোর কথা বলা হচ্ছে, তখন মানুষ ঘাবড়ে যাচ্ছে, ভয় পাচ্ছে। আর এই ভয়ার্ত মানুষদের কাছে গিয়ে ওরা বলছে, ‘এদিকে এসো বাঁচাবো’। ওরা বাঁচাবে না, ওরাই বিভাজন করে মানুষকে বিপদে ফেলে তারপরে ত্রাতা সাজছে। স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি দশকে যে জনগণনা হয়ে এসেছে সেই জনগণনাই যারা করল না, তারাই নাগরিকপঞ্জির কথা বলছে। ক্রনোলজি বুঝিয়ে সেই সূত্র ধরে সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে এসআইআর করছে। ভোটার তালিকা নির্ভুল করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের, তারা সেই দায়িত্ব পালন না করে নাগরিকত্ব খুঁজতে নেমেছে। নিজেদের দায়িত্ব মানুষের ঘাড়ে চাপাচ্ছে। এই বিপদ থেকে তৃণমূল বিজেপি’র কেউ মানুষকে রক্ষা করবে না। ভোটার তালিকায় যে লক্ষ লক্ষ মৃত ভোটারের নাম রয়েছে বুথে তাঁদের ভোট তৃণমূল দিয়ে দেয়। এখন বিএলএ দেওয়ার বদলে তৃণমূল প্রশাসনকে ব্যবহার করে নিজেদের বিএলও বানানোর চেষ্টা করছে। বামপন্থীরাই মানুষের পাশে থাকবে সবার ভোটাধিকার রক্ষার জন্য। উত্তরবঙ্গে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে দুর্গতদের ত্রাণের কাজের পাশাপাশি এসআইআর’এর সময় হেনস্তা রুখতেও বামপন্থীরা শিবির করবে।
আরএসএস’র এই দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার অংশ হিসাবে তৃণমূলকে চিহ্নিত করে সেলিম বলেছেন, ২০০৩ সালে এই প্রক্রিয়া শুরু করেছিল অটল বিহারী বাজপেয়ীর সরকার। সেই সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় ছিলেন বিজেপি সঙ্গী মমতা ব্যানার্জি। আরএসএস’র অ্যাজেন্ডা তুলে ধরতে পশ্চিমবঙ্গের ভোটার তালিকায় অনুপ্রবেশকারীর কথা বলে লোকসভায় ভোটার তালিকার বান্ডিল ছুঁড়েছিলেন তিনিই। গণহত্যার পরে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী মোদীকে ফুল পাঠিয়েছিলেন তিনিই।
এদিন বেলডাঙার প্রয়াত কমরেড শাফিকুর রহমানের স্মরণসভা হয়। সিপিআই(এম)’র বেলডাঙ্গা জোনাল কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক, পার্টির জেলা কমিটির প্রাক্তন সদস্য শাফিকুর রহমান গত ২৫ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন। স্মরণসভায় মহম্মদ সেলিম ছাড়াও বক্তব্য রাখেন পার্টির জেলা সম্পাদক জামির মোল্লা, প্রাক্তন জেলা সম্পাদক নৃপেন চৌধুরি, পার্টি নেতা তুষার দে, গোরাচাঁদ ঘোষ, বেলডাঙার প্রাক্তন বিধায়ক সফিউজ্জামান। সভা পরিচালনা করেন শাজাহান আলি। উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত পার্টি নেতার পরিবারের সদস্যরাও।
এদিন বহরমপুরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে সেলিম বলেছেন, একশো দিনের কাজ চালু করতেই হবে। বিজেপি দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে ছাড় দিয়ে রাজ্যের মানুষকে শায়েস্তা করতে কাজ বন্ধ করেছে। মানুষ যখন কাজ চাইছে, রাস্তা, স্কুল, হাসপাতাল চাইছে, উত্তরবঙ্গে বিপর্যস্ত মানুষ পুনর্বাসন চাইছে, সেই সময় কেন্দ্র আর রাজ্যের সরকার এসআইআর চাপিয়ে দিচ্ছে। দক্ষিণপন্থীরা চায় না সবার সব অধিকার থাকুক। তাই রাজ্যের শাসকদল পুলিশ, প্রশাসন, গুন্ডাদের কাজে লাগিয়ে ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। কেন্দ্রের শাসকদল নির্বাচন কমিশনকে কাজে লাগিয়ে ভোটার তালিকা থেকেই নাম বাদ দিতে চাইছে।
Md Salim on SIR
বিভাজন তৈরি করে মানুষকে বিপদে ফেলে ত্রাতা সাজছে বিজেপি-তৃণমূল
শুক্রবার বেলডাঙায় প্রয়াত কমরেড শাফিকুর রহমানের স্মরণসভায় বলছেন মহম্মদ সেলিম।
×
Comments :0