মণিপুরের পরিস্থিতি সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে শনিবার ওই রাজ্যে যাচ্ছে ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চের ২০ সাংসদের প্রতিনিধিদল। দু’দিনের সফরে বিরোধী সাংসদরা হিংসা কবলিত ওই রাজ্যের বাস্তব পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে সংসদে জানাবেন, সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায় সেই সুপারিশও করবেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। বিরোধী সাংসদদের প্রতিনিধিদলকে নেতৃত্ব দেবেন কংগ্রেসের অধীর রঞ্জন চৌধুরি।
আবার বিরোধীরা ওখানে গিয়ে ‘উত্তেজনা’ যেন বাড়িয়ে না দেন বলে শুক্রবার হালকা হুমকি ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে বিজেপি’র পক্ষ থেকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র্র মন্ত্রী অমিত শাহ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী কিংবা বিজেপি’র অন্য কোনও শীর্ষ নেতা হিংসায় দীর্ণ মণিপুরে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করেননি এতদিনেও, সেখানে বিরোধী সাংসদরা যাচ্ছেন বলে তাঁদের আটকানোর নানা ছলচাতুরি চলছে। অথচ এই হিংসার মধ্যেই প্রথমে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এবং পরে বামপন্থী সাংসদরা ওই রাজ্যে গিয়ে দুর্গত মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে এসছেন।
এদিন যাওয়ার আগে লোকসভার কংগ্রেসের উপ দলনেতা গৌরব গগৈ মণিপুরের হিংসা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। এরই সঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মণিপুরের পরিস্থিতি বেশ ‘স্বাভাবিক’, এটাই তুলে ধরার চেষ্টা করছে বিজেপি। কিন্তু ওখানে হিংসা থামেনি। ওখানে কীভাবে রাজ্য সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলায় ব্যর্থ হলো, ওখানকার একাংশের হাতে কীভাবে অত্যাধুনিক অস্ত্র এলো, প্রশাসনই বা কী করছে—এসব জানতে শীর্ষ আদালতের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিকে দিয়ে তদন্তের দাবি জানানো হয়েছে একারণেই।’’ মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং নিজেই স্বীকার করেছেন যে হিংসার ঘটনায় ১০০-রও বেশি এফআইআর দায়ের হয়েছে। গগৈ এদিন মুখ্যমন্ত্রীর ওই কথার সূত্র ধরেই বলেন, ‘‘তাহলে দু’মাস ধরে প্রশাসন ঘুমিয়ে রইল কীভাবে? সেটাই তদন্ত হওয়া দরকার। এরই সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদরা ওখানে গিয়ে পরিস্থিতির মূল্যায়ন করে সংসদে জানাবেন।’’
‘ইন্ডিয়া’র প্রতিনিধিদলে অধীর চৌধুরি ছাড়াও কংগ্রেসের পক্ষ থেকে গৌরব গগৈ ও ফুলো দেবী নীতম, জনতা দল (ইউ)-র লালন সিং ও অনিল হেগড়ে, তৃণমূলের সুস্মিতা দেব, ডিএমকে’র কানামোঝি, সিপিআই(এম)’র এ এ রহিম, সিপিআই’র সন্দোশ কুমার, আরজেডি’র মনোজ ঝা, সমাজবাদী পার্টির জাভেদ আলি খান, জেএমএম’র মহুয়া মাজি, এনসিপি’র মহম্মদ ফইজল, আইইউএমএল’র মহম্মদ বশির, আরএসপি’র এন কে প্রেমচন্দ্রন, আপ’র সুশীল গুপ্ত, শিবসেনা (উদ্ধব)-র অরবিন্দ সাবন্ত, ভিসিকে’র রবি কুমার ও থিরুমাভালাম এবং আরএলডি’র জয়ন্ত চৌধুরি যাচ্ছেন মণিপুরে। তাঁরা ওখানে আশ্রয় শিবিরগুলিতে যেতে চান ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলার জন্য। এখনও পর্যন্ত প্রশাসন এবিষয়ে সায় দেয়নি।
মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতির দাবিতে অনড় বিরোধীরা। ‘ইন্ডিয়া’র তরফে লোকসভায় অনাস্থা প্রস্তাবও দাখিল করা হয়েছে। বস্তুত, আস্থা-অনাস্থার প্রশ্ন নয়, বিরোধীদের মূল লক্ষ্য মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে মুখ খোলানো। মণিপুরে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটিয়ে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে সংসদের বাদল অধিবেশন শুরুর দিন চত্বরে মোদীর ‘কুমিরের কান্না’র পরেই আবার নিশ্চুপ হয়ে গিয়েছেন। তবে মোদী নীরব হলেও বিরোধীরা মণিপুর নিয়ে সরব। তাঁরা মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং-য়ের অপসারণেরও দাবি করেছেন।
প্রতিদিনই মণিপুরকে ঘিরে অচল হয়ে পড়ছে সংসদ। এদিনও বিরোধীদের প্রতিবাদে বারংবার মুলতবি হয়ে যায় লোকসভার অধিবেশন। এদিন সকালে অধিবেশন শুরুর সঙ্গে সঙ্গে ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদরা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরুর দাবি জানাতে থাকেন। অধ্যক্ষ ওম বিড়ালা তাঁদের বাধা দিয়ে উলটে জানতে চান, ‘‘আপনারা কি অধিবেশনের কাজ সুষ্ঠুভাবে করতে দেবেন না?’’ কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরি পালটা বলেন যে, ‘‘১৯৭৮ সালে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনার সঙ্গে সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।’’ তখন সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশী দাবি করেন, ‘‘সব কিছু বিধি মেনেই হচ্ছে। আপনাদের সংখ্যা থাকলে পেশ করা বিলকে হারিয়ে দিন।’’ সরকার ও বিরোধীপক্ষের তীব্র বাদানুবাদে ফের মুলতবি হয়ে যায় লোকসভার কাজ। মণিপুর নিয়ে একই পরিস্থিতি হয় রাজ্যসভাতেও। পরে রাজ্যসভাও মুলতবি হয়ে যায়। মণিপুর নিয়ে সরকার চাইছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহকে দিয়ে বিবৃতি দিয়ে দায় এড়াতে। কিন্তু সরকারের সেই উদ্যোগ মানতে নারাজ বিরোধীরা।
সংসদ দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার দিন স্থির হতে পারে সোমবার। সূচি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীর মঙ্গলবার মহারাষ্ট্র যাওয়ার কথা। এজন্য অনাস্থা প্রস্তাবের উপর বুধ এবং বৃহস্পতিবার আলোচনা, জবাব এবং ভোটাভুটি হতে পারে। সংসদের বাদল অধিবেশন চলবে আগামী ১১ অগস্ট পর্যন্ত।
মোদী সরকারের বিরুদ্ধে এদিনও কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী অভিযোগ করেছেন, ‘‘এই সরকার ক্ষমতালোভী। এরা নারীদের মর্যাদাকে হেয় করে। এমনকি মহিলাদের আত্মনির্ভরতাকেও খর্ব করতে চায়।’’ ফেসবুকে হিন্দিতে এক পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘‘যে দেশ মহিলাদের সম্মান জানায় না সেই দেশ এগতে পারে না।’’
এদিকে, মণিপুর নিয়ে সরকার বা প্রধানমন্ত্রী নির্লিপ্ত থাকলেও বিরোধীরা ক্রমাগত বিঁধে চলেছে কেন্দ্রকে। এজন্য সরকারপক্ষও এখন ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চকে হেয় করতে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিদিন নিয়ম করে ‘ইন্ডিয়া’-কে কালিমালিপ্ত করতে ব্যস্ত। এমনকি বিরোধীরা মণিপুর যেতে চাইলেও বাধা দিচ্ছে সরকার। এদিন বিজেপি সাংসদ রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেছেন, ‘‘ ওঁরা ওই রাজ্যে যান আপত্তি নেই। তবে পরিস্থিতি যেন আরও ঘোরালো না করে দেন।’’ এর সঙ্গে সংসদকে জড়িয়ে তিনি দাবি করেন, ‘‘বিরোধীরা প্রতিদিন সংসদে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে মণিপুর নিয়ে। ওখানে যেন সেই কাজটা না করেন।’’ রবিশঙ্করের কথাতেই হালকা হুমকির সুর রয়েছে। দলের আরেক সাংসদ রবি কিষাণের শ্লেষ, ‘‘ওঁরা পাকিস্তান কিংবা চীনেও যেতে তো পারেন।’’
Comments :0