Tebhaga Andolan

তেভাগা আন্দোলনের রাজনৈতিক শিক্ষা

ফিচার পাতা

Tebhaga Andolan

‘প্রায় শ‘দেড়েক লোক জড়ো হলো। ছেলে বুড়ো সকলের হাতেই লাঠি আর কাস্তে। পাঁচ ছ’বছরের বাচ্চা ছেলে, তার হাতেও লাঠি, নয় ঝান্ডা।
মাঠের মাঝে লাল ঝান্ডা ওড়ানো হলো। ঝান্ডা দিয়ে জমির সীমা নির্দেশ করা হলো। এক জায়গায় লাঠিগুলো পোঁতা হলো। ধ্বনি দিয়ে কাস্তে হাতে সবাই নেমে পড়লো মাঠে। গান শুরু হলো, ‘চাষি রে তোর সাল সেলাম তোর লাল নিশান রে’।
এই হলো তেভাগার বাংলার গ্রামে গ্রামের ছবি। লিখে গেছেন সোমনাথ হোর, তাঁর তেভাগার ডায়েরি-তে। ‘তেভাগা’ — অর্থাৎ উৎপন্ন ফসলের দুই-তৃতীয়াংশে আধিয়ার বা বর্গাদারদের অধিকারের দাবিতে আন্দোলন, নেতৃত্ব দিয়েছিল কৃষকসভা ও কমিউনিস্ট পার্টি। তৎকালীন বাংলার ২৬টি জেলার মধ্যে ২৫টিতেই আন্দোলনের কম-বেশি প্রভাব পড়েছিল (সূত্র: তেভাগা আন্দোলন বিষয়ক যুক্তবাংলার ৮৬টি মহকুমার সরকারি প্রতিবেদন, মার্চ ১৯৪৭)। সবচেয়ে তীব্র আকার নিয়েছিল দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, রংপুর, যশোর, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর, হুগলী প্রভৃতি অঞ্চলে।
হঠাৎ করে শুরু হয়নি এই আন্দোলন। এর পিছনে কৃষকসভার কর্মীদের দীর্ঘদিনের নিরলস প্রচেষ্টার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কৃষকসভায় (বিপিকেএস) কমিউনিস্ট কর্মীরাই ছিলেন অগ্রণী অংশ। বাংলার প্রথম যুগের কমিউনিস্ট কর্মীদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত স্তর থেকেই এসেছিলেন। কিন্তু তাঁরা পেরেছিলেন সাধারণ দরিদ্র মানুষের দৈনন্দিন জীবন-সংগ্রামের সাথি হয়ে যেতে। কমিউনিস্ট কর্মীদের স্মৃতিকথাগুলি পড়লেই এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকে না। যেমন অবনী লাহিড়ী, উত্তরবঙ্গে তেভাগা আন্দোলন সংগঠিত করতে যিনি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। শহরের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ করে কীভাবে কৃষক-জীবনের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তাঁরা, জানিয়েছেন তিনি। তাঁর মন্তব্য, ‘এর আগে... মধ্যবিত্ত ঘর থেকে যে সমস্ত কর্মীরা (গ্রামে) যেতেন তাঁরা কৃষকের সঙ্গে কাজ করে আবার শহরে ফিরে আসতেন। ...আমরা সেই যে যুদ্ধের বছর ’৪১ সালে গ্রামে চলে গেলাম, শহরের সঙ্গে সম্পর্ক আমাদের একরকম ছিন্নই হয়ে গেল।’ সুশীল সেনের স্মৃতিচারণায় পাচ্ছি : ‘গ্রামে যখন এলাম, তখন ভাবিনি যে এরকম একটা পরীক্ষার মধ্যে আমাদের পড়তে হবে। কোনও একসময় একপাল শুয়োরের সাথে শুতে হবে, কোনও সময় গোয়ালঘরের মধ্যে গোরু-ছাগলের সাথে একসঙ্গে রাত কাটাতে হবে খড়ের বিছানায়। কৃষকরা যা খেত আমরা তার ভাগীদার হতাম— কোনও সময় হয়তো সে খাদ্যটা শুধুই পাটপাতার ঝোল।’ এইভাবে কৃষক জীবনের সঙ্গে একাত্মতা যেমন মধ্যবিত্ত ঘরের কমিউনিস্ট কর্মীদের ‘কৃষদের চোখ দিয়ে কৃষকদের সমস্যাগুলি’ বোঝবার সক্ষমতা দিয়েছিল, তেমনই গরিব কৃষকদের চোখেও স্পষ্ট হয়েছিল ‘কমিউনিস্ট নয় এমন সংগঠনের লোকজনের সঙ্গে কমিউনিস্ট কর্মীদের পার্থক্য।’
চল্লিশের দশকের সেই সময়টা এমন যখন কমিউনিস্ট পার্টি ‘জনযুদ্ধ’-এর স্লোগান তুলে বিয়াল্লিশের আন্দোলন থেকে দূরে সরে গেছে, আর তার ফলে প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির আকচা-আকচিতে কমিউনিস্টদের শুন‍‌তে হচ্ছে ‘দেশদ্রোহী’-র মতো গালাগাল ও নানারকমের কুৎসা। মধ্যবিত্ত সমাজের একটা বড় অংশ প্রভাবিতও হয়েছেন সেই প্রচারে। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে, গরিব কৃষকদের মধ্যে এই প্রচার ও কুৎসা কোনও রেখাপাত করেনি। কাকে বলবে তারা দেশদ্রোহী, যে-কর্মীরা মন্বন্তরের দিনে তাদের কাছে নিরলসভাবে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছে, যারা তাদের দৈনন্দিন জীবনের সুখ-দুঃখের লড়াই-সংগ্রামের সঙ্গী? বরঞ্চ এই একাত্মতা ও গণসংযোগই তেভাগার মতো সংগ্রামের সলতে পাকিয়েছে।
তবে, নিঃসন্দেহে তেভাগা আন্দোলন কৃষকসভার উচ্চতম নেতৃত্ব ও কমিউনিস্ট কর্মীদের চাপিয়ে দেওয়া আন্দোলন নয়। বঞ্চিত কৃষক ও বর্গাদারদের মরিয়া চাপই এই আন্দোলনকে এত জঙ্গি চরিত্র দিয়েছিল। ১৯৪০-এ প্রকাশিত হয়েছিল ফ্লাউড কমিশনের রিপোর্ট, যেখানে জোতদারের জমিদের চাষরত রায়তকে উৎপন্ন ফসলের উপর দুই-তৃতীয়াংশ অধিকারের দাবি সমর্থন করা হয়। ১৯৪৩ সালে কৃষকসভার নলিতাবাড়ি সম্মেলন থেকে তেভাগার দাবিতে ‘সমস্ত ভাগচাষিকে সংগঠিত করা’-র ডাক দেওয়া হয়। কিন্ুত সেই সময় একদিকে জনযুদ্ধের পার্টিলাইন অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ (‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’) এই ডাককে বাস্তবায়িত করার অবকাশ দেয়নি। যুদ্ধ থামার পরে, ১৯৪৬-এর সেপ্টেম্বর মাসে কৃষকসভা আন্দোলনের ডাক দেয়। গবেষকরা স্বীকার করেন, কৃষকসভার তৃণমূল স্তরের নেতৃত্বের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল এ ক্ষেত্রে। ‘নিচের তলার চাপ’ ও স্থানীয় নেতৃত্বের জঙ্গি মনোভাব ছাড়া আন্দোলনের এত দ্রুত ও ব্যাপক প্রসার সম্ভব ছিল না।
বস্তুত, তেভাগা আন্দোলনের মধ্যে দু’ধরনের নেতৃত্বের দেখা মেলে। একটি, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীবৃন্দ, যাঁরা বাইরে থেকে এসেছিলেন কৃষকদের সংগঠিত করতে। আর একটি স্থানীয় নেতৃত্ব। এই দ্বিতীয় ধরনের মানুষরাই তেভাগা আন্দোলনের মূল শক্তি। জমিদার-জোতদারদের লেঠেল বাহিনী ও পুলিশের অত্যাচার ও বাধার মুখে অপরিসীম বীরত্বের সঙ্গে এরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে ও শহীদের মৃত্যুবরণ করেছে। এই সত্য স্বীকার করে নিয়ে হেমন্ত ঘোষাল লিখেছেন, ‘তেভাগা ছিল চাষি-মজুরের লড়াই। এতদিন ধরে তারা যা চেয়েছে, যা না পাওয়ার ব্যথায় গুমরে কেঁদেছে, তেভাগার লড়াই সেই ব্যথা-বেদনা-প্রতিবাদকেই ভাষা দিল। তাই এই লড়াইতে আমরা যারা তাদের সংগঠিত করতে উদ্যোগ নিয়েছিলাম, যারা বাইরে থেকে গিয়েছিলাম, গ্রামের সমস্ত পরিবার তাদের প্রাণের মানুষ বলে গ্রহণ করেছিল।’
বহিরাগত কমিউনিস্টদের এই ‘প্রাণের মানুষ’ বলে গ্রহণ করার নানা চিহ্ন আন্দোলনকারীদের স্মতিকথাগুলিতে ছ‍‌ড়ি‍‌য়ে আছে। হেমন্ত ঘোষালের স্মৃতিকথা থেকেই উদাহরণ দেব। চব্বিশ পরগনার মঠের দি‍‌ঘি অঞ্চলের যে-বাড়িতে রাতের আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি, সেই বাড়িতে একদিন পুলিশ হানা দেয়। সেই সময় ক’দিনের জন্য বাপের বাড়িতে এসেছিল সে-বাড়ির সদ্যবিবাহিত কন্যাটি। সেই মেয়ের স্বামীর পরিচয় দিয়ে হেমন্ত ঘোষালকে মশারির ভিতর ঢুকিয়ে দিলেন সে বাড়ির গৃহিণী। পুলিশ ঘরে ঢুকে দেখল বসন্ত রোগে আক্রান্ত স্বামীর মাথা কোলে নিয়ে সেই বধূ ‘স্বামীসেবা’ করছে। হেমন্ত ঘোষাল লিখছেন, ‘যে মেয়েটি সামন্ততান্ত্রিক রক্ষণশীল গ্রাম্য সমাজের মধ্যে দাঁড়িয়ে একজন পরপুরুষের সঙ্গে মশারির নিচে রাত কাটাতে এসেছিল, সে বা তার মা কেউই জান‍‌তো না এই অবরোধে শ্বশুরঘর করা চিরকালের মতো বন্ধ হয়ে যাবে কি না। তার মনেও কি দ্বিধা আসেনি, নিশ্চ‌য়ই এসেছিল। কিন্তু সেইসব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব অতিক্রম করে তারা বেছে নিয়েছিল লড়াই‌য়ের সেনাপতিকে বাঁচিয়ে রাখার গুরুদায়িত্ব।’
জমিদার-জোতদাররা গরিব মানুষের আন্দোলন ভাঙার জন্য সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলতে দ্বিধা করেনি।‍‌ কিন্তু সংগ্রামী কৃষকের ঐক্যে তা ফাটল ধরাতে ব্যর্থ হয়। চিত্রশিল্পী সোমনাথ হোরের ‘তেভাগার ডায়েরি’তে এমন নানা ঘটনার উল্লেখ আছে। তেভাগার আন্দোলনের সময়কালটির কথা ভাবুন। ১৬ আগস্ট (১৯৪৬)-এর ‘কলকাতা দাঙ্গা’ ঘটে গেছে, খুলনায় ছড়িয়েছে আরও তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী দাঙ্গা। কিন্তু তেভাগা অঞ্চলগুলি ছিল সাম্প্রদায়িক হানাহানি ও মেরুকরণ থেকে মুক্ত। খুলনার দাঙ্গাবাজরা যখন প্রাণভয়ে ভীত হিন্দুদের তাড়া করে কুমিল্লায় ঢুকতে চাইছিল, তখন হাসনাবাদে ‘ঢাল’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল মুসলমান কৃষকরা। কমিউনিস্ট কর্মীরা তো নাস্তিক, ধর্মীয় প্রথা-রীতিনীতি মানত না, তবু ধর্মপ্রাণ কৃষকরা সেদিন তাদেরই আপনজন ভেবেছিল, ধর্মের ধুয়ো-তোলা সাম্প্রদায়িক শক্তিকে নয়।
এ থেকে আমরা বোধহয় এই শিক্ষাই পাই যে, যদি কৃষকদের, সাধারণ খেটে-খাওয়া মানুষের জীবন সংগ্রামের পাশে থাকা যায়, তাদের নিত্যদিনের সুখ-দুঃখের সাথি হওয়া যায়, তাহলে দক্ষিণপন্থী শক্তি ও ‘বুর্জোয়া মিডিয়া’-র কমিউনিস্ট-বিরোধী নিরন্তর মিথ্যা-প্রচারও হালে পানি পায় না। সাধারণ মানুষ তখন তাঁদের অভিজ্ঞতা থেকেই শত্রু-মিত্র ঠিক চিনে নেন। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ও বিভাজনের আসল উদ্দেশ্যও তাঁরা ধরে ফেলেন। হেমন্ত ঘোষালের মন্তব্য দিয়েই সংক্ষিপ্ত আলোচনা শেষ করি: ‘গভীর কোনও রাজনৈতিক তত্ত্ব হয়তো তাঁদের (আন্দোলনকারী কৃষকদের) পড়া হয়নি, অনেকেরই এমনকি অক্ষরজ্ঞান পর্যন্ত ছিল না, কিন্তু জীবনের কঠোর কঠিন অভিজ্ঞতায় নিজস্ব শ্রেণিস্বার্থটি চিনে নিতে তাঁদের ভুল হয়নি। তাঁরা খুব সহজেই তাঁদের আন্তরিক আকাঙ্ক্ষায় বুঝে নিয়েছিলেন বন্ধু কে এবং শত্রু কে আর অনায়াসে সাফল্যের সঙ্গে পালন করেছিলেন তাদের ইতিহাসের নির্দিষ্ট ভূমিকা।’
তেভাগা আন্দোলনের পঁচাত্তর বছর উদ্‌যাপনের মুহূর্তে ইতিহাসের এই ‘শিক্ষা’ যেন বিস্মৃত না হই।

Comments :0

Login to leave a comment