Rahul Gandhi

মোদী সরকারকে দেশদ্রোহী বললেন রাহুল

জাতীয়

বিজেপি-আরএসএস’র এই সরকার ‘দেশভক্ত’ নয়, আসলে ‘দেশদ্রোহী’। এই শাসকের বিভেদ-রাজনীতির কারণেই টানা তিন মাস ধরে মণিপুর জ্বলছে। ওদের এই কুৎসিত রাজনীতিই মণিপুরে ‘ভারতমাতা’কে খুন করেছে। শুধু মণিপুর নয়, বিভেদের আগুন ছড়ানোর জন্য এখন সারা দেশেই কেরোসিন ছেটাচ্ছে মোদীর দল। বুধবার লোকসভায় ঠিক এই ভাষাতেই কেন্দ্রের সরকারকে আক্রমণ করলেন প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। তবে বিরোধীদের যুক্তির তীক্ষ্ণ বর্শাফলকের কথা আগাম আন্দাজ করেই সম্ভবত গতকালের মতো বুধবারও লোকসভার অধিবেশন থেকে পালিয়ে বেড়ালেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদী! 
‘মোদী-পদবি’ মামলায় আদালতের রায়ে সাংসদপদ ফেরত পাওয়ার পরে লোকসভায় এদিনই প্রথম বক্তৃতা দিতে উঠেছিলেন রাহুল গান্ধী। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা-বিতর্ক চলছে মঙ্গলবার থেকেই। খোদ প্রধানমন্ত্রী গরহাজির থাকলেও এদিন গোড়া থেকেই রীতিমতো আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে একের পর এক সমালোচনায় মোদী এবং তাঁর সরকারকে বিদ্ধ করতে থাকেন কংগ্রেস সাংসদ। রাহুলের চাঁচাছোলা বাক্যবাণে দৃশ্যতই বিব্রত শাসক শিবির বারেবারেই হট্টগোল বাধিয়ে তাঁকে বাধা দিতে চেয়েছে। এমনকি একাধিকবার উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর বক্তব্য ভণ্ডুল করে দেওয়ার চেষ্টা চালাতে দেখা গিয়েছে একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রকেও। কিন্তু যুক্তি, তথ্য, আবেগ আর ব্যঙ্গের মিশেলে কংগ্রেস নেতার ভাষণের সামনে শাসকের সব ছকই এদিন কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। 
প্রধানমন্ত্রী মোদীকে রাবণের সঙ্গে তুলনা করে রাহুল এদিন কটাক্ষ ছোঁড়েন, ‘‘সারা দেশে মাত্র দু’জনের কথা শোনেন মোদী। একজন অমিত শাহ, অন্যজন গৌতম আদানি। ঠিক যেমন রাবণ দু’জনের কথা কানে তুলতেন, মেঘনাদ এবং কুম্ভকর্ণ।’’ একই বিমানে আদানির পাশে বসা মোদীর একটি পুরানো ছবির পোস্টার দেখিয়ে রাহুল সভায় বলেন, ‘‘আদানি গোষ্ঠী ছাড়া মোদীজি বাকি ভারতের বক্তব্য শুনতেই চান না।’’ এসময় শাসক বেঞ্চের বিব্রত সদস্যরা আপত্তি তোলেন, এভাবে পোস্টার দেখানোটা সভার রীতিবিরুদ্ধ। তাঁদের কথা শুনে অধ্যক্ষ ওম বিড়লাও কংগ্রেস সাংসদকে সংযত হতে বলেন। তবে তাতে কান না দিয়ে ভারতের মহাকাব্য রামায়ণের উদাহরণ টানেন রাহুল। ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় শাসকপক্ষকে তিনি বলেন, মনে রাখবেন ‘‘হনুমান কিন্তু লঙ্কা পোড়ায়নি। লঙ্কা পুড়েছে রাবণের অহঙ্কারে। রাবণকে কিন্তু রাম হত্যা করেননি, নিজের অহঙ্কারেই তিনি শেষ হয়েছেন।’’
কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান হিসাবে মোদীর ভূমিকার তীব্র নিন্দা করে রাহুল বলেন, ‘‘আমি কয়েকদিন আগে মণিপুরে গিয়েছিলাম। আমাদের প্রধানমন্ত্রী এখনো সেখানে যাননি। উনি মণিপুরকে ভারতের অংশ বলেই গণ্য করেন না। আমি ‘মণিপুর’ কথাটা ব্যবহার করলাম বটে, কিন্তু বাস্তবে এখন আর মণিপুর বলে কিছু নেই! আপনারা মণিপুরকে ইতিমধ্যেই দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন। আপনারা মণিপুরকে ভেঙে ফেলেছেন।’’ রাহুল বলে চলেন, ‘‘আমি মণিপুরের ত্রাণশিবিরে গিয়ে সেখানকার মহিলা ও শিশুদের সঙ্গে কথা বলেছি। প্রধানমন্ত্রীর এই কাজ করার সময় হয়নি।’’ 
হিংসাদীর্ণ মণিপুরে সফরের মর্মন্তুদ অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে কংগ্রেস সাংসদ বলেন, ‘‘আমি একজন মহিলার কাছে ‘আপনার কি হয়েছে’ জানতে চাইলাম। উনি জানালেন, ওঁর ছোট ছেলে, একমাত্র সন্তান, ওঁর চোখের সামনেই তাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। সারা রাত নিজের সন্তানের মৃতদেহ বুকে আগলে বসেছিলেন তিনি। শেষপর্যন্ত হামলাকারীদের ভয়ে তিনি নিজের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ‘কিছু কি সঙ্গে আনতে পেরেছিলেন?’ জানতে চাওয়ায় তিনি জবাব দিলেন, ‘‘পরণের এই কাপড়টুকু, আর ছেলের একটা ফটো।’’
লোকসভায় রাহুল জানাতে থাকেন, ‘‘আরেকজন মহিলার কাছে একই প্রশ্ন রেখে বলেছিলাম, ‘আপনার কি হয়েছে?’ কোনও জবাব দেওয়ার আগেই তিনি কাঁপতে শুরু করে দেন এবং জ্ঞান হারান।’
‘‘মাত্র দু’টি উদাহরণ দিলাম’’ মন্তব্য করে রাহুল বলেন, ‘‘বিজেপি’র রাজনীতি শুধু মণিপুরকেই নয়, মণিপুরে হিন্দুস্তানকেও হত্যা করেছে।’’ দৃশ্যতই আবেগাপ্লূত রাহুল বলতে থাকেন, ‘‘ভারত হচ্ছে জনগণের কণ্ঠস্বর। আপনারা মণিপুরে সেই কণ্ঠস্বরকেই হত্যা করেছেন। তার মানে হচ্ছে, মণিপুরে আপনারা ভারতমাতাকেই হত্যা করেছেন।’’
এরপরেই আরও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে শাসকদলকে লক্ষ্য করে রাহুল বলেন, ‘‘মণিপুরের মানুষকে হত্যার মাধ্যমে আপনারা ভারতকেই হত্যা করছেন। আপনারা দেশভক্ত নন, আসলে দেশদ্রোহী। প্রধানমন্ত্রী মণিপুরে যেতে পারছেন না কারণ, উনি ওখানে হিন্দুস্তানকে হত্যা করছেন। আপনারা ভারতমাতার রক্ষাকর্তা নন, আপনারা হত্যাকারী।’’
এসময় শাসকদলের সাংসদরা হইচই বাধালে কংগ্রেস সাংসদকে সংযত থাকার ‘পরামর্শ’ দিয়ে অধ্যক্ষ মন্তব্য করেন, ‘‘মনে রাখবেন, ভারতমাতা আমাদের মা।’’ অধ্যক্ষের এই মন্তব্যের ঝটিতি জবাব দিয়েই রাহুল ফের বলতে থাকেন, ‘‘আমি তো মণিপুরে আমার মায়ের হত্যার কথাই বলতে চাইছি। মায়ের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিয়েই আমি বলছি, মণিপুরে আমার এক মা’কেই আপনারা খুন করেছেন। আমার এক মা (সোনিয়া গান্ধীকে দেখিয়ে) এই সভায় বসে রয়েছেন, আরেক মা ভারতমাতা মণিপুরে আপনাদের হাতে খুন হয়েছেন।’’ লক্ষণীয় শব্দচয়নে এর পরেই রাহুল শাসকদলকে বলেন, ‘‘আপনারা যতদিন না মণিপুরে হিংসা থামাতে পারবেন, ততদিন সেখানে আমার মা’কেই হত্যা করে চলবেন।’’
টানা ৩৭ মিনিটের ভাষণে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ চালিয়ে রাহুল বলেন, ‘‘সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দিলে ওঁরা একদিনের মধ্যেই মণিপুরে শান্তি ফিরিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু সরকার তো সে পথে হেঁটে সেনা মোতায়েন করলো না!’’
সাংসদপদ ফিরে পাওয়ার পরে সংসদে রাহুলের প্রথম বক্তৃতা শুনতে এদিন রাজ্যসভার বহু সদস্যকেও লোকসভার গ্যালারিতে ভিড় করে থাকতে দেখা যায়। গুরগাঁও এবং নুহ্‌তে সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক হামলার প্রসঙ্গ তুলে রীতিমতো ক্ষুব্ধ স্বরে রাহুল এদিন শাসকপক্ষকে বলেন, ‘‘আপনারা সর্বত্র কেরোসিন ছেটাচ্ছেন। মণিপুরে তো কেরোসিন ছড়িয়ে আগুনও জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এখন হরিয়ানাতেও একই কাজ করতে চাইছেন। দেশের সব জায়গায় আগুন লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সারা দেশেই ভারতমাতাকে হত্যা করার ছক কষেছেন আপনারা।’’
রাহুলের এই আক্রমণে বিব্রত বিজেপি সাংসদদের হইচইয়ের মাঝেই সটান উঠে দাঁড়ান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু। কংগ্রেস সাংসদের ভাষণের প্রবাহকে ভেস্তে দেওয়ার উদ্দেশে মন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘‘রাহুল যা বলে চলেছেন, সেজন্য তাঁর ক্ষমা চাওয়া উচিত। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে উগ্রপন্থার জন্য আসলে কংগ্রেসই দায়ী।’’ বক্তার ভাষণের মাঝপথে খোদ মন্ত্রী এভাবে বাধা দেওয়ায় ক্ষুব্ধ বিরোধী সাংসদরা সরাসরি অধ্যক্ষের টেবিলের সামনে চলে যান। সেখানে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন তাঁরা। কোন কোন কংগ্রেস সাংসদকে হুঁশিয়ারি দিতেও শোনা যায়, ‘‘আগামীকাল মোদী যখন জবাবী ভাষণ দেবেন তখন তাঁকেও একই কায়দায় বাধা দেওয়া হবে।’’
রাহুলের ভাষণের পরেই বলতে উঠে কেন্দ্রের মহিলা ও শিশু উন্নয়ন মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি কংগ্রেস সাংসদকে ‘‘মহিলা-বিদ্বেষী’’ আখ্যা দেন। বিস্ময়করভাবে তিনি অভিযোগ তোলেন, ভাষণের পরে সভা ছেড়ে যাওয়ার সময় রাহুল নাকি মহিলা সাংসদদের উদ্দেশে অশালীন অঙ্গভঙ্গি করেছেন! এব্যাপারে বিজেপি’র মহিলা সাংসদের মাধ্যমে অধ্যক্ষের কাছেও অভিযোগ জানানো হয়। তবে রাত পর্যন্ত এই অভিযোগের সমর্থনে লোকসভা টিভি’র কোনও ভিডিও ফুটেজ পেশ করতে পারেনি শাসক শিবির। মনে করা হচ্ছে, প্রাক্তন কংগ্রেস সভাপতির এদিনের আক্রমণাত্মক বক্তব্য থেকে সকলের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার কৌশল হিসাবেই এই অদ্ভূত অভিযোগ আমদানি করেছেন মন্ত্রী ইরানি।
এদিন লোকসভায় রাহুল গান্ধীর ভাষণের ৪০ শতাংশই সরকারি ‘সংসদ টিভি’তে দেখানো হয়নি বলে জোরালো অভিযোগ তুলেছে কংগ্রেস। দলের নেতা জয়রাম রমেশ এদিন টুইটার পোস্টে এই অভিযোগ তুলে মন্তব্য করেন,‘‘অনাস্থা-বিতর্কে এদিন মোট ৩৭ মিনিট বক্তব্য রেখেছেন রাহুল গান্ধী। তাঁর ভাষণের মাত্র ১৪ মিনিট ৩৭ সেকেন্ড দেখিয়েছে সংসদ টিভি’র ক্যামেরা। অর্থাৎ ৪০ শতাংশই ছাঁটাই! কিসের ভয় পাচ্ছেন মোদী?’’
‘‘অত্যন্ত খারাপ ঘটনা!’’ টুইটারে একথা লিখে রমেশ তথ্য দেন, ‘‘মণিপুর নিয়ে রাহুল গান্ধী এদিন মোট ১৫ মিনিট ৪২ সেকেন্ড বলেছেন। এর মধ্যে ১১ মিনিট ৮ সেকেন্ড, অর্থাৎ ৭১ শতাংশ সময়েই সংসদ টিভি’র ক্যামেরার মুখ ছিল অধ্যক্ষের দিকে ঘোরানো! মণিপুর নিয়ে রাহুলের বক্তব্য দেখানো হয়েছে মাত্র ৪ মিনিট ৩৪ সেকেন্ড!’’

Comments :0

Login to leave a comment