রাজ্যের মূলধারার মিডিয়ায় ব্রেকিং নিউজ আর হেডলাইনে স্কুলশিক্ষা ক্ষেত্রের নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে চর্চা এবং এ বিষয়ে আদালতে নিত্যদিনের কর্মকাণ্ড নিয়ে লেখালিখি কার্যত ভাতের পাতে লেবু, নুন, লঙ্কা দেওয়ার স্তরে পৌঁছে গেছে। সেই গত বছরের ১৭ জুলাই থেকে এই নিয়ে সংবাদ বিস্ফোরণের শুরু। রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত একজনের হরিদেবপুরের এক বহুতলের ফ্ল্যাটের মেঝেয় স্তূপীকৃত বান্ডিল বান্ডিল টাকা; স্রেফ একটি ফ্ল্যাট থেকে নোট গোনার মেশিনে নগদ গুনে, ট্রাঙ্কবন্দি করে ২১ কোটি ৯১ লক্ষ টাকা লরিতে তোলা, চ্যানেলে চ্যানেলে সেই অকল্পনীয় পরিমাণ টাকা উদ্ধার নিয়ে তত্ত্ব-তালাশ বাংলার রাজনৈতিক জীবনে এত রোমহর্ষক দুর্নীতিকাণ্ডের চাক্ষুষ সাক্ষী থাকার সুযোগ জনগণের আগে কখনো হয়েছে!
বেশ কয়েক বছর ধরে প্রাইমারি থেকে এসএসসি সর্বক্ষেত্রে শিক্ষকতায় নিয়োগ নিয়ে দুর্নীতি, অযোগ্যদের চাকরিপিছু বিপুল টাকার লেনদেন, টাকার বিনিময়ে মেরিট লিস্ট বদলে দেওয়া, সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়া, টাকা নিয়ে নিয়োগ পরীক্ষায় অকৃতকার্যদের পাশ করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি নিয়ে বেনিয়মের ভূরি ভূরি অভিযোগ জনপরিসরে ছিলই। স্কুল শিক্ষকদের মেধা তালিকায় দুর্নীতি নিয়ে ধরনা অবস্থান ও তার পর মামলা হয়েছে। এবং তৃণমূল স্বভাবসিদ্ধভাবেই একদিকে সবটাই ‘বিরোধীদের চক্রান্ত’ বলে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে গিয়েছে আর অপরদিকে ওদের মন্ত্রী, বিধায়ক নেতাদের টাকার বিনিময়ে চাকরি বেচা বাধাহীনভাবে চলেছে। কিন্তু চোখের সামনে এই বেআইনি নিয়োগজনিত অবিশ্বাস্য অর্থভাণ্ডার উন্মোচিত হওয়াটা বাংলার মানুষের চেতনার জগতে একটা মারাত্মক ঝাঁকুনি দিয়েছে। রাজ্যের মন্ত্রী গারদবন্দি হওয়ার মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে মধ্যশিক্ষা পর্ষদের সভাপতি জেলে যাবেন, সঙ্গী হবেন প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের সভাপতিও, সাথে থাকবেন একদা এসএসসি’র চেয়ারম্যান এবং বর্তমানে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমন পরিস্থিতি যে কোনও রাজ্যবাসীর কাছেই অভাবিত।
তারপর থেকে নিয়ম করে প্রাত্যহিক কোর্টের হস্তক্ষেপে নতুন নতুন বেপরোয়া অনাচারের তথ্য সামনে এসেছে ও আসছে। আরও কয়েকজন কেষ্টবিষ্টু এখন ফাটকে। লক্ষ লক্ষ টাকা উকিলের পেছনে ঢেলেও তারা সামান্য জামিনটুকু অব্দি করাতে পারছেন না। যে কোনও সচেতন নাগরিকের উপলব্ধির কাছে আজ এটাও স্পষ্ট, যে রাজ্যে মাননীয়ার অনুপ্রেরণা বা উদ্যোগ ছাড়া পাড়ার একটি বাসস্টপের শেড পর্যন্ত নির্মিত হয় না, সেখানে পার্থ-মানিক-সুবীরেশ-কল্যাণ ও সম্প্রদায় শয়ে শয়ে বা হয়তো হাজার হাজার কোটি টাকা তাঁর অলক্ষ্যে মানুষের কাছে থেকে আদায় করেছে, এরকম একটা ঘোষণা হজম করা বাড়াবাড়ি রকমের শক্ত।
আমাদের আজকের কথাটি অবশ্য একটু আলাদা। শিক্ষাক্ষেত্রে এবং নির্দিষ্টভাবে স্কুলশিক্ষার স্তরে চাকরিচোরেদের কুকীর্তি তো অনেক শুনলাম। আদতে এ সবের ফলে এবং এসব ছাড়াও বিবিধ দুর্নীতির ও নীতিগত অপদার্থতার কারণে স্কুল শিক্ষার চেহারাটা কেমন দাঁড়িয়েছে কয়েকটি খণ্ডচিত্রের মধ্যে তার একটু হিসাব নিকাশ করে নেওয়া বোধহয় জরুরি। আমরা অবশ্যই সেই চেষ্টা করব। কারণ দিনের শেষে তো স্কুলশিক্ষা ব্যবস্থার যেকোনও উত্থান বা পতনের ফলভোগী হয় ছাত্র-ছাত্রীরাই। তাদের অবস্থাটা রাজ্যে এখন কিরকম ?
সেক্ষেত্রে একনম্বর বিষয়টি বহুল আলোচিত। আজকের আধুনিক স্কুলশিক্ষায় পাঠক্রমের যে বিস্তার ও ব্যাপ্তি তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পড়াতে গেলে যোগ্যতা লাগে, লাগে পেশাদার প্রশিক্ষিত শিক্ষক। শিক্ষাক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীকে বঞ্চিত করে একজন অযোগ্য প্রার্থীর নিয়োগ মানে পরবর্তী কয়েক প্রজন্মের পড়ুয়াদের শিক্ষাগত দক্ষতার অবনমন ঘটে যাওয়া। তৃণমূল সরকার শুধু সেই হীন প্রক্রিয়ার রূপকার মাত্র নয়, আজ পর্যন্ত প্রাণপাত অপচেষ্টা চালাচ্ছে যাতে এই অবৈধ নিয়োগকে বহাল রাখা যায়।
এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গ। মাসখানেক আগের ঘটনা। হাইকোর্টে জনৈক বিচারপতির এজলাসে দাঁড়িয়ে পুরুলিয়ার স্কুল পরিদর্শক সাফ স্বীকার করে নিয়েছেন রাজ্য সরকারের উৎসশ্রী প্রকল্পে বদলির কারণে গোটা জেলার সব স্কুলের অবস্থাই খুব খারাপ। ৬০ শতাংশ শিক্ষকই বদলি নিয়ে অন্য জেলায় চলে গেছেন। বহু স্কুল উচ্চ মাধ্যমিক বিভাগ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত রক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রকল্পের সুবিধা নিয়ে পুরুলিয়ার গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত এলাকার স্কুল ছেড়ে বাড়ির কাছাকাছি চলে গিয়েছেন বহু শিক্ষক। কিন্তু প্রত্যন্ত এলাকার স্কুলে তেমনভাবে আসেননি শিক্ষক। একমুখী বদলি আছে, নিয়োগ নেই। তাই ঘাটতি পূরণ হওয়ার কোনও বাস্তবতা নেই। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলেও ক্লাস করানোর নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে ভর্তি হতে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের বাধ্য হয়ে বলতে হচ্ছে, “ভর্তি হতে পারিস, কিন্তু শিক্ষক নেই। তাই ক্লাস হচ্ছে না কেন প্রশ্ন তুললেও কিছু করতে পারব না।’’
ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা হল শুধু পুরুলিয়া নয় জেলায় জেলায় একই চিত্র। কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার। সোজা কথায় যে সরকার পোষিত স্কুলশিক্ষা গ্রাম বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থার হৃদপিণ্ড তা এই মুহূর্তে ভয়াবহভাবে বিকল। বদলির আড়ালে আর্থিক লেনদেন নিয়ে রসালো আলোচনার ঘনঘটায় এই কথাটি যেন হারিয়ে যাচ্ছে।
তিন নম্বর কথাটিও নজরে রাখুন। নিয়োগে দুর্নীতি নিয়ে রাজ্য আলোড়িত কিন্তু এই ওই বাহানায় বিদ্যালয়ে নিয়োগ প্রক্রিয়াই যে বহুলাংশে বন্ধ সে কথা কিন্তু উপেক্ষিত থাকছে। রাজ্যে ৩.৫ লক্ষ শিক্ষকের শূন্যপদ। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের ক্লাসে পড়ানোর উপযুক্ত শিক্ষকের ঘাটতির আকার সাংঘাতিক খারাপ। শেষ এসএলএসটি (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের লেবেল টিচার্স সিলেকশন টেস্ট) হয়েছে ২০১৬-র নভেম্বর-ডিসেম্বরে। তারপর টানা ছ’খানা বিবর্ণ শীতকাল পেরিয়ে গেল। এককালে বিদ্যালয় শিক্ষার উৎকর্ষ কেন্দ্র রাজ্যের পুরোপুরি সরকারী স্কুলগুলোতে –কলকাতার হিন্দু স্কুল, হেয়ার স্কুল বা বেথুন স্কুল থেকে কোচবিহারের জেনকিন্স স্কুল- নিয়োগ হয় পিএসসি বা পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে। শেষ নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি হয়েছে ২০১৫-তে। তাও বিশেষ এক ধরনের স্কুলের জন্যে। বিষয়শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে স্কুলের পর স্কুল। জেলায় জেলায়।
একসময়ে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক মধ্যবিত্তের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলশিক্ষার প্রতি টান ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। এখন সমস্যার চিত্র আরেকরকম। গত এক দশকে ইংরেজি মাধ্যমের নামী স্কুলগুলির অনেকেই মধ্যশিক্ষা পর্ষদ থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছে। কলকাতার সাউথ পয়েন্ট, গোখলে মেমোরিয়াল, বালিগঞ্জ শিক্ষা সদন, শ্রী শিক্ষায়তন, সেন্ট লরেন্স, সেন্ট জেভিয়ার্স আর পর্ষদের আওতাতেই নেই, সরে গেছে দিল্লি বোর্ডে। বাংলার পড়াশোনায় এগিয়ে থাকার নমুনা এখন এরকমই। নাগরিক চাহিদা ওইদিকেই। কারণ বোঝা দুষ্কর নয়। অন্যান্য সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতামূলক কথা ছেড়েই দিন, রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং জয়েন্টের শুরুর দিকের আসন পাওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের বেশিরভাগ দিল্লি বোর্ডের। আমাদের উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সংসদ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা নিজের রাজ্যের জয়েন্ট এনট্রান্স পরীক্ষার মেধা তালিকায় সংখ্যালঘু হয়ে যাবে ভেবেছিল কেউ?
পাড়ার স্কুলে শিক্ষকহীনতা একটা গা সওয়া বিষয় এখন। আবার আর একটা দিক প্রকট। এগারো- বারো ক্লাস আছে এরকম যে কোনও স্কুলে খবর নিন, রাজ্যের বোর্ডে বিজ্ঞান শাখায় ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যা হুড়হুড়িয়ে কমছে। নামকরা স্কুলে প্রচুর বিজ্ঞানের আসন খালি থেকে যাচ্ছে। বহু স্কুলেই একাদশ দ্বাদশে বিজ্ঞান শিক্ষকের চরম ঘাটতি। ২০১১ সালে বিজ্ঞান বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী ছিল ৩ লাখ মতো। এক দশক বাদে তার এক তৃতীয়াংশেরও কম। কেন? এগিয়ে বাংলা?
এতগুলি বিষয় নিয়ে গুরুতর সঙ্কটে রাজ্যের ছাত্র-ছাত্রীরা। অথচ রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে কী? অভিন্ন ইউনিফর্ম বিধি। কোনও ছাত্র কোনও স্কুলের নির্দিষ্ট আত্মপরিচয় ছিল ইউনিফর্ম। সঙ্গে স্কুলের মনোগ্রাম, শপথবাক্য সহ। এখন সবাই নীল সাদা 'ব'। সরকারের পোষিত স্কুলের প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণির ছাত্র-ছাত্রীরা ফ্রিতে জামাপ্যান্ট, স্কার্টব্লাউজ পাবে, তবে তা একছাঁচে ঢালা। তাসের দেশের ধরন। নীল সাদা 'ব'। গায়ে গায়ে একাধিক স্কুল থাকলে এবং গঞ্জ এলাকায় ইউনিফর্ম ছিল শনাক্তকরণের অন্যতম উপায়। সবাই নীল সাদা ‘ব’ হলে তা কি করে হবে? আচ্ছা এই ব্যবস্থা তো অষ্টম শ্রেণি অব্দি। তারপর এগুলি সাইজে না কুলোলে ছাত্র বা ছাত্রী কী পরে স্কুলে আসবে? স্কার্ট ছেড়ে সালোয়ার বা শাড়িতে উত্তীর্ণ ছাত্রীরা কোথা থেকে পাবে এই নীল সাদা ‘ব’? এখন থেকে সরকারি আর বেসরকারি স্কুলের প্রকট বৈষম্য ইউনিফর্মেও টের পাওয়া যাবে। এরা নীল সাদা ‘ব’ হলেও, ওরা যার যার তার তার। কেন ? শুনলাম চমৎকার বুদ্ধিদীপ্ত উত্তর দিয়েছেন রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী। তিনি বলেছেন যেহেতু বিজেপি শাসিত গুজরাট ও আসাম স্কুলে অভিন্ন ইউনিফর্মের ব্যবস্থা করেছে, তাই এরাজ্যে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার কোনও অধিকার কারো নেই। উত্তর শুনে মনে পড়ে গেল অন্ধকারের যে প্রকারভেদই করুন না কেন, ফিকে, গাঢ় যাই বলুন তা আসলে আলোহীনতা।
এই আলোহীনতার চিরজীবী হওয়ার স্পর্ধাকে চূর্ণ করতে না পারলে চিররুগ্ণ হয়ে যাবে বিদ্যালয় শিক্ষার অধিকার।
Comments :0