Tram Kolkata

নগরোন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ ছিল ট্রাম

কলকাতা


দীপংকর সিংহ  

১৮৭১ সালের জুলাই মাসের ৬ তারিখে সকাল এগারোটার সময়ে কলকাতা টাউন হলে ‘জাস্টিস অব পীস’-এর বিশেষ সভা বসেছিল, যার অন্যতম বিষয় ছিল গঙ্গার তীরের জমির মালিকানা কলকাতা পৌর কর্তৃপক্ষের। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল কলকাতার ট্রামের পত্তন। চেয়ারম্যান, স্যার স্টুয়ারট হগ শিয়ালদহ থেকে আর্মেনিয়ান ঘাট পর্যন্ত ট্রাম চলাচলের জন্য সরকারের নৈতিক অনুমতিপত্র সভায় পেশ করেন। উমেশ চন্দ্র দত্ত, জাস্টিস অব পীসের একজন সদস্য হিসাবে এই প্রস্তাব সমর্থন করেন ও সভা সর্বসম্মতিক্রমে চেয়ারম্যান হগকেই এই ট্রাম সংক্রান্ত নির্মাণ কাজ শুরু করার দায়িত্ব অর্পন করে। সেই সভায় ভারতীয়দের মধ্যে উমেশ চন্দ্র ছাড়াও ছিলেন রাজেন্দ্র লাল দত্ত, হীরালাল শীল, কৃষ্ণ দাস পাল, দুর্গা চরণ লাহা, রমানাথ ঠাকুর, আব্দুল লতীফ খান, দেবেন্দ্র মল্লিক ও আরও অনেকে। ১৮৫৭ সালের সিপাই বিদ্রোহের অব্যাবহিত পরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থেকে বৃটিশ সরকার ভারতের শাসনভার নিজেদের হাতে তুলে নেয় ও প্রশাসনকে আরও সংগঠিত করতে রাজধানী কলকাতায় নানা পরিকাঠামো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। বৃটিশ সরকার নিজেদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ দেখলেও এইসব পরিকাঠামো নির্মাণে সাধারণ মানুষেরও উপকার হয়েছিল। পানীয় জলের ব্যবস্থা, নিকাশী ব্যবস্থা, বন্দর নির্মাণ সমেত পথ ও পরিবহন ব্যবস্থার উন্নতিতে পরিকল্পনা সেই সময়ের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ, যা আজও এই শহরকে সচল রাখতে সহায়তা করে।
১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা শহরে কলকাতা পৌর সংস্থার উদ্যোগে ঘোড়ায় টানা ট্রামের চলা শুরু। শুরুতে মাল পরিবহনের কথা ভাবা হলেও যাত্রী পরিবহন দিয়েই চলা শুরু হয়। দশ মাস চলার পর অস্ট্রেলিয়া থেকে আনা ঘোড়া এই পরিবেশে অক্ষম হয়ে পড়ায় ট্রাম চলা বন্ধ হয়। ১৮৭৯ সালের ২ অক্টোবর কলকাতা পৌর সংস্থার সাথে দিলুইন প্যারিস, আলফ্রেজ প্যারিস ও রবিন্সন সুতার নামে তিনজনের কলকাতা শহরে রাস্তার বদলে ট্রাম লাইন পাতার জন্য একটি চুক্তি হয়। কারণ রাস্তার জমির মালিক হচ্ছে কলকাতা পৌর সংস্থা। পরে ট্রাম কোম্পানি তৈরি হলে এই তিনজন সব দায়িত্ব কোম্পানিকে হস্তান্তর করেন। পয়লা নভেম্বর, ১৮৮০ নতুন করে ট্রামের চলা শুরু হয় ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানির (সিটিসি) অধীনে। ১৮৮২ সাল থেকে স্টিম ইঞ্জিন চালিত ট্রাম পথে নামলেও ১৯০০ সালেই বিদ্যুৎ চালিত ট্রাম পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলা শুরু হয়। ১৯০২ সালের ২৭ মার্চ এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুরের পথে প্রথম বৈদ্যুতিক ট্রাম চলতে শুরু করে। এরপর একে একে যুক্ত হয় কালিঘাট, বেলগাছিয়া, স্ট্র্যান্ড রোড, ডালহৌসি (বর্তমান বিবাদি বাগ), খিদিরপুর। হাওড়ায় ট্রাম লাইনের পত্তন হয় ১৯০৫ সালের জুন মাসে হাওড়া স্টেশন থেকে বাঁধাঘাট পর্যন্ত ও ১৯০৬ সালে বর্ধিত হয় শিবপুর পর্যন্ত। লাইন পাতা হয় আহিরীটোলা, হাতিবাগান, ওয়েলেস্লি, মওলা আলি, নোনাপুকুর, মোমিনপুর, বেহালা, রাজাবাজার, মিরজাপুর এলাকায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে ওয়েলিংটন স্কোয়ার (সুবোধ মল্লিক স্কোয়ার), পার্ক সার্কাস, বড়বাজার, নিমতলা, বালিগঞ্জ ট্রাম লাইনে যুক্ত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও ট্রামের এলাকা শ্যামবাজার হয়ে গালিফ স্ট্রীট বিস্তৃত হয়। হাওড়া ব্রীজ নির্মাণের সুযোগে গঙ্গা পেরিয়ে কলকাতার লাইন ১৯৪৩ সালে হাওড়ার ট্রাম লাইনের সাথে যুক্ত হয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থা সরকার পরিচালন করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৫১ সালে ট্রাম কোম্পানির সাথে চুক্তি করে। ক্রমে নানা পদক্ষেপের পর ১৯৭৬ সালের ৮ নভেম্বর ট্রাম কোম্পানি সম্পূর্ণ সরকারের অধীনস্ত হয়। কলকাতা শহরে ট্রামের সাথে পরিপূরক পরিবহনের জন্য বাস পরিবহন চালু হয় ১৯২০ সালে। রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রনে কলকাতা রাষ্ট্রীয় পরিবহন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে ও ১৯৫৫ সালে সমগ্র বাস পরিবহন ব্যবস্থা সরকারী অধিগ্রহণ করার পর ১৯৬০ সালের জুন মাসে গঠিত হয় ক্যালকাটা স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্পোরেশন। 
এর পরেই শুরু হয় একে একে বিপরীতমুখী যাত্রা। ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর মাসে হাওড়ার ট্রাম ব্যবস্থা বন্ধ করে হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়। ট্রামের মোট পথ প্রায় ৬৮ কিলোমিটার থেকে কমে ৬২ কিলোমিটার হয়ে যায়। আরও কুড়ি বছর পরে ১৯৯৩ সালে হাওড়া ব্রীজ দিয়ে কলকাতা থেকে হাওড়া অভিমুখে ট্রামের যাতায়াত সম্পূর্ণ বন্ধ হয়। এরপর কখনো মেট্রো রেল, কখনো উড়ালপুল বা কখনো অন্য কোনো কাজের কারণে এক একটি অংশের ট্রাম চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। তবে ১৯৮৫ সালে কাঁকুড়গাছির নবনির্মিত আন্ডারপাস দিয়ে উল্টোডাঙ্গা ট্রাম ব্যবস্থায় যুক্ত হয়। ১৯৮৬ সালে জোকা পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয় ট্রামের লাইন ও ট্রাম লাইনের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৫৯.৫কিলোমিটার। এই সময় একটি প্রস্তাব হয়েছিল উল্টোডাঙ্গা থেকে ট্রাম বিধাননগরের করুণাময়ী ও আরও কয়েকটি এলাকায় ট্রাম ব্যবস্থা বিস্তৃত করার। 
সরকারি পরিবহন কোন দেশেই লাভজনক হিসাবে ধরা হয় না। কারণ রাষ্ট্রীয় পরিবহন ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সজীব থাকে, উৎপাদন ব্যবস্থা ও জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। সেখানেই পরোক্ষ লাভ। রাত বেশী হলে বা ভোর বেলায় বেসরকারি গণপরিবহন অমিল থাকলেও সরকারি পরিবহন ব্যবস্থার উপর নির্ভর করা যায়। প্রয়োজনের সময় সাধারণ মানুষের কাছে এই পরিবহনের সুযোগ পাওয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। সরকারি ট্রাম ও বাস- দুয়ের ক্ষেত্রেই মান, কুশলতা ও শ্রম বিভাগ বজায় রাখার দায় পালন করতে গিয়ে বেসরকারি ক্ষেত্রের থেকে খরচ অনেক বেশী হয়। এছাড়াও আরও কিছু কারণ নিশ্চয় আছেই। বেসরকারি ক্ষেত্রে যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্যের থেকে লাভ ক্ষতির গুরুত্ব বেশী থাকার ফলে পরিবহনের মান আমাদের মতো দেশে নীচু হয়। বাসের বসার আসন, পরিসর ও ওঠা-নামার ব্যাবস্থা ছাড়াও গাড়ির নীচু মানের যন্ত্রাংশ ও চাকা নিয়ে চলার কারনে বেসরকারি পরিবহনে দুর্ঘটনা বেশী। তবুও বিনিয়োগের অভাব ও সঠিক পরিচালনার ব্যর্থতার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে অপ্রতুলতা দেখা দেয়। কলকাতার পরিবহন ব্যবস্থা এর ব্যতিক্রম নয়।
কলকাতার সার্বিক পরিকল্পনার জন্য ১৯৬৬ সালে সরকারের কলকাতা মেট্রোপলিটান প্ল্যানিং অরগানাইজেশন ‘বেসিক ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান’ প্রকাশ করে। সেখানে কলকাতার গনপরিবহনকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল বেসরকারি পরিবহনের যথেচ্ছ চলাচল শহরের পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষতি করছে ও পরিবহনের গতি শ্লথ হচ্ছে। কিন্তু সেখানেই বলা হয়েছে যে ট্রামে সাধারণভাবে ৮০জন স্বাচ্ছন্দ্য নিয়ে যাতায়াত করতে পারলেও অনেক সময়েই দেখা যাচ্ছে প্রায় ২০০ জন যাত্রী একটি ট্রাম বহন করছে। সেই পরিকল্পনা দলিলেই মনে করানো হয় যে কলকাতায় যাত্রীর চাপ আরো বৃদ্ধি পেতে পারে ও সেই জন্য গণপরিবহন আরও উন্নত করতে হবে। সেখানেই প্রস্তাব হয় মেট্রো রেলের। কিন্তু কখনই এটা বলা হয়নি যে এই মেট্রো রেল অন্যান্য পরিবহনের বিকল্প হবে। রিপোর্টে বলা হয় যে পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে ট্রাম তুলে দিলেও নানাদিক বিচার করে ট্রামের প্রয়োজন থাকবেই ও বাস কখনই ট্রামের বিকল্প নয়। শুধু তাই নয়, বলা হোল, চিৎপুর ও কলেজ স্ট্রীটের মতো জনাকীর্ণ সংকীর্ণ পরিসরে ট্রাম সব থেকে সহজ পরিবহন। ট্রামের লাইন আরও কিছু দিকে বিস্তৃত করার প্রস্তাবও দেয়া হলো। বলা হলো, বাস বা ট্রাম, উভয়ের জন্যই সংরক্ষিত পরিসর থাকা উচিত। 
সেই সময় শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থাকে তিনটি স্তরে ধরা হয়েছিল। বাস, ট্রাম ও শহরতলির রেল ব্যবস্থা। তার সাথে মেট্রো রেলকে আরও একটি স্তর হিসাবে যুক্ত করার প্রস্তাব করা হয় আগামী দিনের চাহিদার কথা মাথায় রেখে। সারা পৃথিবীতেই পরিবহন ব্যবস্থা বিভিন্ন স্তরের মিশ্রণ হিসাবেই গড়ে তোলা হয়। প্রতিটি স্তর একটি নির্দিষ্ট অংশের যাত্রীদের চলাচল সুগম করে। কোন ব্যবস্থাই একশো শতাংশ পরিবহন করে না, বিশেষ পরিস্থিতির কথা মনে রেখেই কোন পরিবহন ব্যবস্থারই সাধারণভাবে পূর্ণ ক্ষমতা ব্যবহার করার কথা ভাবা হয় না। সাধারণভাবে ক্ষমতার তুলনায় কম যাত্রীবহন করবে ধরে নিয়েই চলাচল করে। হঠাৎ কখনো কোন একটি ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে অন্যান্য ব্যবস্থাগুলি অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারে। এটাই স্থিতিশীল পরিবহন বিজ্ঞানের ভাবনা। এখানে একটি স্তর অন্যটির পরিপূরক হিসাবে কাজ করে। পরস্পর প্রতিযোগিতামূলক হিসাবে কাজ করতে থাকলে সামগ্রিক ব্যবস্থা অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও অস্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ হতে বাধ্য। আর তার প্রভাব সমগ্র জনজীবনে ছাপ ফেলে শহরের জীবন যাত্রার মান নিম্নগামী করে দিতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন বলা হচ্ছে, মেট্রো চলাচল করলে বাস বা ট্রামের প্রয়োজন নেই। তাঁরা খেয়াল করছেন না, যে শহরের বিপুল অংশের জনজীবনে নিঃশব্দে এর কি বিপুল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। মেট্রোর সাথে এই সময়ে কলকাতা শহরে বিভিন্ন অংশের যোগাযোগের জন্য অটো রিক্সা বহুল পরিমাণে যাত্রী পরিবহন করছে। কিন্তু শহরের যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য, সুরক্ষা ও পরিবহনের মানের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা অত্যন্ত নিম্ন হওয়ার কারণে কলকাতা শহর আকর্ষণ হারাতে বাধ্য। এরফল সাধারণ মানুষের উপরেই মূলত পড়ে। কিন্তু শহর যদি আকর্ষণ হারায়, তাহলে শুধু সাধারণ মানুষই ক্ষতিগ্রস্ত হন না, যারা ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে চলাচল করেন, তাঁদের উপরেও পরোক্ষ প্রভাব পড়ে। অবৈজ্ঞানিকভাবে পরিবহনের অঙ্গহানি সামগ্রিক ক্ষতির মুখে ঠেলে দেয়। হয়তো অনেকসময় ফলাফল বোঝা যায় দেরিতে। তাই আজ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ও এমনকি আমাদের দেশেও বিভিন্ন শহরে ট্রাম ফিরিয়ে আনার কথা চলছে। দুর্ভাগ্যবশত এরাজ্যের সরকার উল্টো পথে হাঁটছে।
কলকাতা শহরে ২০০৭ সাল নাগাদ সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল যে সংরক্ষিত পথে ট্রাম যথেষ্ট গতিতে চলে থাকে। ২০০১ সালে ট্রাম প্রায় ২ লক্ষ যাত্রী পরিবহন করতো। পরিকল্পনা অনুযায়ী আশা করা হয়েছিল ২০১১ সালের পরে ট্রামের যাত্রী সংখ্যা ১০ লক্ষ হয়ে যাবে।  ২০০৭ সালে ৫৯.৫ কিলোমিটার লাইনে প্রায় ১৮০টি ট্রাম ৩০টি রুটে চলতো। কিন্তু দেখা যায় ২০০৪ সালে ট্রামের পথ অসংরক্ষিত করে অন্য গাড়ির পথের সাথে মিশিয়ে দেওয়ার পর থেকে ট্রাম অস্বাভাবিক বাধার সম্মুখীন হতে থাকে ও গতি শ্লথ হওয়া ছাড়াও যাত্রী ওঠানামার ক্ষেত্রেও অসুবিধা দেখা দেয়। এর প্রভাব পড়ে যাত্রীদের পছন্দের ক্ষেত্রেও। ট্রামপথের অসমান রাস্তার অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে ২০০৭-০৮ সাল থেকে শুরু করে কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করে কংক্রিটের রাস্তায় ট্রাম লাইন বসানো হয়। আশা করা হচ্ছিল এরপর কলকাতার ট্রাম সহজ গতিতে চলবে। ২০১০-১১ সালে ৩০টি রুটে ট্রাম চলতো, যখন মোট ট্রামের সংখ্যা ছিল ২৬৩টি যার মধ্যে ১৮০টি ট্রাম যথেষ্ট ভাল অবস্থায় ছিল। 
২০০৬ সালের ১০ জানুয়ারি কলকাতা মেট্রোপলিটান প্ল্যানিং কমিটিতে কলকাতা শহরের সার্বিক উন্নতির জন্য ২০২৫ সালের সময়সীমার মধ্যে পরিবহন ব্যাবস্থার আধুনিকীকরণে পরিকল্পনা অনুমোদিত হয়। এটা স্পষ্ট করে বলা যায়, এযাবৎ কলকাতা শহরের কোন পরিকল্পনা দলিলে ট্রাম তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়নি। ১৯৯২ সালে শহরের ১০টি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে জাপান ইন্টারন্যাশনাল (জাইকা) কর্তৃপক্ষ সমীক্ষা চালিয়ে দেখে তিনটি ক্ষেত্রে ট্রামের জন্য কিছু সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এই তিনটি ক্ষেত্রেই ট্রাম চলাচলের সমস্যা ছাড়াও আরও অন্তত পাঁচ থেকে ছয়টি অতি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা ছিল যার জন্য ট্রাম দায়ী নয়। বাকি সাতটি মোড়ে ট্রাম না চললেও নানাবিধ সমস্যা ছিল। সেই সমীক্ষায় অনেকগুলি রাস্তায় গাড়ির গড় গতি পরীক্ষা করে জানা গিয়েছিল গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় ১৫.৫ কিমি থেকে ১০ কিমি। এই সমীক্ষার পরেই কলকাতা শহরে পরিকল্পিতভাবে ছয়টি উড়ালপুল তৈরির ব্যবস্থা হয় ও সিগন্যাল ব্যবস্থাকে এক সূত্রে গাঁথা হয় ও এর ফলে গাড়ির গতি বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও কলকাতা ঘিরে একটি বৃহত্তর রিং রোড করার পরিকল্পনা করা হয়। শহরে বড় মাল পরিবহনের গাড়ি ঢুকে শহরের পরিবহন ব্যাবস্থায় যাতে বাধা সৃষ্টি না করে তার জন্য বাইরের দিকে ট্রাক টার্মিনাল করার কথা হয়। ট্রাক টার্মিনালগুলিকে একটি রেল ব্যবস্থার মাধ্যমে চক্রাকারে যুক্ত রাখার কথা বলা হয়। কলকাতার সঙ্গে উত্তরবঙ্গের দ্রুত যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে উদ্যোগ নেওয়া হয়। ইস্টওয়েস্ট মেট্রোর শিলান্যাস হয়ে কাজ শুরু হয়। সঙ্গে নানা শিল্পতালুকের রূপায়নের কাজ চলতে থাকে। কল্যাণী এক্সপ্রেসওয়ে বেলঘরিয়া, দমদম হয়ে ভিআইপি রোডে যুক্ত হওয়ার কাজেও অনেক অগ্রগতি হয়। 
আসলে বিষয়টি শুধু ট্রাম বাস বা ট্রেন নয়, আরও সুদূরপ্রসারী ভাবনা রূপায়নের পরিকল্পনা হয়েছিল। ৬০০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বারাকপুর থেকে জোকা পর্যন্ত আধুনিকতম ট্রাম বা এলআরটি’র কাজের নকশা চূড়ান্ত হয়ে যায়। ধীরে ধীরে বাংলা নিজের পায়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়ে উঠছিল ও অর্থের জোগান পাওয়ার নানা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়ে নয়া বাংলা গড়ার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে, কলকাতা কল্লোলিনী তিলোত্তমা হলে আত্মসম্মান নিয়ে জীবনযাপন, কাজের সুযোগ, শিক্ষার ব্যবস্থা, উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা, সব অংশের মানুষের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা নিশ্চিত হতো। কিন্তু রাজনৈতিক পালাবদলের সাথে শুধু ট্রামের নয়, সামগ্রিকভাবে উন্নয়নের গতিপথ রুদ্ধ হয়ে গেল। 
২০১২ সাল থেকেই শুরু হয়ে যায় ট্রাম ও বাসের ডিপোর জমি বিক্রি করার নানা উদ্যোগ। টালিগঞ্জের ৫৫৭ কাঠার মধ্যে ২৪১ কাঠা, বেলগাছিয়া ডিপোর ৩৪৫ কাঠার মধ্যে ৫৯ কাঠা, কালিঘাতের ৫২ কাঠার মধ্যে ১২.৩৩ কাঠা, শ্যামবাজারের ৪১ কাঠার মধ্যে ৩১.৩৬ কাঠা, খিদিরপুরের ১৭৭ কাঠার মধ্যে ২১.৮৮ কাঠা, গালিফ স্ট্রিটের ৫৩ কাঠার মধ্যে ১৪.৯৫ কাঠা জমি বিক্রির দরপত্র ডাকা হয়। ইতিমধ্যেই জমিগুলি বিক্রি করার পরে সেখানে নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। যেখানে শহরের পরিবহন ব্যবস্থার পরিকাঠামোর জমির অভাব রয়েছে, সেখানে কোন যুক্তিতে জমি প্রোমোটারকে বিক্রি করা হোল? এই টাকা কি শহরের পরিবহন ব্যবস্থার কাজে লাগানো যেত না? 
শুধু ট্রাম ডিপোর জমি নয়, বাসের ডিপোর জমিও বিক্রি করার উদ্যোগ হয়েছে। গড়িয়া, সরশুনা ও ঠাকুরপুকুর বাস ডিপোর মোট ২৭৬ কাঠা জমির জন্য দরপত্র ডাকা হয় ২০১৬ সালে, যে দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৬। আজ যখন ট্রাম তুলে দেয়ার পক্ষে নানা কুযুক্তি সাজানো হচ্ছে, তখন অবশ্যই জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন, যেখানে কলকাতা শহরে বাসের ডিপোর সংখ্যা খুব কম, বাসগুলি যাত্রাপথের প্রান্তে বা টারমিনাসে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থেকে অন্য গাড়ি চলাচলে ও মানুষের চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে, তখন বাসের ডিপোর জমি বিক্রি করা হবে কেন? 
ট্রাম সংক্রান্ত বিষয়ে কলকাতা পুলিশ গতবছর নভেম্বর মাসে রাজ্যের পরিবহন দপ্তরকে একটি চিঠি দেয়, যার প্রতিধ্বনি শোনা যাচ্ছে সরকারি পদাধিকারিদের কথায়। কিন্তু পরিবহন ব্যবস্থার পরিকল্পনা একটি বিশেষ প্রযুক্তিগত বিষয়। বাস্তব অভিজ্ঞতাকে সম্মান দিয়েও বলা যায় রাস্তায় নেমে যান নিয়ন্ত্রণ করলেই পরিবহন ব্যাবস্থার পরিকল্পনার শেষ কথা বলা যায় না।  
শহরে রাস্তার পরিমাণ মাত্র ৭% হলেও, এর মধ্যে পরিবহন ব্যবস্থা সঠিকভাবে পরিচালিত করতে গেলে প্রয়োজন সব অংশের শৃঙ্খলা। শহরের পথে নির্দিষ্ট লাইনের উপর দিয়ে চলার জন্য ট্রাম সব থেকে শৃঙ্খলা মেনে চলে। বিভিন্ন শহরেই গাড়ি চলাচলের লেন বিভাজিকা রাস্তায় থাকে। সেই বিভাজিকা মানার দায় সব যানের। 
বলা হয়েছে, কলকাতা শহরের গাড়ির সংখ্যা ২০১১ সালের ২০ লক্ষ ৯২ হাজার ২৩ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ৫০ লক্ষ ৮৬ হাজার ৫১৮ হয়ে গিয়েছে। কলকাতা পুলিশের ২০২৩ সালের রিভিউ বুলেটিন অনুযায়ী ২০২২ সালে মোট গাড়ির সংখ্যা ছিল ২০ লক্ষ ৯৯ হাজার ৭১৫টি। গাড়ির সংখ্যা বেশি দেখিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানোর ও ভয় দেখানোর কারণ পুলিশেরই ব্যাখ্যা করা উচিত। ভুল পরিসংখ্যান নিজেই একটি বিশৃঙ্খলা ও সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা। তাঁরা বলেছেন শহরের রাস্তার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ নাকি ট্রাম দখল করে থাকে। ওঁদের রিপোর্টে কলকাতা শহরের রাস্তার দৈর্ঘ্য ৪০১৮ কিমি। ট্রামের লাইনের মোট দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিমি, বা কলকাতার মোট রাস্তার দৈর্ঘ্যের মাত্র ১.৪৯ শতাংশ। একটি ট্রাম যাত্রী বহন করতে পারে ৮০ থেকে ২০০জন। এই সংখ্যক যাত্রী পরিবহন করতে প্রায় ১০০ ট্যাক্সি লাগবে ও রাস্তার জায়গা দখল করবে প্রায় ৭৫০০ বর্গ ফুট। আর একটি ৬০ ফুট লম্বা ট্রামের জন্য যায়গা লাগে মাত্র ৪২০ বর্গ ফুট। ট্রাম খুব কম যাত্রী বহন করার অন্যতম কারণ চালু ট্রামের সংখ্যা মাত্র দশটি ও অত্যন্ত অনিয়মিত। এছাড়াও ট্রামের চলাচলের পরিসরকে অন্য গাড়ির পথের সাথে মিশিয়ে দেওয়ার ফলে লোকে রাস্তা পার হয়ে ট্রামে উঠতে অসুবিধা বোধ করে। ট্রাম অন্য গাড়ির পথ রোধ করে না, কিন্তু অন্য গাড়ি ট্রামের সামনে পথ রোধ করে দাঁড়ানোর ফলে গতি শ্লথ হয়ে যায়। ট্রাম শহরে ৪০ কিলোমিটার বেগে চলতে পারে ও প্রয়োজনে আরও গতি বৃদ্ধি করতে পারে। কিন্তু শহরের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে কোড অনুযায়ী সব যানবাহনের সর্বাধিক গতি ঘণ্টা প্রতি ৩০ কিমির বেশি হওয়ার কথা নয়। সমীক্ষা বলছে শহরের যানবাহনের গড় গতি ঘণ্টায় ১৮ কিমির কম। তাই বিষয়টি ট্রামের সক্ষমতার নয়। পুলিশের চিঠিতে বলা হয়েছিল ট্রামের জন্য গতবছর নাকি ১৪টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত দুইবছরের পুলিশের রিপোর্টে ট্রাম ঘটিত দুর্ঘটনা শূন্য। শহরের সবথেকে দুর্ঘটনাপ্রবণ যান দুই মোটর সাইকেল, ট্যাক্সি, প্রাইভেট বাস ও মাল পরিবহনের গাড়ি। দুই বছরে আলাদা রিপোর্টে বছর প্রতি দুর্ঘটনার হিসাব পাল্টে দিয়ে দেখানো হচ্ছে দুর্ঘটনা কমছে। আসলে ঠিক উল্টো ঘটনা ঘটছে। 
সবথেকে দুঃখের বিষয় এই যে ট্রামের জন্য নাকি রাস্তায় দূষণ হচ্ছে। শহরে ২১ লক্ষ গাড়ির মধ্যে ২০০টি ট্রাম চললে দূষণ হবে বললে হাস্যকর শোনাবেই। শেষে বলা হয়েছে শহরে মেট্রো রেল চলছে তাই আর ট্রাম দরকার নেই। কিন্তু বাস্তবে বাসের সংখ্যা ভয়ঙ্কর রকমের কমে গিয়েছে। মানুষ বাধ্য হচ্ছেন অটো রিকশা চড়তে। যদিও অটো রিক্সা অনেক বেশী দুর্ঘটনাপ্রবণ ও বসার পরিসর অত্যন্ত কম। কাকে খুশি করতে রিপোর্টে সত্য গোপন করা হচ্ছে, সবাই বুঝি। কিন্তু এটা দুর্ভাগ্যজনক যে এঁদের তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে নানা সিদ্ধান্ত জানানো হচ্ছে, যা জনজীবনে অত্যন্ত খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে।
সব বিচার করে এটা বলতেই হবে যে ট্রাম চলাচলের জন্য উপযুক্ত সমীক্ষা করে বাস্তব সত্য তুলে ধরা হোক। ২০১২ সালে ইন্সটিটিউট অব আরবান ট্রান্সপোর্ট সমীক্ষা করে জানিয়েছিল যে কলকাতা শহরে ট্রাম চলাচলের ও আরও প্রসারিত করার পক্ষে অনেক সুযোগ আছে। সেই সমীক্ষা মেনে কাজ না করে অর্থের অপচয় করার জন্য সিএজি পরিবহন দপ্তরের কাছে জবাব চেয়েছিল। কিন্তু এরপরেও ট্রাম বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। তাই সবাইকেই সচেতন হয়ে এই অপচেষ্টা বন্ধ করতে হবে। অনুমোদিত আইনানুগ পরিকল্পনা রূপায়ন করে ট্রাম চালু রাখতে হবে। ট্রামের বা বাসের জমি বেচে দেয়ার সুযোগ নেওয়ার জন্য মিথ্যা প্রচার বন্ধ করতে হবে। ট্রাম পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখার ‘ঐতিহ্য’ নয়। দার্জিলিঙের টয় ট্রেনের মতো ট্রামের আধুনিকীকরণ প্রয়োজন, উঁচু স্তম্ভের উপর ট্রাম বা এলআরটি- দুটোই চালানো সম্ভব। ট্রামের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হবে না। দেশীয় প্রযুক্তিতেই ট্রামের অনেক উন্নয়ন সম্ভব। একটি ই-বাসের দাম প্রায় দেড় কোটি টাকা ও জীবনকাল মাত্র ১০ থেকে ১৫ বছর। একটি ট্রামের জীবনকাল ৫০ থেকে ৭০ বছর। যে কোটি কোটি বিদেশী মুদ্রা খরচ করে ই-বাস আমদানি হচ্ছে, তা সাশ্রয় করে ট্রামের জন্য ব্যয় করা হোক। এটা আমরা জানি যে ই-বাসের ব্যাটারি ও যন্ত্রাংশ বিদেশ থেকে বিপুল খরচে আমদানি করার বদলে দেশীয় প্রযুক্তিতে বৈদ্যুতিক ট্রাম চালানোর খরচ কম। শুধু তাই নয় ই-বাসে লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি থেকে অনেক দূষণ ছড়ানোর সম্ভাবনা আছে। তাই ই-বাস কখনই ট্রামের বিকল্প হতে পারেনা। শহরের পরিবহনে নারী, শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, স্কুল যাত্রীদের প্রিয় বাহন ট্রামকে তাই তুলে দেওয়া মানা যায় না।

Comments :0

Login to leave a comment