পশ্চিমবঙ্গে ৩৩৬৫টি ওয়াকফ সম্পত্তি দখল হয়ে আছে। যার মধ্যে সর্বাধিক আছে পূর্ব মেদিনীপুরে। ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখলে দ্বিতীয় স্থানে আছে মুর্শিদাবাদ।
বিজেপি সম্প্রতি ১৯৯৫-এর ওয়াকফ আইন বদল করেছে। লোকসভায় এবং রাজ্যসভায় শরিক দলগুলির সাহায্যে তারা এই সংশোধনী পাশ করিয়েছে। সেই সংশোধনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ওয়াকফ সম্পত্তির দেখভাল, পরিচালনা সহ নানা কাজে ওয়াকফ বোর্ড, ওয়াকফ ট্রাইব্যুনালকে বাদ রেখে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে জেলা শাসকদের। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ভেঙে আমলা দিয়ে কাজ করানোর এই কৌশল যেমন কেন্দ্রের শাসক দলের, তেমনই রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলেরও। বেদখল হওয়া ওয়াকফ সম্পত্তি তৃণমূলীদের নেতা, কর্মীদের কবজায়। জেলা শাসকরা ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পেলে তৃণমূলীদের পোয়াবারো।
গত ১৪ বছর মমতা ব্যানার্জির সময়ে ওয়াকফ বোর্ডের সক্রিয়তা কমেছে। ট্রাইব্যুনালও তৎপরতা হারিয়েছে। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের সংখ্যালঘু স্বার্থ-বিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং নারীর অধিকারের পক্ষে বিপজ্জনক ওয়াকফ সংশোধনী বিল পাশ করিয়েছে। তার বিরুদ্ধে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের একটি বড় অংশ প্রতিবাদে নেমেছেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন যে, রাজ্যে এই আইন কার্যকর হবে না। কিন্তু ওয়াকফ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণে, তার নথি কম্পিউটারাইজড করতে এবং ওয়াকফ সম্পত্তির সমীক্ষায় তৃণমূল সরকারের ব্যর্থতা স্পষ্ট। রাজ্যের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের রিপোর্টেই তা স্পষ্ট। ওই দপ্তরের মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি স্বয়ং।
মোদ্দা কথা— আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি’র সরকার সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভাজন আনতে, এই পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা তৈরি করতে এই বিল পাশ করিয়ে আইন করতে চাইছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জির সরকারও সংখ্যালঘু সহ অন্যান্য যাঁরা ওয়াকফের জন্য সম্পত্তি দিয়েছেন, তাঁদের প্রতি বঞ্চনা করেছেন। ১৯৯৫-এ কেন্দ্রীয় আইনের পরেই বামফ্রন্ট সরকার, ১৯৯৬-এ ওয়াকফ বোর্ড করে। যিনি সম্পত্তি ওয়াকফ করেছেন, সেই ওয়াকিফের ইচ্ছা ও উদ্দেশ্য যাতে সঠিকভাবে রূপায়িত হয় তার দেখভাল করাই হলো ওয়াকফ বোর্ডের মূল কাজ। এই কাজের জন্য ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে যে আয় হবে তার ৭ শতাংশ ওয়াকফ বোর্ড পাবে, আর সেই অর্থ দিয়েই বোর্ড পরিচালিত হবে। যে সম্পত্তি দখল হয়ে আছে, তা থেকে বোর্ডের আয় নেই। বোর্ড সেই টাকা সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে তার নির্ধারিত কাজ করতে পারে না।
বামপন্থীরা বারবার দাবি করা সত্ত্বেও দখল হয়ে যাওয়া ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধার করার উদ্যোগ নেয়নি তৃণমূল সরকার।
পশ্চিমবঙ্গ ওয়াকফ বোর্ডের এক আধিকারিকের কথায়,‘‘২০০৯-১০-এ ৫৬টি পদ সৃষ্টি করেছিল তৎকালীন সরকার। কিন্তু ২০১১-তে সরকার বদলে যায়। সেই তৈরি হওয়া পদগুলির বেশিরভাগই শূন্য আছে। অর্থাৎ যথেষ্ট কর্মী নেই। সরকারেরও তেমন উদ্যোগ নেই। আমরা কিছু জেলায় কিছু স্পটে গিয়ে রিপোর্ট দিয়েছি। কিন্তু দখলদাররা এতটাই প্রভাবশালী যে, পুলিশ, জেলা কিংবা ব্লক প্রশাসনের এই প্রশ্নে বিশেষ কিছু করার থাকে না। ফলে কাজ এগোয়নি।’’
‘কাজ এগোয়নি’ তা বোঝা যায় রাজ্যের বেদখল হয়ে থাকা ওয়াকফ সম্পত্তির হিসাব দেখলে।
রাজ্যের ১৯টি জেলায় ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। বেদখল হওয়া ওয়াকফ সম্পত্তি আছে ১৫টি জেলায়। রাজ্যে স্থাবর ওয়াকফ সম্পত্তির সংখ্যা ৮০,৭৯০টি। রাজ্যের ওয়াকফ সম্পত্তির বেশিরভাগ কৃষি জমি। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে চিহ্নিত স্থাবর ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল ৮০,৪৮১। অর্থাৎ গত ১৪ বছরে ‘মুসলমান প্রেমী’ তৃণমূল সরকার ৩০৯টি স্থাবর ওয়াকফ সম্পত্তি চিহ্নিত, নথিভুক্ত করতে পেরেছে। ৮০,৭৯০টির মধ্যে মামলা চলছে ৩৭৬টিকে ঘিরে। বেদখল হয়ে আছে ৩৩৬৫টি।
এই বেদখল হয়ে থাকা ওয়াকফ সম্পত্তি সর্বাধিক আছে পূর্ব মেদিনীপুরে। সেই জেলায় ৬৯২টি ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে। শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূলের নেতা থাকাকালীন যখন মমতা ব্যানার্জির মতোই ইফতারে ঘুরে নিজেকে মুসলিমদের আপনজন বলে প্রতিপন্ন করতে চাইতেন, তখনও ওই জেলায় ওয়াকফ সম্পত্তি দখলে সবার আগে ছিল। শুধু তাই নয়, নন্দীগ্রামেও দখল হওয়া ৫টি ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। তার দু’টি কৃষি জমি, ৩টি বাস্তু। যে নন্দীগ্রাম ২০০৭ থেকে তৃণমূলের জুলুম-শাসনের আওতায় আছে। মমতা ব্যানার্জি, তাঁর নির্বাচনী এজেন্ট শেখ সুফিয়ান কিংবা শুভেন্দু অধিকারী, কেউই সেই ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধারে কোনও ভূমিকা নেননি বলেই অভিযোগ।
মুর্শিদাবাদে বেদখল থাকা ওয়াকফ সম্পত্তি আছে ৫৬৮টি। এর মধ্যে ৫৩৬টি কৃষি জমি। মুর্শিদাবাদে এখনও পর্যন্ত ওয়াকফ সম্পত্তি আছে ৪৪৩১টি। তার সিংহভাগই কৃষি জমি। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, এই ওয়াকফ সম্পত্তিগুলি দখল করে আছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। তারা সবাই তৃণমূলী।
২০০৭-’০৮ থেকে রাজ্যে তৃণমূল, বিজেপি প্রচার শুরু করে সিপিআই(এম) বেছে বেছে মুসলমানদের জমি কেড়ে নিচ্ছে। বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের বিভ্রান্ত করায় বিজেপি এবং আরএসএস বিশেষ জোর দিয়েছিল। কারণ— সেটি হলে রাজ্যে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট বিভাজনে তৃণমূলের লাভ হবে, আবার কিছুদিন পর বিজেপি’রও ফয়দা শুরু হবে।
এখন সংশোধিত ওয়াকফ আইন, ২০২৫ নিয়ে উত্তেজনায় ভোট সেঁকতে নেমেছে তৃণমূল, বিজেপি।
Waqf
ওয়াকফের ৩৩৬৫টি সম্পত্তি দখল করে বসে তৃণমূলীরা, বিজেপি চুপ

×
Comments :0