অনলাইন জালিয়াতি বা সাইবার ক্রাইম এখন দেশের সাধারণ মানুষের কাছে আতঙ্কের অন্যতম প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ব্যবহার সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে, ভয় দেখিয়ে, বা হুমকি দিয়ে নানাভাবে টাকা হাতানো এইসব সাইবার ক্রাইমের প্রধান লক্ষ্য। ইদানীং এই সাইবার ক্রাইমে নতুন পালক যুক্ত হয়েছে ‘ডিজিটাল গ্রেপ্তারি’। পুলিশ বা কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার নাম করে জালিয়াতরা কারো বিরুদ্ধে বানানো অভিযোগ হাজির করে হুমকি ও ভয় দেখায়। অতঃপর অনলাইনেই জাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠিয়ে মোটা টাকা দাবি করে ছাড় পাবার জন্য। তাৎক্ষণিক অভিঘাতে ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ টাকা দিয়ে রেহাই পেতে চান। তাতেই লক্ষ লক্ষ টাকা জালিয়াতি হয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
মোদী সরকারের ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের কল্যাণে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা সহ অন্য প্রায় সবক্ষেত্রেই অনলাইন বা ডিজিটাল ব্যবস্থা চালু হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে ডিজিটাল নির্ভরতা ও ডিজিটাল অপরিহার্যতা। ফলে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে সড়গড় নয় বা একেবারেই অপারগ কোটি কোটি মানুষকে বাধ্য হয়েই ডিজিটাল লেনদেনে বাধ্য হতে হচ্ছে। নিজে না পেরে পরিচিত-অপরিচিতর সাহায্য নিতে গিয়েও বিপদে পড়ছে। বিশেষকরে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল অজ্ঞ বা স্বল্পজ্ঞাত মানুষের সামনে এটাই মূর্তিমান বিভীষিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডিজিটাল ব্যবস্থায় নিরাপত্তা অবশ্যই থাকে। কিন্তু জালিয়াতরা অনেক ক্ষেত্রে সহজেই সেই নিরাপত্তা ভেদ করে ঢুকে পড়ে মোটা টাকা হাতিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তায় কঠোর নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হলে সাধারণ ব্যবহারকারীর কাছে তা আরও জটিল হয়ে পড়ে। তারা তখন অসহায় হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে নতুন করে ভাবনা চিন্তা করতে হবে। এমন সাইবার নিরাপত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে যেটা ব্যবহারকারীর পক্ষে সহজ হবে কিন্তু জালিয়াতদের পক্ষে কঠিন।
অনলাইন জালিয়াতিতে মানুষের সর্বাধিক সর্বনাশ হয় আর্থিক ক্ষেত্রে লেনদেন। যে কোনও আর্থিক লেনদেন হয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে। জালিয়াতরা নানা কৌশলে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়ে যায়। বর্তমান ব্যবস্থায় জালিয়াতদের হদিশ পাওয়া খুবই দুষ্কর। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী গত ১২ বছর ধরে ডিজিটাল লেনদেন ৯০গুণ বেড়েছে। ২০১২-১৩ সালে যেখানে ১৬২ কোটি ডিজিটাল পেমেন্ট হয় সেখানে ২০২৩-২৪ সালে সেটা বেড়ে হয় ১৪৭২৬ পেমেন্ট। ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্রকল্পকে সামনে রেখে ডিজিটাল লেনদেন বাড়াতে মোদী সরকারের সচেতন প্রয়াসের অন্যতম হলো নোট বাতিল। ২০১৬ সালে নোট বাতিল করে বাজারে নগদের অভাব সৃষ্টি করে মানুষকে বাধ্য করা হয়েছিল ডিজিটাল লেনদেনে। পরে করোনার সময় মাত্রাতিরিক্ত লকডাউনের ধাক্কায় অনলাইনে পেমেন্ট এক ধাক্কায় বহুগুণ বেড়ে যায়। পাশাপাশি অনলাইন পেমেন্ট বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অনলাইন জাতিলয়াতিও। ২০১৯-২০ সালে সাইবার জালিয়াতির সংখ্যা ছিল ৭৩ হাজার। ২০২৩-২৪ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২লক্ষ ৯৩ হাজার। একইভাবে জালিয়াতি করে টাকা লুট করা হয়েছে ২০১৯-২০ সালে ২৪৪ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ সালে সেটা বেড়ে হয়েছে ২০৫৫ কোটি টাকা। লক্ষণীয় বিষয় জালিয়াতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বিপজ্জনক বেসরকারি ব্যাঙ্ক। জালিয়াতির শিকার উপরের ৫টি ব্যাঙ্কের মধ্যে ৪টিই বেসরকারি ব্যাঙ্ক। জালিয়াতির ঘটনার এবং অর্থমূল্যে সিংহভাগই বেসরকারি ব্যাঙ্কে। তার অর্থ বেশি মুনাফার নেশায় গ্রাহকদের সঞ্চিত অর্থের নিরাপত্তায় গুরুত্ব দেয় না বেসরকারি ব্যাঙ্ক। তেমনি মন কি বাত অনুষ্ঠানে সাইবার ক্রাইম থেকে রেহাই পেতে সাধারণ মানুষ সচেতন ও সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছেন। তবে কি সরকারও নিরাপত্তার দায় এড়াতে চাইছে? সাধারণ মানুষকে সাইবার ক্রিমিনালদের হাতে সঁপে দিয়ে ডিজিটাল ইন্ডিয়ার সাফল্যের ফানুস ওড়াতে চাইছে সরকার?
Editorial
ডিজিটাল ফাঁদে সাধারণ মানুষ
×
Comments :0