electoral bond

নির্বাচনী বন্ডের আড়ালে রয়েছে অপরাধের বীজ

জাতীয়

নীলোৎপল বসু
গত দশ বছর ধরে মোদী সরকার নিজেরাই নিজেদের ঢাক পিটিয়ে চলেছে যে তারা নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে খড়গহস্ত। তারা ক্ষমতায় এলেই দুর্নীতি বন্ধে অতীতের যাবতীয় বাধা ভেঙে ফেলা যাবে, এমন কথাও বুক বাজিয়ে বলা হতো। সবারই নিশ্চয়ই মনে আছে, ‘না খাউঙ্গা না খানে দুঙ্গা’এই ছিল প্রধানমন্ত্রীর দাবি। এর পরে ব্যাপারটাকে আরও বাড়িয়ে দেখাতে ‘চৌকিদার’ শব্দটির প্রচলন শুরু হয়। বিজেপি’র প্রচারযন্ত্র ঝাঁপিয়ে পড়ে, তারা দেখাতে চায় দুর্নীতি প্রতিরোধে বিজেপি সরকার কত একনিষ্ঠ। 
অবশ্য আজকের দুনিয়ায় দুর্নীতি কোথায়, কিভাবে কত গভীরে পৌঁছে গেছে তাকে আড়াল করতেই সাধারণত এমন প্রচার চলে। নয়া উদারবাদী জমানায় রাষ্ট্র নিজেরই নাগরিকদের কাছে জবাবদিহি করতে চায় না। মোদী সরকারেরও বিভিন্ন কাজের মূল  ধারা সেটাই। আর তাই দেশের সরকারের একমাত্র চিন্তা, কিভাবে বাজার এবং সেই বাজারে নিজেদের পৃষ্ঠপোষক কর্পোরেট গোষ্ঠীর শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখা যায়। একথা ঠিকই যে এমন কর্পোরেট বান্ধব পরিস্থিতি তৈরির জন্য রাষ্ট্রের তরফে বিশেষ সহযোগিতা প্রয়োজন ছিল। আর সেজন্যই দুর্নীতি বিরোধী লড়াই আসলে জনসাধারণের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রধানমন্ত্রীর প্রথম দিকে বক্তব্য ছিল, তিনি হার্ভার্ড কিংবা মেধাবৃত্তির পরিবর্তে কঠোর পরিশ্রমেই ভরসা করেন। এসবই আসলে কর্পোরেট স্বার্থে নিয়োজিত থাকার ফিকির। 
আজকের ভারতে কর্পোরেটদের এমন কায়দায় সুবিধা পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে যা সমাজে বৈষম্যকে ক্রমশ বাড়িয়ে দিচ্ছে। মোদী সরকার অনুসৃত ক্যুইড প্রো ক্যুও (ক্ষতি পূরণ করে দেওয়া) নীতির পর্যালোচনা করে স্পষ্টই বোঝা যায় যে বিজেপি ও তার সঙ্গীসাথি ধনীদের সমৃদ্ধি ঘটানোই ছিল এদের একমাত্র উদ্দেশ্য। এই নীতির সহজ কথা- ন্যূনতম সরকারি নিয়ন্ত্রণ অথচ সর্ব্বোচ সরকারি কর্তৃত্ব। এর ফলে কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে একদিকে করের বোঝা থেকে ছাড়, আরেকদিকে তাদের মুনাফা লুটে নেওয়ার স্বাধীনতা - দুটোই দেওয়া হয়। সেই উদ্দেশ্যেই নির্বাচনী বন্ডের বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। এই ব্যবস্থা আসলে নয়া উদারবাদী রাষ্ট্রের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতাসীন দলের জন্য স্পনসর বা অর্থের জোগানদার জুটিয়ে নেওয়ার ফন্দি। সিপিআই(এম) প্রথম দিন থেকে বলে এসেছে নির্বাচনী বন্ড হলো রাজনৈতিক দুর্নীতিকে বৈধতা দেওয়ারই নামান্তর। আজ যখন এই প্রসঙ্গে একের পর এক তথ্য সামনে আসছে তখন একথা স্পষ্ট হচ্ছে যে, এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রাম চালাতে গিয়ে সিপিআই(এম) যা কিছু বলেছিল, তা সবই সত্য। বন্ড কেনার মালিক ও সেইসব বন্ড পকেটস্থ করা রাজনৈতিক দলের তালিকা দুটো মিলিয়ে দেখতে জরুরি ছিল আলফানিউমেরিক কোডের তালিকা প্রকাশ করা। আর এই নির্দেশ সুপ্রিম কোর্ট দেওয়ায় সব জল্পনা কল্পনার অবসান হয়ে প্রকৃত দুর্নীতি বেআব্রু হয়ে গেছে। 
কী কী জানা গেছে? 
নির্বাচনী বন্ডকে কার্যকর করার সময় সংসদে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে আগ্রাসী কৌশলে কাজে লাগানো হয় যাতে কোনও বাধা না আসে। একসময় যেমন দাবি করা হতো যে নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে অর্থসংগ্রহ নাকি নির্বাচনকে আরও স্বচ্ছ করে তুলছে তুলবে। অবশ্য সেসব কথাবার্তা আজ আর কেউ উচ্চারণ করছে না। এই বন্ড আসলে কি, এর সংজ্ঞা ঠিক কি হবে এসব প্রশ্নকে কার্যত এড়িয়ে যাওয়া হয়েছিল। কোনোরকম নিয়ন্ত্রণ ব্যতিরেকে, দলীয় তহবিলে সংগৃহীত অর্থের শিকড় কোথায়, তার উপরে নজরদারির যে কোনও ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে নিজেদের ইচ্ছামত সংগৃহীত অর্থের চূড়ান্ত অপব্যবহার করার উদেশ্যেই এসব ঘটেছিল। এর বিরুদ্ধে যে কোনও সমালোচনাকে স্তব্ধ করতে বুলডোজারের কায়দায় সব আপত্তি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। 
এমন পরিস্থিতিতে যে বা যারা এই অপরাধমূলক বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন, তাদের জন্য একটাই পথ খোলা ছিল- সেটা সুপ্রিম কোর্ট, দেশের সর্বোচ্চ আদালত। মামলার সওয়াল জবাব চলার সময়ই স্পষ্ট হয়ে যায় যে সরকারের একমাত্র উদ্যেশ্য ছিল যেনতেন প্রকারেন এ সম্পর্কিত সবরকম তথ্যই জনসাধারণ থেকে আড়াল করে রাখা। বন্ডের খরিদ্দার ও প্রাপক দু’য়েরই পরিচিতি গোপন রাখার কৌশল (ঐ আলফানিউমেরিক কায়দা) থেকেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায়। এর মাধ্যমে জনসাধারণের তথ্য জানার সাংবিধানিক অধিকারকে লঙ্ঘন করা হয়। এখন বোঝা যাচ্ছে কে কাকে কত অর্থ সাহায্য করেছে। আরও দুটি তথ্য সামনে এসেছে। এক, বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সাহায্য কোনও স্বতঃস্ফূর্ত দানের ব্যবস্থা নয়। জনসাধারণের সামনে বিষয়টি গোপন রাখা হচ্ছিল সেই কারণেই। দুই, কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক দলের তহবিলে যথেচ্ছ অর্থ দানের সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে আসলে বিবিধ অর্থনৈতিক দুর্নীতিকে আড়াল করা যেত। তাই স্বচ্ছ নির্বাচনী বন্দোবস্তের নামে আসলে এটা নিজেই এক বিরাট দুর্নীতি। 
এই বন্ডকে অসাংবিধানিক ঘোষনায় সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়কে এই প্রেক্ষিতেই বিবেচনা করতে হবে। তথ্য জানতে জনসাধারণের সাংবিধানিক অধিকারের পক্ষেই এই রায়। সুপ্রিম কোর্ট কার্যত সংবিধানের মূল ভাবনাকেই সুরক্ষিত রেখেছে, তাকেই তুলে ধরেছে। এই কারণেই নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে এই সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য জনসমক্ষে নিয়ে আসার পক্ষেই এই রায় হয়েছে। রায় ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই বোঝা যাচ্ছে বিজেপি বেকায়দায় পড়েছে। এই বন্ডকে কার্যকর করার প্রধান ব্যক্তিটি ছিলেন অমিত শাহ। তিনি মরিয়া হয়ে কিছু মনগড়া হিসাবনিকাশ করেছেন এবং প্রচার করতে চাইছেন, এর মাধ্যমে নাকি বিরোধীরাই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে। এসব কথাবার্তার উদ্দেশ্য একটাই- নির্বাচনী বন্ডের সুবাদে সবচেয়ে লাভবান হয়েছে বিজেপি, এই সহজ সত্যটি আড়াল করা, মানুষকে বিভ্রান্ত করা। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মামলায় সুপ্রিম কোর্টের একটি পর্যবেক্ষণ মাথায় রাখতে হবে। আমাদের দেশে নির্বাচনী আইনে সবাইকে সমান সুযোগ দেওয়ার বিধি রয়েছে। অথচ নির্বাচনী বন্ডে ৫০ শতাংশের বেশি অর্থ পেয়েছে একাই বিজেপি। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় ক্ষমতাসীন দল নিজের দিকে যাবতীয় সুযোগ সুবিধা টেনে আনতে পারে। এমন বন্দোবস্ত অবশ্যই অসাংবিধানিক। নির্বাচনের ময়দানে সকল পক্ষকে সমান সুযোগ দেওয়ার মৌলিক অধিকারকেই এর মাধ্যমে অকেজো করে দেওয়া হয়।
এই ঐতিহাসিক রায়ের পর নির্বাচনে বিজেপি যে কায়দায় নিজেদের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব জারি রাখতে চেয়েছিল, সেই পরিকল্পনা খানিকটা ভেস্তে গেছে। বন্ডের তথ্য সামনে আসার পরে যা দেখা যাচ্ছে তাতে স্পষ্ট গোটা ব্যাপারটাই আগাগোড়া প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াকে সেই প্রতারণার জাল বিস্তারে ব্যবহার করা হয়েছে। এমনকি রায় ঘোষণার পরেও অর্থ সাহায্যের দাতা ও গ্রহীতার পরিচিতি সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করার কাজে এসবিআই-কে দিয়ে ইচ্ছাকৃত দেরি করানো হয়েছে। এমন আচরণ কার্যত আদালত অবমাননার সমান। ১৫ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে তাকে আইন মোতাবেক কার্যরী করতে দেশের সর্ব্বোচ আদালতকে সেজন্যই আরও দু’বার হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে। 
এই বন্ডের মাধ্যমে মোটের উপরে কারা সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে সেকথা স্পষ্ট হয়ে গেছে। কতগুলো খুঁটিনাটি বিষয় এখনও উপলব্ধি করতে হবে। কি কি বোঝা যাচ্ছে? এই বন্ড কার্যত বেআইনি অর্থ পাচারের কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। আয়কর বিভাগ, ইডি, সিবিআই’র মতো কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করার সুযোগ হিসাবে এই ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছে। যাবতীয় আর্থিক দুর্নীতিকে প্রশ্রয় ও আশ্রয় দেওয়ার পাশাপাশি সব সুযোগ সুবিধাকে শাসকের দিকে টেনে রাখার জন্যই এমন বন্দোবস্ত কার্যকর করা হয়েছে। এককথায় বলা চলে গত এক দশক ধরে মোদী সরকার যা কিছু করতে চেয়েছে তারই একটি সুসংহত ও ঘনীভূত চিত্র হলো নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা। 
আর্থিক দুর্নীতি প্রসঙ্গে
দেশের আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক দলের তহবিলে কর্পোরেট সংস্থা নিজেদের মুনাফার সর্বোচ্চ ৭.৫ শতাংশ অবধি দান করতে পারে। এই আইনকে কার্যত বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে যথেচ্ছ অর্থ নেওয়া হয়েছে। কোনও বৈদেশিক ব্যবসায়ী সংস্থা দেশের নির্বাচনে পয়সা খরচ করতে পারে না। অথচ দেখা যাচ্ছে নিজেদের ভারতীয় সহায়ক গোষ্ঠী মারফত বিভিন্ন বৈদেশিক সংস্থা অর্থ দিয়েছে। কোনও কোনও কর্পোরেট সংস্থার পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছে এমন রায় কর্পোরেটদের নিরুৎসাহিত করবে। এমন দাবি যে আসলে ভণ্ডামি সেকথা সহজেই বোঝা যায়। কর্পোরেট সংস্থাগুলি আগেই নিজেদের মুনাফার ৭.৫ শতাংশ দান করতে পারতো, মুনাফার বাদবাকি অংশ দিয়ে সংস্থার নিজের এবং শেয়ার হোল্ডারদের লাভবান হওয়ার সুযোগ দিতে পারতো। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে তাদের কার্যত শুষে নেওয়ার কৌশল নেওয়া হয়েছিল। এমন কায়দা আসলে যেকোনও প্রকারে টাকা বের করে নেওয়ার কৌশল।
বিপুল লোকসান সত্ত্বেও বন্ডের মাধ্যমে অর্থ সাহায্যকারী অনেকগুলি সংস্থার নাম সহ সব তথ্যই এখন সামনে চলে এসেছে। জালিয়াতির সবচায়ে বড় উদাহরণ ভারতী এয়ারটেল লিমিটেড। এরা ১৯৮ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে অথচ এদের ব্যালান্সশিটে দেখা যাচ্ছে এরা এই সময়কালে ৬৫,২৩৯ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ ছড়িয়ে আছে প্রকাশিত তথ্যে।
হফতা ওসুলি– পয়সা লুটের কয়েকটা নিকৃষ্ট উদাহরণ
স্টেট ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে দেওয়া তথ্য যা নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করেছে, মোদী শাসনের সময়কালে সুনির্দিষ্টভাবে আইটি/ইডি/সিবিআই অভিযানের বিষয়টি দেখলেই নির্বাচনী বন্ডের ক্রয় ও অর্থসাহায্যের কালানুক্রম বোঝা যায়। কার্যপ্রণালী অত্যন্ত স্পষ্ট। কেন্দ্রীয় সংস্থার অভিযান চালায়, আর তার পরেই কোম্পানিগুলো একের পর এক বন্ড কেনে, যার ফশ্রুতিতে কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলি ক্রমশ নীরব হয়ে যায়। তাদের কাছে, বন্ড কেনার অর্থ হলো কেন্দ্রীয় সংস্থার হানার থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ।
যেহেতু সব তথ্য সামনে এসে গেছে, তাই শুধুমাত্র ইলেক্টোরাল ফিউচার গেমিং অ্যান্ড হোটেলস প্রাইভেট লিমিটেডের উদাহরণই সবটা বোঝার জন্য যথেষ্ট। এরা ১৩৬৮ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে জানুয়ারি ২০২৪ এর মধ্যে। ২০১৯ সালে ইডি এই কোম্পানির বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের  অভিযোগে তদন্ত শুরু করে এবং তাঁদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হয় এপ্রিল ২০২২ থেকে ২০২৩-র মে মাসের মধ্যে। ২০২২ সালের এপ্রিল ও ডিসেম্বর মাসের মধ্যে তারা নির্বাচনী বন্ড কেনা শুরু করে। অভিযান চালিয়ে এদের ও এদেরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয়দের সব সম্পত্তি যখন বাজেয়াপ্ত  করা হচ্ছে, তখনই এরা ৩০৩ কোটি টাকার বন্ড কিনছে।  
ক্যুইড প্রো ক্যুও
বন্ড কেনা সংক্রান্ত তথ্যেই উঠে এসেছে ক্যুইড প্রো ক্যুও ধাঁচের কিছু সুনির্দিষ্ট যোগযোগ সম্পর্কে। সরকারি কাজের বরাত সুনিশ্চিত করতেও বন্ড কেনা হয়েছে। পরিকাঠামো ও নির্মাণের বরাত পাওয়া জন্য নির্বাচনী বন্ড কেনা হয়েছে। যেমন মেঘা ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাচার লিমিটেড অন্যতম বৃহৎ ক্রেতা বন্ডের আবার তারাই প্রচুর পরিমাণে সরকারি প্রকল্পের বরাত পেয়েছে। মহারাষ্ট্রের ক্যুইক সাপ্লাই চেন প্রাইভেট লিমিটেড ৪১০ কোটি টাকার বন্ড কিনেছে যারা রিলায়েন্স গ্রুপ অব কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত। হলদিয়া ইঞ্জিনিয়ারিং এনার্জি লিমিটেড কিনেছে ৩৯৫ কোটি টাকার বন্ড। যেখানে অনিল আগারওয়ালের বেদান্ত লিমিটেড কিনেছে ৩৮৬ কোটি টাকার বন্ড। এরা সকলেই বড় বড় সরকারি প্রকল্পের বরাত পেয়েছে। আবার দিল্লির আবগারি মামলায় মূল অভিযুক্ত সারথ রেড্ডি গ্রপ্তার হয় ১০০ কোটি টাকার দুর্নীতি মামলায়। এরা ৫৫ কোটি টাকার বন্ড কেনে এবং তারপরেই রাজসাক্ষী হয়ে জামিন পেয়ে যায়। অরবিন্দ কেজরিওয়াল সহ অন্যান্যদের নাম এই উল্লেখ করে এবং এর স্বাক্ষ্যের ভিত্তিতেই গ্রেপ্তার হয়েছেন কেজরিওয়াল। ক্রোনোলজি বুঝে নিন পাঠক। 
জনগণের স্বাস্থ্যের সঙ্গে ছেলেখেলা করা সম্ভবত সব থেকে ভয়ঙ্কর দিক এই নির্বাচনী বন্ডের আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে, যার মাধ্যমে ফার্মাসিউটিকাল শিল্প সরকার থেকে অনেক ছাড় পেয়েছে। ৩৫ টি ভারতীয় ফার্মাসিউটিকাল কোম্পানি প্রায় ১০০০ কোটি টাকার কাছাকাছি নির্বাচনী বন্ড কিনেছে। এর মধ্যে ৭ টি কোম্পানির বিরুদ্ধে যখন তদন্ত চলছে নিম্নমানের ওষুধ বাজারে বিক্রির জন্য তখনই তারা বন্ড কিনেছে। ওষুধের বাজার অন্যতম একটি বিষয় যেখানে কোম্পানিগুলি সরকারের অনুগ্রহ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকে। ফার্মগুলো স্বল্পমূল্যে জমি, করছাড়, সুবিধাজনক  নীতি, ওষুধের দামের উর্ধ্বসীমা তুলে দেওয়া, নিম্নমানের ওষুধ বিক্রির সুবিধা ইত্যাদির জন্য উৎসুক হয়ে থাকে সর্বদা। বন্ড কিনে শাসক দলে টাকা দেওয়ায় অপরাধ করেও ছাড় পেয়েছে বেশ কয়েকটা ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানি, এই তথ্যও আজ প্রকাশিত হয়ে গেছে। 
কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক আঁতাত
ধনী ব্যবসায়ীদের তিনটি মূল সংস্থা FICCI, CII ও Assocham যৌথ একটি আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে যায়। আবেদনটি ছিল বন্ড স্কিম মারফত অনুদানকারীদের পরিচয় যেন প্রকাশ না করা হয়। মূল লক্ষ্য ছিল নিজেদের পরিচয় গোপন করা আর যুক্তি দেওয়া হলো, পরিচয় প্রকাশ পেলে ব্যবসায়িক গোপনীয়তা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই আবেদন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দীর্ঘ শুনানির পরে ১৫ ফেব্রুয়ারি রায় বেরোয়- কর্পোরেটদের শীর্ষ সংস্থারগুলোর জন্য কোনও পৃথক ছাড় নেই। এমন কি তাদের এই পরিচয় গোপন রাখার আবেদন সুপ্রিম কোর্টের কড়া সমালোচনার মুখে পড়ে। এই যৌথ আবেদনটির মাধ্যমে তথ্যের মৌলিক অধিকার এবং নির্বাচনীস্তরে অনৈতিক খেলায় যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে সে সম্পর্কে কর্পোরেটদের উদাসীনতাই প্রকাশিত হয়েছে।
শিল্পসংস্থাগুলির পাশাপাশি আরএসএস’ও সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে নিজেদের অবস্থান জানিয়েছে এবং নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থার পক্ষে সাফাই গাইছে। আরএসএস-এর সাধারন সম্পাদক দত্তাত্রেয় হোসাবালে যুক্তি দিয়েছেন যে, এই নিয়ম একটা পরীক্ষা মাত্র এবং যেকোনও নতুন বিষয় এলে নানারকম প্রশ্ন ওঠেই।
যা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট তাহলো কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির আঁতাত এই আকাশছোঁয়া সরকারি দুর্নীতিকে আড়াল করার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রাজনৈতিক তহবিলের পরিচ্ছন্নতার বিপরীত অবস্থান নিয়েছে তারা, যা চূড়ান্ত বৈষম্যমূলকভাবে শুধু বিজেপি’র পক্ষেই লাভজনক। এর ফলে সব রকমের আর্থিক ও প্রশাসনিক দুর্নীতিকে উৎসাহিত হয়েছে। এই মরিয়া প্রচেষ্টা আসলে দেখিয়ে দেয় যে কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির অশুভ আঁতাতে তৈরি নির্বাচনী বন্ড ব্যবস্থা বিচার বিভাগীয় হস্তক্ষেপের ফলে বড় ধাক্কা খেয়েছে।
আগামী দিনের রাস্তা
কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির অশুভ আঁতাতের দ্বারা জনগণের সাংবিধানিক অধিকারকে খর্ব করার প্রচেষ্টাকে রুখে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায় নিশ্চিতভাবেই এক বিরাট সুযোগ দেশের মানুষের সামনে এনে দিয়েছে, একটা মঞ্চ উপস্থিত করেছে। এই মঞ্চ হল সাংবিধানিক অধিকার। ভোটাধিকারের মাধ্যমে নিজেদের সরকার বেছে নেওয়ার রাজনৈতিক অধিকার একমাত্র ভারতের জনগণের, এটাই নির্বাচনী আইনে সকলের জন্য সমান সুযোগের ভিত্তি। কর্পোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির অশুভ আঁতাত দ্বারা পরিচালিত বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার যেভাবে ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রনের অপচেষ্টা চালাচ্ছিল ১৫ ফেব্রুয়ারির ঐ যুগান্তকারী রায় তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়েছে।
বিজেপি অবশ্য ইতিমধ্যেই নতুন কৌশল অনুসরণ করা শুরু  করেছে। কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত মূল ধারার মিডিয়া এবং অবশ্যই সোশাল মিডিয়ায় নিজেদের মিথ্যা প্রচারের আধিপত্যকে পুনরায় কায়েম করার উদ্দেশ্যে ভোটারদের অস্পষ্ট এবং ভুল তথ্য পরিবেশিত করা শুরু হয়েছে। সমাজের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের রায়কে জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে আমাদের। এটা বিজেপি বিরোধিতার অন্যতম একটি প্রধান কর্তব্য। এটা করতে না পারলে সংবিধানের মৌলিক নীতির পক্ষে  তিলমাত্র জয়কেও সুসংহত করা যাবেনা। আগামী নির্বাচনে বিজেপি-কে হারানোর জন্য জনগণের লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড় চ্যালেঞ্জ।
 

Comments :0

Login to leave a comment