চন্দন দাস
মহাত্মা গান্ধী নিহত হয়েছিলেন ১৯৪৮-এ। তার পাঁচ বছর আগে খুন হয়ে গেছিলেন আল্লাহ বক্স সুমরো। গান্ধীর বুকে গুলি চালিয়েছিল একজন হিন্দুত্ববাদী। ১৯৪৩’র আগস্টে টাঙার সওয়ারি সুমরোকে, সিন্ধের শিকারপুরে, তাঁর বাড়ির কাছে যারা খুন করেছিল তাদের বক্তব্য ছিল মুসলিমদের জন্য আলাদা দেশ পাকিস্তান চাই।
গান্ধীর মতোই আল্লাহ বক্স সুমরো ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগের বিরোধী ছিলেন। সিন্ধ প্রদেশের দু’বারের মুখ্যমন্ত্রী, প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ সুমরো বিশ্বাস করতেন অখণ্ড ভারতই তাঁর দেশ।
হঠাৎ এখন অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্সের এই নেতার প্রসঙ্গ কেন? প্রশ্ন স্বাভাবিক। উত্তরও সোজা। যখন অতীতে ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে সাম্প্রদায়িক আর মৌলবাদীরা, যখন ইতিহাসকেই পালটে দেওয়ার চেষ্টা শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকারের উদ্যোগে, তখন ইতিহাস ঘেঁটে ভবিষ্যতের রাস্তায় আলো ফেলার জন্য মশাল খোঁজার চেষ্টাতেই উপস্থিত করতে হচ্ছে আল্লাহ বক্স সুমরোদের।
হিন্দু মানেই হিন্দুত্ববাদী নয়। সব মুসলমানও পাকিস্তানের দাবিদার নন। তবে হিন্দুত্ববাদী আর মুসলিম মৌলবাদী প্রায় একরকম— একই ধাঁচের তাদের ভাবনা। কাজও একই রকমের। সুমরো আর গান্ধীর এখানে মিল। যেমন মিল সেলুলার জেলে মার্কসবাদী হয়ে ওঠা, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম সৈনিক লালমোহন সেনের সঙ্গে। ১৯৪৬-এ পার্টির নির্দেশে সন্দ্বীপ দ্বীপে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে প্রচার করায় শহীদ হয়েছিলেন কমরেড সেন।
উত্তাল চল্লিশে যখন একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন দেশে নানা ধারায় তীব্র হয়ে উঠেছে, তখনই প্রবল হচ্ছে সঙ্ঘ, জামাতের বিভাজনের কৌশল। ১৯৪০-এ মুসলিম লিগের লাহোর অধিবেশন। যেখানে পৃথক পাকিস্তানের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় মহম্মদ আলি জিন্নাহ’র সভাপতিত্বে। প্রায় সেই সময়েই, ১৯৪১-র আগস্টে তৈরি হচ্ছে জামাত-ই-ইসলামী। নেতা? সইয়াদ আবু আলা মৌদুদী। আবার প্রায় তখনই, ১৯৪০-এ রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের প্রধান হচ্ছেন মহাদেব সদাশিব গোলওয়ালকার। আশ্চর্য সমাপতন।
মুসলিম লিগের পাকিস্তানের দাবি সামনে আসার পর অনেক মুসলিম সংগঠন এবং সম্প্রদায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তিরা প্রকাশ্যে ভারত ভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ১৯২৯-এ এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠা। ২৭ এপ্রিল, ১৯৪০—এ দিল্লিতে মুসলিম লিগের গৃহীত পাকিস্তান রেজুলেশনের বিরোধিতা করার জন্য একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল আল্লাহ বক্সের নেতৃত্বাধীন অল ইন্ডিয়া আজাদ মুসলিম কনফারেন্স। সম্মেলনে অনেকগুলি মুসলিম সংগঠন যোগ দেয়। সেই সময় আজাদ মুসলিম কনফারেন্স স্লোগান দিয়েছিল ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’,‘জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে স্বাধীনতা চাই’,‘আমরা ভারতীয় এবং ভারত আমাদের বাড়ি’ ইত্যাদি। সম্মেলনটিকে সমর্থন জানিয়ে অনেক রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। বাংলার নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদদের একটি যৌথ শুভেচ্ছা বার্তা সম্মেলনে পৌঁছয়। সেখানে স্বাক্ষর ছিল হুমায়ুন কবির, নবাবজাদা হাসান আলী চৌধুরি, ড. আহমদ, কেএম জাকারিয়া প্রমুখের। বার্তায় লেখা হয়েছিল,‘‘এই ধরনের একটি সম্মেলনে অবশ্যই ঘোষণা করা উচিত যে আজকের ভারতীয় সভ্যতা মুসলমান ও হিন্দুদের যৌথ প্রচেষ্টার সৃষ্টি এবং এর চেতনার ঐক্যকে ব্যাহত করার যে কোনও প্রচেষ্টা হাজার বছরের ইতিহাসের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা। মুসলিম লিগের পরিকল্পনা বা ভারতকে ভাগ করা, যদি আক্ষরিক অর্থে নেওয়া হয়, তাহলে তা ইসলামের প্রকৃত চেতনার পরিপন্থী...।’’ সম্মেলনের সভাপতি আল্লাহ বক্স দেশভাগের প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন,‘‘ইসলামের সবচেয়ে অন্ধকার ও কঠিনতম দিনেও নবী পাকিস্তান তৈরির কথা ভাবেননি।’’
অন্যদিকে জামাত-ই-ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা মৌদুদী শরিয়তের ভিত্তিতে একটি ভূখণ্ড পরিচালনার প্রবল সমর্থক, প্রচারক ছিলেন। তবে মৌদুদী আর মুসলিম লিগের মধ্যে একটি প্রভেদ ছিল গোড়ার দিকে। মুসলমানদের বাসভূমি নয় শুধু, মৌদুদী চাইতেন ঐস্লামিক রাষ্ট্র। তাঁর কথায়,‘‘মুসলমান হিসাবে আমার কাছে এ প্রশ্নের কোনও গুরুত্ব নেই যে ভারত অখণ্ড থাকবে না দশ খণ্ডে বিভক্ত হবে। সমগ্র পৃথিবী এক দেশ। মানুষ তাকে সহস্র খণ্ডে বিভক্ত করেছে। আজ পর্যন্ত পৃথিবী যতো খণ্ডে বিভক্ত হয়েছে তা যদি ন্যায়সঙ্গত হয়ে থাকে, তাহলে আরও কিছু খণ্ডে বিভক্ত হলেই বা ক্ষতিটা কী? এ দেব প্রতিমা খণ্ড বিখণ্ড হলে মনোকষ্ট হয় তাদের যারা একে দেবতা মনে করে। আমি যদি এখানে একবর্গ মাইলও এমন জায়গা পাই যেখানে মানুষের উপর আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো প্রভুত্ব কর্তৃত্ব থাকবে না, তাহলে এ সামান্য ভূমিখণ্ডকে আমি সমগ্র ভারত থেকে অধিকতর মূল্যবান মনে করবো।’’(সূত্র: সিয়াসী কাশমকাশ—৩য় খণ্ড।)
ভাবনায় নিদারুণ মিল গোলওয়ালকার, সাভারকারের সঙ্গে!
রাষ্ট্র সম্পর্কেও হিন্দুত্ববাদী আর জামাত-ই-ইসলামীর ভাবনায় সাদৃশ্য স্পষ্ট। ‘উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও মুসলমান, ২য় খণ্ড’-এ মৌদুদী লিখলেন,‘‘ভারতের হিন্দু ভাইয়েরা যদি ভারতে সত্যিকার রামরাজ্য প্রতিষ্ঠা করে দেন, তা হলে আমরা তাদের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো। কেননা বর্তমান ধর্মনিরপেক্ষ শাসনের তুলনায় এ রামরাজ্যে মৌলিক মানবীয় অধিকারের নিরাপত্তা আরও ভালোভাবে সংরক্ষিত হবে।’’ স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ‘রামরাজ্য’র এত বড় সমর্থক সঙ্ঘ, বিজেপি’র বাইরে বিশেষ পাওয়া যাবে না।
‘রামরাজ্য’র ধারণায় নিজের রাষ্ট্র সম্পর্কে ধারণায় প্রভূত সাদৃশ্য খুঁজে নেওয়া মৌদুদীর ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কে ধারণা কেমন? ওই বইয়েই তিনি লিখলেন,‘‘আমি আমার অমুসলিম ভাইদের আশ্বাস দিচ্ছি যে, পাকিস্তানে যদি ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, তাহলে তাদের অধিকার কাগজের পৃষ্ঠায় দেওয়া হবে, বাস্তবেও তাই দেওয়া হবে। পক্ষান্তরে এখানে যদি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েম হয়, তাহলে তা হবে মুসলমানদের ‘জাতীয় রাষ্ট্র’। সে রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নিজেদের যাবতীয় জাত্যভিমান ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সহকারে স্বেচ্ছাচারমূলক আচরণ করবে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে ইসলামে আপনাদের জন্য যেসব অধিকার নির্ধারিত রয়েছে, মুসলমনরা ও তাদের সরকার তাতে বিন্দুমাত্র কমবেশি করতে পারবে না।’’
অর্থাৎ রাষ্ট্র হবে ধর্মভিত্তিক। এই সম্পর্কে গোলওয়ালকার আর মৌদুদীর কোনও তফাৎ নেই। ‘বাঞ্চ অব থটস’-এ ‘ইউনিকনেস অব হিন্দু রাষ্ট্র’ অধ্যায়ের শুরুতেই গোলওয়ালকার বলছেন,‘‘তথাকথিত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে শুধুমাত্র হিন্দু রাষ্ট্রের ঐতিহাসিকভাবে সঠিক, বাস্তবসম্মত এবং ইতিবাচক ধারণায়। নয়তো, তথাকথিত সংখ্যালঘুরা নিজেদের পৃথক ধর্মের কুঠুরিতে আটকে রাখতে এবং আমাদের রাষ্ট্র-কাঠামোর বিপদের ভয়ঙ্কর উৎস হয়ে উঠতে বাধ্য হবে।’’
দুই শক্তিরই নারীদের সম্পর্কে বক্তব্যে তাৎপর্যপূর্ণ মিল। জামাতের প্রতিষ্ঠাতা সইয়াদ আবু আলা মৌদুদী ‘আধুনিক নারী ও ইসলামী শরীয়ত’-এ লিখলেন,‘‘আপনাদের জানা দরকার, পাশ্চাত্যবাসী নারীদের যে ‘সমমর্যাদা’ দিয়েছে তা তাদেরকে নারীর অবস্থানে রেখে দেয়নি, দিয়েছে অর্ধ পুরুষ বানিয়ে। তারা চায় পুরুষরা যতো কাজ করে, নারীদেরও সেসব কাজ করতে হবে। কিন্তু একথা সবারই জানা, নারীরা যেসব কাজ সম্পাদন করে, পুরুষরা সেগুলো করতে সক্ষম নয়।...সুতরাং ‘সম’ দাবির অর্থ হলো, প্রকৃতি নারীদের উপর যেসব বাড়তি দায়িত্ব অর্পণ করেছে, একদিকে তাদেরকে সেগুলো সম্পাদন করতে হবে-যা পুরুষরা সম্পাদন করতে সক্ষম নয়। অপরদিকে, পুরুষদের সাথে সমভাবে ঐসব দায়িত্বও তাদের পালন করতে হবে, প্রকৃতি যেগুলোর দায়িত্ব পুরুষের উপর ন্যস্ত করেছে। অর্থাৎ ব্যাপারটা যেন এমন যে, তারা নারীদের দ্বারা দেড়গুণ বেশি কাজ করিয়ে নিতে চায়, আর নিজেরা করতে চায় অর্ধেক। এরই নাম দিয়েছে তারা নারী-পুরুষের সমতার বিধান।’’
অর্থাৎ নারীর সমানাধিকার মানে তার আরও শোষণ!
তাহলে নারীদের কাজ কী? কী তাঁদের কর্তব্য? মৌদুদীর কথায়, ‘‘রাজনীতি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, সামরিক কর্মকাণ্ড এবং এই জাতীয় অন্যান্য কাজ পুরুষের কর্মক্ষেত্রের সাথে সংশ্লিষ্ট। এই কর্মক্ষেত্রে নারীকে টেনে আনার অনিবার্য পরিণাম হবে যে, হয় আমাদের পারিবারিক জীবন একেবারেই ধ্বংস হয়ে যাবে যা প্রধানত নারীর কর্মক্ষেত্র, অথবা নারীর ওপর দ্বিগুণ দায়িত্ব বর্তাবে।’’
অর্থাৎ নারীদের কাজ সংসার প্রতিপালন। আর কী কাজ নারীদের?
জামাতের প্রতিষ্ঠাতার মতে, ‘‘মুসলিম নারীরা সবসময়ই নিজেদের আদর্শ ও ঐতিহ্যের ব্যাপারে এরূপ অনমনীয় নীতি প্রদর্শন করেছে এবং নিজের পরিবার ও সন্তানদের ভিনদেশি সভ্যতা-সংস্কৃতির আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে। কিন্তু বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতার অবিরাম আক্রমণ এবং ভ্রান্ত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তাদের মধ্যে এমনকিছু নারী সৃষ্টি হয়েছে, যারা নিজেদের ধর্ম ও সভ্যতা-সংস্কৃতির সাথে অপরিচিত থেকে যাচ্ছে। নাস্তিকতার স্তরে এসে পৌঁছাবার চাইতে বড় অধ্যপতন মুসলিম নারীর জন্য আর কি হতে পারে?’’
হিন্দুত্ববাদীদের প্রাণপুরুষ, ‘গুরুজী’র চোখে নারীদের দায়িত্ব কী? এই ক্ষেত্রে নারী নয়, গোলওয়ালকারের আহ্বান, উপদেশ ‘মাতৃত্ব’র প্রতি। বিবাহিত মহিলা, সন্তান আছে এমন মহিলা ছাড়া নারীদের প্রতি, তরুণীদের প্রতি সঙ্ঘের ‘গুরুজী’র কোনও উপদেশ নেই। ফলে গোলওয়ালকারের অবধারিত বক্তব্য,‘‘উদীয়মান প্রজন্মকে লালন পালন করা আমাদের মা’দের বিশেষ দায়িত্ব।’’ অর্থাৎ শিশুপালন একজন নারীর বিশেষ দায়িত্ব। সঙ্ঘ মনুস্মৃতি অনুসারে সমাজ, রাষ্ট্র পরিচালনা করতে চায়। সেই মনুস্মৃতিতে নারীর বিয়ে হওয়া বাধ্যতামূলক। তাঁর বেদ পড়া নিষিদ্ধ। নারী তাঁর স্বামীকে মেনে চলবে। গোলওয়ালকারের মতে,‘‘আধুনিকতা আমাদের সংস্কৃতি ধ্বংস করছে। ‘জ্ঞানেশ্বরী’র একটি পংক্তি বলছে একজন জ্ঞানী পুরুষ তার ভালো কাজ ঢেকে রাখে বিনয় দিয়ে, তেমনই এক জ্ঞানী নারীর তার দেহ ঢেকে রাখে। কিন্তু আধুনিক মহিলারা মনে করে যে, আধুনিকতার মানে হচ্ছে তাদের উন্মুক্ত দেহ বেশি করে দেখানো। কী লজ্জা।’’
জামাত-ই-ইসলামীর বিচারে ‘ধর্মহীন গণতন্ত্র’ একটি ‘ধোঁকা।’ অর্থাৎ প্রতারণা। ‘ধর্মহীন গণতন্ত্র’ বলতে মৌদুদী নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রর কথা বোঝাতে চেয়েছেন। মৌদুদীর ভাষায়,‘‘...প্রথমে শয়তান একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুনিয়াকে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং উদার নীতির নামে ধোঁকা দিতে থাকে এবং এরই ভিত্তিতে সে অষ্টাদশ শতকে পুঁজিবাদ ও ধর্মহীন গণতন্ত্র কায়েম করায়।’’ মৌদুদীর ‘উদারনীতি’ নিশ্চিতভাবেই আজকের ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের উদারনীতি নয়। মৌদুদীর সময়কালের পরিপ্রেক্ষিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায় ‘উদারনীতি’ বলতে তিনি ‘অষ্টাদশ শতকে পুঁজিবাদ’ কায়েম হওয়া ইউরোপের দেশগুলির কথা বলতে চেয়েছেন। সামন্ততন্ত্রকে কিছুটা ধাক্কা দেওয়া সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের বিস্তারকেই বোঝাতে চেয়েছেন। যা তার বিলকুল না পসন্দ। মৌদুদীর ‘ধর্মহীন গণতন্ত্র’ সম্পর্কে সঙ্ঘের মতামত কী? গোলওয়ালকারের ভাষায়,‘‘সবার আগে, ধর্মনিপেক্ষতার ধারণা পশ্চিমী দুনিয়ায় তৈরি, এর সঙ্গে আমাদের দেশে কোনও সম্পর্ক নেই।’’ আর? ‘হিন্দু রাষ্ট্র অ্যান্ড সেকুলারিজম’ বোঝাতে গিয়ে গোলোয়ালকার বলছেন,‘‘যদি, যেভাবেই হোক, যেভাবে তাকে বোঝানো হয়, তা না হয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে যদি না হয় যে, তা ধর্ম-বিরোধী, বরং সেখানে প্রতিটি ধর্মের বিকশিত হয়ে ওঠার সুযোগ থাকে, কোনও ধর্মের অন্য ধর্মের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া থেকে বিরত করা হয়, তবে তা নিঃসন্দেহে হিন্দু রাষ্ট্রের মর্মবস্তুর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।’’
অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যা! দু’জনেরই, দুই শক্তিরই।
ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে কমিউনিস্টদের নিকেশ করার চক্রান্তে পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিল সঙ্ঘ আর জামাত-ই-ইসলামী। এরাজ্যে তাদের যোগসূত্র ছিল, আছে— একটি দলই, তৃণমূল। সারদার টাকা চলে গেছিল বিশেষ পথে বাংলাদেশের জামাত-ই-ইসলামীর কাছে। সেই টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছিল তৃণমূলের এক সাংসদের বিরুদ্ধে। বিজেপি-শাসনে সারদার তদন্ত শেষ হয়নি। জামাতের তহবিলে টাকা পাচারের অভিযোগেরও তদন্ত বিশ বাঁও জলে। কেন সঙ্ঘ সেই প্রশ্ন তোলে না?
মৌদুদী অথবা গোলওয়ালকার, সঙ্ঘ অথবা জামাত-ই-ইসলামী—দুই পক্ষই সমাজতন্ত্র, কমিউনিস্টদের প্রসঙ্গে খড়গহস্ত। এই সম্পর্কে সঙ্ঘের মতামত বহুল আলোচিত। কিন্তু জামাত-ই-ইসলামীর মত কী? মৌদুদীর মতে,‘‘দ্বিতীয় ধোঁকা: সামাজিক ও সুবিচার এবং সমাজতন্ত্র।’’ তাঁর মতে,‘‘অতঃপর খুব বেশি সময় অতিবাহিত হতে পারেনি, এর মধ্যেই শয়তান সামাজিক সুবিচার ও সমাজতন্ত্রের নামে আরেকটি প্রতারণার জন্ম দেয়। এখন সে এই মিথ্যার ছদ্মাবরণে অন্য একটি ব্যবস্থা কায়েম করাচ্ছে।’’ আরএসএস ঠিক যেমনটি প্রচার করে কমিউনিস্টদের অত্যাচারী প্রমাণ করতে, মৌদুদীর কথাতেও সেই আবহ। তিনি লিখেছেন,‘‘এই নতুন ব্যবস্থা(সমাজতন্ত্র) বর্তমান সময় পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে এত মারাত্মক জুলুম-নির্যাতন ও স্বৈরাচারে প্লাবিত করে দিয়েছে যার দৃষ্টান্ত মানব জাতির ইতিহাসে কখনো পাওয়া যায়নি।’’
এই ক্ষেত্রে সঙ্ঘ আর জামাতকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে দেয় কমিউনিস্টদের সম্পর্কে। যেমন ২০২৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে আরএসএস’র বক্তব্য ছিল,‘‘ইহা প্রমাণিত সত্য যে, কমিউনিস্ট শাসন মানবতার পক্ষে সর্বাপেক্ষা বড় হুমকি। এই রাজ্যের মানুষের ভাগ্য ভালো যে বিলম্বে হইলেও তাহাদের শাসন হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছে।’’ অর্থাৎ মমতা-শাসন ‘মুক্তিলাভ।’ জামাতের তহবিলে টাকা পৌঁছায় সেই ‘মুক্তিলাভ’র সময়েই!
Comments :0