Delhi Blast

সন্ত্রাসের জাল কত গভীর, দেখিয়ে দিল লালকেল্লা

জাতীয়

 নাশকতা নাকি দুর্ঘটনা? দিল্লির সোমবারের বিস্ফোরণের তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ এই সম্ভাবনার সঙ্গেই সমানে চলে এসেছে জৈশ-এ-মহম্মদের ‘হোয়াইট কলার’ মডিউলের প্রসঙ্গ। গোয়েন্দাদের দাবি, এই মডিউলের জাল সীমান্তের ওপার পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এদের মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদী অর্থায়ন, নিয়োগ ও অস্ত্র পাচারের একটি আন্তর্জাতিক চক্র সক্রিয় ছিল। ২০১৪-র পর পুরানো জিনিসকে নতুন বোতলে ভরে পেশ করার একটা চল চলছে এদেশে। সেই নাম বদলের পথেই এখন এল ‘হোয়াইট কলার’ মডিউল। সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সমাজের প্রতিষ্ঠিত অংশ, ডাক্তার অধ্যাপকদের সংযোগের অভিযোগ মোটেই নতুন নয়। দিল্লির সংসদ ভবনে হামলার সূত্রে এক অধ্যাপকের তো এদেশেই ফাঁসি হয়েছে। এবার চার-পাঁচজন নাম জড়াতেই নতুন নামের আমদানি হয়েছে। কিন্তু ওই নতুন নামেই সামনে চলে আসছে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে ঢক্কানিনাদও। কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ শেষ বলে হুঙ্কার ছুঁড়লেও স্পষ্ট ‘অপারেশন সিঁদুর‘ কিংম্বা ‘অপারেশন মহাদেবের’ পরও সন্ত্রাসের জাল বিস্তৃত হচ্ছে। 
গোয়েন্দাদের কথায়, জম্মু-কাশ্মীর পুলিশের তৎপরতায় হদিশ পাওয়া গেছে ওই আন্তঃরাজ্য ও আন্তর্জাতীয় সন্ত্রাসবাদী মডিউলের। উদ্ধার হয়েছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র এবং প্রায় ২৯০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক সামগ্রী। পুলিশ সূত্রে খবর, এই সাফল্যের সূত্রপাত হয় দুই ওভারগ্রাউন্ড ওয়ার্কার (ওজিডব্লিউ)-কে গ্রেপ্তার করার মাধ্যমে, যাদের কাছ থেকে জৈশ-এ-মহম্মদ ও আনসার গজওয়াত-উল-হিন্দ-এর প্রচারপত্র উদ্ধার হয়।
গোয়েন্দারা দু’দিন পর দিল্লি হামালার পিছনে এই দুই গোষ্ঠীর যৌথ অপারেশনের কথা বলছে। এর মধ্যে জৈশের নাকি কোমর ভেঙে গিয়েছিল অপারেশন সিঁদুরে। তারাই আবার দ্রুত সেরে উঠে সজিয়ে গুছিয়ে নেমেছে ভারতের বিরুদ্ধে। 
হামলার পর কাল সকালেই মোদী চলে গিয়েছিলেন ভুটান ঘুরতে। বিদেশ সফর শেষ করে আজ দিল্লিতে ফিরে সুরক্ষা নিয়ে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ বৈঠক সেরেছেন। মন্ত্রীসভার সেই উচ্চ পর্জাবের বৈঠক শেষে অবশ্য রক্তক্ষয়ী ওই বিস্ফোরণকে বলা হয়েছে ‘নৃশংস সন্ত্রাসবাদী লার্যকালাপ’। ঘটনার আটচল্লিশ ঘন্টা কেটে যওয়ার পর।
ঘটনাটি ২ নভেম্বর, শ্রীনগরের নওগাম থানার পুলিশ ওই দুই সন্দেহভাজনকে আটক করার পর থেকেই তদন্ত শুরু হয়। তিন দিনের মাথায় নাকি গোটা নেটওয়ার্কের হদিস পায় পুলিশ।
তদন্তে প্রকাশ, ধৃতরা এক বৃহৎ সন্ত্রাসবাদী নেটওয়ার্কের অংশ এবং তাদের মূল হ্যান্ডলার মৌলবি ইরফান আহমদ। তিনি সোপিয়ান জেলার বাসিন্দা হলেও নওগাম এলাকার এক মসজিদের ইমাম পরিচয়ে কাজ করছিলেন। পরে ওই ইমামকেও আটক করে জেরা করে পুলিশ। তিনি জানান, এই মডিউলে জম্মু-কাশ্মীরের বাইরে কর্মরত একাধিক তরুণ চিকিৎসক জড়িত রয়েছেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, এই সূত্রে উত্তর প্রদেশের সহারানপুরে অভিযান চালিয়ে স্থানীয় পুলিশের সহযোগিতায় ডাঃ আদিল আহমদ রাঠেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে ৬ নভেম্বর আটক করে পরদিন ট্রানজিট রিমান্ডে শ্রীনগরে আনা হয়। তার জেরায় পুলিশ একটি মেডিক্যাল কলেজের লকার থেকে একটি একে সিরিজের রাইফেল উদ্ধার করে।
ডাঃ রাঠের নাকি স্বীকার করেন, ফারিদাবাদ সহ বিভিন্ন স্থানে অন্য সদস্যদের কাছে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক মজুত রয়েছে। এরপর পুলিশ ডাঃ মুজামিল আহমদ গনাইকে গ্রেপ্তার করে। এই মুজামিল বোনের বিয়েতে যোগ দিতে পুলওয়ামায় ফিরেছিলেন। তার ফারিদাবাদের ভাড়া করা ঘর থেকে উদ্ধার হয় বিশাল পরিমাণ বিস্ফোরক।
তদন্তে প্রকাশ, গনাই ফারিদাবাদের একটি বেসরকারি হাসপাতালে কাজ করতেন। সেখানেই কর্মরত ছিলেন উমর নবি। এই নবিই দিল্লি বিস্ফোরণ মামলার অন্যতম সন্দেহভাজন।
তথাকথিত সেই ‘হোয়াইট কলার’ সন্ত্রাসবাদী মডিউলের এগুরুত্বপূর্ণ সদস্য ডাঃ মুজাম্মিল গনাইয়ের মোবাইল ফোনের ডাম্প ডেটা বিশ্লেষণে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য সামনে এসেছে। তদন্তে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে তিনি একাধিকবার লালকেল্লা এলাকায় গিয়েছিলেন রেকি করতে, অর্থাৎ নিরাপত্তা ও জনসমাগম পর্যালোচনা করতে। সঙ্গে ছিলে উমর নবিও পুলিশ মনে করছে, সাধারণতন্ত্র দিবসে ঐতিহাসিক এই স্মারকে হামলার পরিকল্পনা ছিল, তবে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার কারণে তা ব্যর্থ হয়।
তদন্তে আরও জানা যায়, মূল দুই সন্দেহভাজন — ডাঃ উমর নবি (যিনি বিস্ফোরিত হুন্ডাই আই২০ গাড়িটি চালাচ্ছিলেন) এবং ডাঃ মুজাম্মিল গনাই — দু’জনেই তুরস্কে গিয়েছেন ট্রেনিং নিতে। তাঁদের পাসপোর্টে তুরস্কের ইমিগ্রেশন সিল পাওয়া গেছে। তদন্তকারীরা এখন খতিয়ে দেখছেন, সেখানে তাঁদের কোনও বিদেশি সন্ত্রাসবাদী হ্যান্ডলারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল কি না।
সূত্রের খবর, দিল্লি পুলিশ ইতিমধ্যে শহরের সব থানায়, আউটপোস্টে ও সীমান্ত চেকপোস্টে সতর্কতা জারি করেছে। লালকেল্লা বিস্ফোরণ মামলায় জড়িত সন্দেহভাজন একটি লাল রঙের ফোর্ড ইকোস্পোর্ট গাড়ি খোঁজা হচ্ছে। এই গাড়িটি বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হুন্ডাই আই২০-র সঙ্গে যুক্ত সন্দেহ করা হচ্ছে।
একটু অদ্ভুত ঠেকলেও ধামাধরা মিডিয়ায় এই সমস্ত কাহিনিকে পেশ করা চলছে ‘সাফল্য’ হিসেবে। দেখানো হচ্ছে ভেস্তে দেওয়া হয়েছে ‘হোয়াইট কলার’ মডিউলের ছক। তাহলে তেরোটি প্রাণ গেল কীসে? মাসুদ আহারকে পাকিস্তান আজারবাইজানে পাঠাচ্ছে বলে এদেশের মিডিয়া যখন চিল চিৎকার করছে, তখন কোনও প্রশ্নই উঠছে না ‘অপারেশন সিঁদুর’ জারি থাকা সত্ত্বেও দেশ এত বড় সন্ত্রাসের জাল বিছালো কী করে?
জৈশ-এর সঙ্গী যে সংগঠনের কথা বলা হচ্ছে গোয়েন্দাদের দাবি মতো সেই আনসার গজওয়াত-উল-হিন্দ তো কাশ্মীরে আল কায়েদার সহযোগী সংগঠন। বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পর যে জাকির মুসা কাশ্মীরে হিজবুলের পোস্টার বয় হয়ে উঠেছি, হিজবুল ছেড়ে সেই মুসাই তো তৈরি করেছিল এই গোষ্ঠীটি। চণ্ডীগড়ের কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে আসা মুসার হিজবুলের ‘কাশ্মীরের স্বাধীনতার’ লাইন পছন্দ ছিল না। তার ‘লড়াই কাশ্মীরের স্বাধীনতার জন্য নয়, ইসলামী শরিয়াহ প্রতিষ্ঠার জন্য’। তাই নতুন সংগঠন। রাতারাতি কিছু অপারেশন সফল করে ইউএপিএ-র আওতায় ‘নিষিদ্ধ’ হয়ে যাওয়া। 
তারপর ২০১৯-এর মে মাসে ত্রাল এলাকার ডাদসারা গ্রামে এনকাউন্টারে জাকির মুসা খতম। একে একে নতুন কমান্ডার লেলহার, ইনায়াত উল্লাহ ও সাজ্জাদ আফগানিও শেষ। ২০২০-র পর ভাঙাচোরা, বিকেন্দ্রীভূত স্লিপার সেল হয়ে গেল। কিন্তু অনলাইন র্যা২ডিক্যালাইজেশন, ফান্ডিং ও অস্ত্র পাচার চক্রে যুক্ত থেকে লস্কর-ই-তৈবা বা জৈশ-এ-মহম্মদ-এর সহযোগী হিসেবে কাজ করে চলেছে। এবার সেই জাল যে কত বড়, তা এখন হয়তো ঠাহর পাচ্ছে গোয়েন্দারা। 
এখনও পর্যন্ত ধৃত আটজনের মধ্যে সাতজন কাশ্মীরের বাসিন্দা। তারা হলো আরিফ নিসার দার ওরফে সাহিল, ইয়াসির-উল-আশরাফ, মকসুদ আহমদ দার ওরফে শহিদ (নওগাম), মৌলবি ইরফান আহমদ (সোপিয়ান), জামির আহমদ আহাঙ্গার (গান্ডেরবাল), ডাঃ মুজাম্মিল গনাই (পুলওয়ামা), ডাঃ আদিল আহমদ (কুলগাম) এবং ডাঃ শাহিন সাঈদ (লক্ষ্ণৌ)।
এদের জেরা করেই নাকি এখন সবটা জেনে ফেলেছে এনআইএ। শুধু জানতে পারেনি, লাল কেল্লার পার্কিং লটে বিস্ফোরক ঠাঁসা গাড়ির মধ্যে বসে উমর ঠিক কী করছিল? জানতে পারেনি ৬ই ডিসেম্বর হামলার পরিকল্পনা থাকলে ১০ নভেম্বর বিস্ফোরক বোঝাই গাড়ি নিয়ে উমর কেন দিল্লি চলে গেল, আর ১১ ঘণ্টা ধরে কখনও অক্ষরধাম মন্দির, কখনও কনট প্লেস ঘুরে লাল কেল্লায় এসে বসে রইল কেন?
চিত্রনাট্য লেখা হয়ে গেলে হয়তো কিছু আলটপকা উত্তর আসবে!

 

Comments :0

Login to leave a comment