Post Editorial

এসআইআর এবং উত্তরবঙ্গে বিভাজনের রাজনীতি

উত্তর সম্পাদকীয়​

গৌতম ঘোষ 


সম্প্রতি বিহারে ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) সম্পূর্ণ হয়েছে। দেখা যাচ্ছে প্রায় ৬৫ লক্ষ ভোটারের নাম তালিকা থেকে বাদ গেছে। বিহারে এক অরাজক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়াটি সমাপ্ত হয়েছে। এখানে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল প্রতিটি বাড়িতে অন্তত তিনবার বুথ লেভেল অফিসার (বিএলও) পরিদর্শন করবে এবং প্রতিটি ভোটারকে দুটি করে গণনা ফর্ম (একটি জমা দেওয়ার জন্য অন্যটি রশিদ হিসেবে রেখে দেওয়ার জন্য) দেওয়া হবে। এসআইআর শুরুর আগেই নির্বাচন কমিশন প্রচার করে দিল বিহারে নেপাল, বাংলাদেশ, মায়ানমার থেকে বিপুল সংখ্যায় বিদেশি নাগরিক বসবাস করছে। 
আসামের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি এনআরসির নাম করে ১৯ লক্ষ ভোটারকে ‘ডি ভোটার’ করা হয়েছে। সন্দেহজনক ভোটার থেকে ভোটাধিকারবিহীন নাগরিককে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের উপর আতঙ্কজনক আবহ সৃষ্টি করা হয়েছে। আসামে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল এসআইআর-এর মাধ্যমে বিহারে সেই পরিস্থিতি তৈরি করা হলো। বিহারের পর পশ্চিমবঙ্গেও এসআইআর করার কথা নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেছে। 
পশ্চিমবঙ্গে বাংলাভাষী মুসলিম ও হিন্দু এই উভয় ধর্মাবলম্বী পরিযায়ী শ্রমিকদের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে ‘বাংলাদেশী’ হিসাবে চিহ্নিত করে হয়রানি করা হচ্ছে। এমনকি বাংলাদেশে জোরপূর্বক পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এসআইআর-এর মধ্য দিয়ে এক বিরাট সংখ্যক মুসলিম ভোটারদের যদি বাদ দিয়ে দেওয়া যায় তাহলে বিজেপি’র সুবিধা হবে। এই ধারণা থেকে বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু ভোট নির্বাচন কমিশনকে ব্যবহার করে কমিয়ে ফেলার চক্রান্ত হচ্ছে। 
নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনের কথা ঘোষণা হতেই উত্তরবঙ্গ জুড়ে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়ে গেছে। মহকুমা শাসকের দপ্তরগুলিতে দীর্ঘ লাইন লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিভিন্ন প্রামাণ্য কাগজ জোগাড় করতে। বহু মানুষ ডোমিসাইল সার্টিফিকেট যোগাড় করতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। 
এমনিতেই উত্তরবঙ্গে নানা জনজাতির মানুষের বসবাস। এখানে রয়েছে লক্ষ লক্ষ চা বাগান শ্রমিক যাদের বেশিরভাগই আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্স এসব অঞ্চলে কোচ, মেচ, রাভা, ধিমাল, নেপালি (গোর্খা) যুগ যুগ ধরে একসাথে বসবাস করে আসছে। এই শ্রমিকদের বেশিরভাগেরই কোনও জমির কাগজপত্র নেই। বিশাল সংখ্যক শ্রমিক পরিযায়ী হয়ে ভিন্ রাজ্যে কাজে চলে গেছে। এদের পূর্বপুরুষের দলিল দস্তাবেজ ঠিকঠাক নেই। এসআইআর-এর ফলে এই অংশের ভোটারদের নাম তালিকা থেকে বাদ যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যেই এসআইআর-এর প্রথম ধাপ হিসাবে ১১ টি জেলার ২০০২ সালের ভোটার তালিকা কমিশনের ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের ভোটার লিস্টের নিবিড় সংশোধনের কাজ আগস্ট মাস থেকে শুরু করার কথা ছিল। ২০০২-কে ভিত্তিবর্ষ ধরে প্রথম দফায় যে ১১টি জেলার ভোটার লিস্ট নির্বাচন কমিশন দিয়েছেন তাতে উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, দক্ষিণ দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর জেলাগুলি আছে। এছাড়াও অন্য কিছু জেলার তালিকাও আছে। বিহারে ভোটার লিস্ট নিবিড় সংশোধনের নামে নির্বাচন কমিশনের ল্যাজে গোবরে অবস্থা। ইতিমধ্যে জানা গেছে তিরিশে সেপ্টেম্বর ৬৫ লক্ষ নাম বাদ যাবার পরে খসড়া তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ার জন্য আরও দুই লক্ষ আবেদন জমা পড়েছে। এখানেই প্রশ্ন উঠছে এই ২ লক্ষ ভোটার খসড়া তালিকায় ঢুকলো কিভাবে? এখানে উল্লেখ্য যে, বিহারে বাদ পড়া নামের মধ্যে বিরাট অংশের শ্রমজীবী মানুষের নাম আছে এবং পরিযায়ী শ্রমিকদের মধ্যে ৭৫ শতাংশ মহিলাদের নাম আছে। 
এই অসঙ্গতিগুলি লক্ষ্য করে উত্তরবঙ্গজুড়ে নতুন করে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। উত্তরবঙ্গের সমতল তরাই ডুয়ার্স কোচবিহার এবং দুই দিনাজপুরে অসংখ্য পরিযায়ী শ্রমিক যারা বাইরে কাজ করতে গেছে এই অংশের মধ্যেই আশঙ্কা সবচাইতে বেশি।    
উত্তরবঙ্গের জনসংখ্যা এবং জনবিন্যাস।
উত্তরবঙ্গের আটটি জেলায় পার্বত্য এলাকায় নেপালি গোর্খা জনজাতির আধিক্যই বেশি। শিলিগুড়ি শহর এবং গ্রামাঞ্চল মিশ্র ভাষাভাষী মানুষজনের বসবাস। জলপাইগুড়ি জেলায় এবং আলিপুরদুয়ার জেলায় বাংলা ভাষাভাষী মানুষের সাথে চা বাগানগুলিতে বিরাট সংখ্যায় আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। রাজবংশীরা আঞ্চলিক ভাষায় কথা বললেও লেখাপড়া এবং যোগাযোগের ভাষা মূলত বাংলা। 
২০১১ জনগণনা অনুযায়ী এই আটটি জেলার জনসংখ্যা ১ কোটি ৮৯ লক্ষ ৫৩ হাজার ৮০২ জন। ধর্মের ভিত্তিতে জনসংখ্যার বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জলপাইগুড়ি জেলায় হিন্দু ৮১.৫ শতাংশ, মুসলিম ১১.৫১ শতাংশ, ক্রিশ্চান ৪.৮১ শতাংশ। মালদা জেলায় মুসলিম ৫১.২৭ শতাংশ, হিন্দু ৪৭.৯৯ শতাংশ। উত্তর দিনাজপুর জেলায় মুসলিম ৪৯.৯২ শতাংশ, হিন্দু ৪৯.৩১ শতাংশ। দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় হিন্দু ৭৩.৫৫ শতাংশ, মুসলিম ২৪.৬৩ শতাংশ। দার্জিলিঙ জেলায় হিন্দু ৭৬.০৬ শতাংশ, মুসলিম ৬.৩৪ শতাংশ, ক্রিশ্চান ৬.৫৪ শতাংশ। কোচবিহার জেলায় হিন্দু ৭৪.০৫ শতাংশ, মুসলিম ২৫.৫৫ শতাংশ। আলিপুরদুয়ার জেলায় হিন্দু ৮০.০৭ শতাংশ, মুসলিম ৮.৭৪ শতাংশ ক্রিশ্চান ৭.৫২ শতাংশ। কালিম্পং জেলায় হিন্দু ৬০.৯৪ শতাংশ, মুসলিম ১.৫৯ শতাংশ, বৌদ্ধ ২০.৯৪ শতাংশ, ক্রিশ্চান ১৪.৮ শতাংশ। এখানে উল্লেখ্য উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রবণতা দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির চাইতে বেশি। উত্তরবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে ১৬ শতাংশ সেখানে দক্ষিণবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৩ শতাংশ।
কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি এবং আরএসএস-এর পক্ষ থেকে লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের মনগড়া গল্প ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইউনাইটেড নেশনস-এর তথ্য অনুযায়ী মোট ২২ হাজার ৫০০ জন রোহিঙ্গা ভারতে অনুপ্রবেশ করেছে। এর মধ্যে ছয়-সাত হাজার জন ডিটেনশন ক্যাম্পে আছে। ধরে নেওয়া যায় প্রায় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু ভারতে প্রবেশ করতে পারে। আসামের মাটিয়া ডিটেনশন ক্যাম্প, দিল্লির লামপুর শাহজাদবাগ ডিটেনশন ক্যাম্প, জম্মু এলাকায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উপস্থিতি আছে। মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের সময় রোহিঙ্গা শরনার্থীরা বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এলাকায় অনুপ্রবেশ করে। বিশাল সংখ্যক রোহিঙ্গা শরনার্থী চট্টগ্রামে বর্তমানে বসবাস করছে। ভারতের রোহিঙ্গাদের নিয়ে শাসক দল বিজেপি এবং আরএসএস বিভাজনের রাজনীতিকে উস্কে দেওয়ার জন্য মিথ্যা প্রচার চালাচ্ছে। 
উত্তরবঙ্গে ভুটানি শরণার্থীদের নিয়ে কিছুটা সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকে এক বিরাট সংখ্যক নেপালি জনজাতির মানুষ যারা ভুটান থেকে বিতাড়িত হয়েছে, এরা দক্ষিণ ভুটান থেকে নাগরিকত্ব ও সংস্কৃতিক সংঘাতের ফলে বিতাড়িত হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। ভারত সরকার এদের স্থান না দেওয়ায় এরা ঢোকার চেষ্টা করে নেপালে। সীমান্তে বাধা প্রাপ্ত হয়। অবশেষে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ভুটানি শরণার্থীরা নেপালের মাই খোলা ক্যাম্পে আশ্রয় পায়। ভারতবর্ষের মাটিকে এই ভুটানি শরণার্থীরা ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করেছে। রেজিস্টার্ড ভুটানি শরণার্থী ছাড়াও বেশ কিছু শরণার্থী উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলাতে জমি জায়গা ক্রয় করে বসবাস করতে শুরু করেছে। আলিপুর জেলা থেকে পানিট্যাংকি বর্ডার এলাকা পর্যন্ত নেপালিভাষী সংস্কৃতির মানুষ বসবাস করে। ভাষাগত সাংস্কৃতিক ঐক্যের কারণে ভুটানি শরণার্থীরা এখানকার জনবসতির সাথে মিশে গেছে প্রায়। এছাড়া ভারত-নেপাল সীমান্তে উন্মুক্ত বর্ডার থাকার কারণে এবং ভাষাগত সাংস্কৃতিক ঐক্য থাকার কারণে বহু নেপালি জনজাতির মানুষ দার্জিলিঙ পার্বত্য এলাকা মিরিক নকশালবাড়ি এলাকায় এবং মাটিগাড়া এলাকায় জমি জায়গা ক্রয় করে বসবাস করতে শুরু করেছে। যার ফলে এই এলাকার জনবিন্যাসগত পরিবর্তন ঘটেছে কিছুটা। এছাড়া মণিপুর থেকে বহু নেপালি মানুষ এখানে জমি জায়গা কিনে বসবাস করছে। কিছু জায়গায় স্থানীয় রাজবংশী আদিবাসীদের সাথে কিছু কিছু সংঘাতের খবরও বেরিয়ে আসছে। 
নেপাল থেকে গোর্খা রেজিমেন্টে যারা চাকরি করতে যায় তারা চাইলে ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব গ্রহণ করতে পারে। এরকম সেনাবাহিনীর কর্মচারীরাও এতদঞ্চলে বসতি গড়ে তুলছে। এছাড়া উন্মুক্ত সীমান্ত থাকার কারণে এবং নেপালের সাথে ১৯৫০ এর চুক্তি মোতাবেক ভারত নেপালের নাগরিকদের সীমান্ত পারাপারের জন্য পাসপোর্ট প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া নেপাল বর্ডার সংলগ্ন ভারতে বসবাসকারী নেপালিদের সাথে নেপালের মেয়েদের বৈবাহিক সম্পর্ক একটি স্বাভাবিক ঘটনা। এই অংশের মানুষদের ভারতে আধার কার্ড, প্যান কার্ড এবং ভোটার লিস্টে অনেকের নাম উঠে গেছে। কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের নিবিড় ভোটার লিস্ট সংশোধনের ঘোষণায় এই অংশের মানুষের মধ্যেও একটি আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।  
আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার নির্দিষ্ট ক্রোনোলজি মেনে শাসন ব্যবস্থাকে পরিচালনা করছে। নাগরিকপঞ্জি, এনআরসি, সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (সিএএ) এবং এই সময়ের এসআইআর এই সব কিছুই ক্রোনালোজি মেনেই হচ্ছে। এদের মূল লক্ষ্য বিভাজনের রাজনীতি এবং ভারতবর্ষকে একটি হিন্দুত্ববাদীদের রাষ্ট্রে পরিণত করা। 
পৃথিবী জুড়ে দক্ষিণপন্থার শক্তি বৃদ্ধি এবং এই শক্তিগুলি এই সময়ে তীব্র অভিবাসী বিরোধী রাজনীতির আশ্রয় নিয়ে সমাজে মেরুকরণ তৈরি করছে দেশগুলিতে বাড়তে থাকা বেকারত্ব, গরিবী এবং অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে জনগণের নজর ঘুরিয়ে রাখার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, জার্মানি, হাঙ্গেরি, তুরস্ক সহ বিভিন্ন দেশে দেশে ধ্বংসাত্মক জাতি বিদ্বেষী প্রচার চলছে। মোদী সরকারও একইভাবে দেশের অর্থনৈতিক মন্দার থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে এনআরসি, সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট এবং বর্তমান সময়ে এসআইআর চালু করার মাধ্যমে ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়াতে চাইছে। এনআরসির মাধ্যমে আসামে লক্ষ্য করা গেছে ১৯ লক্ষ ভোটারকে ডি ভোটার করে দেওয়া হয়েছে। এই ১৯ লক্ষ ডি ভোটারের মধ্যে ১৪ লক্ষই হচ্ছে হিন্দু বাঙালি ভোটার এবং ভালো সংখ্যায় আদিবাসী ভোটাররাও আছে। এছাড়া এর মধ্যে নেপালি তথা গোর্খা এবং ভালো সংখ্যায় বিহারী ভোটাররা আছে। মোদী এবং অমিত শাহ এই এনআরসি ছুট ভোটারদের ‘ঘুষপেটিয়া’, ‘উইপোকা’ ইত্যাদি ভাষায় অভিহিত করে ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করতে চাইছে। 
সিটিজেনশিপ আমেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের নাম করে নতুন ধাপ্পাবাজি শুরু করেছে বিজেপি আরএসএস। এই আইনে উল্লেখ করা হয়েছে পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ধর্মীয় সংখ্যালঘু মানুষরা যারা ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার, মুসলিম বাদে যারাই এই দেশে আসবে এবং নাগরিকত্বের আবেদন করলে তাদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া হবে। এই উদ্বাস্তুরা ধর্মীয় নিপীড়নের তথ্যপ্রমাণ দাখিল করতে পারলেই তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। ১৯৭১এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পরে উদ্বাস্তু মানুষের ঢল এ রাজ্যে লক্ষ্য করা যায়। উত্তরবঙ্গ জুড়েও এই ধরনের উদ্বাস্তু মানুষের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এই ধরনের পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের শুধু বোকা বানানোর জন্য সিএএ-এর টোপ দিয়ে নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে বিজেপি আরএসএস-এর নেতৃত্ব। 
উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসবাস করা এই ধরনের উদ্বাস্তুদের মধ্যে এসআইআর ঘোষণা হওয়ার ফলে বিরাট আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। সিএএ-এর মাধ্যমে নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলাম ধর্ম বাদে অন্য যেকোনো ধর্মের মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই বিষয়টিও ভারতের সংবিধান বিরোধী। সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রের চোখে সকল ধর্মাবলম্বী মানুষই সমান এবং সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারায় সকলকে নিজের পছন্দের ধর্ম অবলম্বন করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া আছে।
ভারতে দুই কোটি অনুপ্রবেশের তত্ত্ব  
আরএসএস এবং বিজেপির পক্ষ থেকে বারবার প্রচার করা হয় ভারতবর্ষে নাকি ২ কোটি অনুপ্রবেশকারী আছে। আসলে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশকারীদের কোন নির্দিষ্ট সংখ্যা বা তথ্য কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। মনগড়া কিছু পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় সরকার বলছে। ৩ কোটি ৫০ লক্ষ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশীর নাকি ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাস করছে। তাই যদি হয় তবে ভারতবর্ষের সীমান্ত পাহারায় বিএসএফ কি করছে? স্বরাষ্ট্র দপ্তর কি করছে? দেশভাগের সময় ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রায় ৫২.৮৩ লক্ষ উদ্বাস্তু ভারতে এসেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তার মধ্যে আবার একটি অংশ ফেরতও চলে যায়। দেশভাগের কারণে যারা এই দেশে এসেছেন, তারা কেউ অনুপ্রবেশকারী নয়, তারা উদ্বাস্তু। 
ভারত সরকারের এখনো সুস্পষ্ট উদ্বাস্তু নীতি নেই। জাতিসংঘের ১৯৫১ রিফিউজি কনভেনশন এবং ১৯৬৭ প্রটোকলে ভারত সরকার সই করেনি। উদ্বাস্তু বিরোধী মানসিকতা থেকেই তৈরি হয়েছে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী তত্ত্ব। মুসলিম অনুপ্রবেশের মিথ্যা প্রচার লাগাতার ভাবে চালানো হচ্ছে। উত্তরবঙ্গের জেলাগুলির জনসংখ্যার বৃদ্ধির যে প্রবণতা তাতে এটা পরিষ্কার কোন জেলাতেই মুসলিম জনসংখ্যা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চাইতে এমন কিছু বেশি নয়। একমাত্র মালদা জেলা যেখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চেয়ে মুসলিম ধর্মাবলম্বী মানুষ সামান্য সংখ্যায় বেশি ঐতিহাসিক ভাবেই। মুসলিম অনুপ্রবেশের যে তথ্য আরএসএস বা বিজেপি প্রচার করে তা সর্বৈব মিথ্যা। 
১৯৫১ সাল থেকে ১৯৮০ দশক পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে মুসলিম জনসংখ্যা সাধারণের থেকে বেশি থাকলেও ১৯৯১ সাল থেকে বৃদ্ধির হার ধারাবাহিকভাবে কমেছে। গত দু’দশকে পশ্চিমবঙ্গের সার্বিক বৃদ্ধির হার এবং মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দুটোই নিম্নগামী এবং এর থেকে অনুপ্রবেশের কোনরকম ইঙ্গিত মেলে না।
সম্প্রতি আসামের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত বিশ্ব শর্মা বলেছেন, আসামের বসবাসকারী মুসলিমরা মাতৃভাষা হিসেবে যদি বাংলা রেকর্ড করান, তবে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে সুবিধা হবে। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাংলাভাষী পরিযায়ী শ্রমিকদের উপর নামিয়ে আনা হচ্ছে চরম অত্যাচার। ইতিমধ্যেই জোর করে বাংলাভাষী শ্রমিকদের ফেরত পাঠানোর ঘটনাও ঘটেছে। 
উল্লেখ্য পশ্চিমবঙ্গে কর্মসংস্থান ও কলকারখানা গড়ে ওঠার অপ্রতুলতার কারণে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে প্রায় ৪০ লক্ষ যুবক যুবতী পরিযায়ী হয়ে ভিন রাজ্যে কাজ করতে গেছে। পরিযায়ী বাংলাভাষী শ্রমিকদের উপর বিজেপি শাসিত রাজ্যে যে অত্যাচার তা ক্রোনোলজিরই অংশ। আজকে পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ১০ কোটি মানুষ বসবাস করেন যাদের অধিকাংশের কাছেই ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, রেশন কার্ড, পাসপোর্ট ইত্যাদি থাকলেও বড় অংশের কাছেই পূর্বপুরুষের বার্থ সার্টিফিকেট, জমি বাড়ি দলিল ইত্যাদি নথিপত্র নেই। সারা রাজ্যের জনগণকে নিজেদের ভোটার হওয়ার জন্য প্রমাণ দিতে যদি এই সমস্ত নথি জোগাড় করতে হয় তাহলে স্বাভাবিক জনজীবন ব্যাহত হবে। এই রাজ্যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও একেবারে তলানিতে, রাজনৈতিক হানাহানি রাজ্যের শাসক তৃণমূল দলের মধ্যে অন্তর্কলহে প্রায়ই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি হচ্ছে। দুর্নীতি আজ একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করেছে। এমতাবস্থায় ভোটার লিস্টের বিশেষ সংশোধনীর নামে আরো একটি রাষ্ট্রীয় অরাজকতার দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই কারণে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে যাতে এসআইআর-এর নাম করে পিছিয়ে পড়া গরিব  শ্রমজীবী মানুষজনকে হয়রানির শিকার না হতে হয়।

Comments :0

Login to leave a comment