‘‘চোরাচালান ছেলের হাতের মোয়া নাকি? স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতা ছাড়া সীমান্তে চোরাচালান অসম্ভব। বিএসএফ, রাজ্য পুলিশ, এমএলএ, এমপি সবাই মিলে মিশে বসে রয়েছে। আর দিন নেই রাত নেই বুটের লাথি খাচ্ছে সাধারণ মানুষ।’’
বিড়ির ধোঁয়া টেনে বললেন জগন্নাথ প্রামাণিক। বনগাঁ স্টেশন টোটো স্ট্যান্ডে আলাপ। স্টেশন থেকে টোটো নিয়ে পাড়ি দেন শহরের নানা প্রান্তে। কথা প্রসঙ্গে এমনটা জানালেন তিনি।
বনগাঁ বিডিও অফিসে যাওয়ার পথে উল্টোদিক থেকে আসা একটা বিএসএফ’র মারুতি জিপসি বিপজ্জনক ভাবে রাস্তার কাদা ছিটিয়ে চলে যাওয়ার কয়েক মুহূর্ত পরেই জগন্নাথ প্রামাণিক নিজে থেকেই সরব হলেন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর ‘জুলুমের’ বিষয়ে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির নিরিখে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দৈর্ঘ সবথেকে বেশি। ৪০৯৬ কিলোমিটার। এই সীমান্তের প্রায় অর্ধেক, অর্থাৎ ২২১৭ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। এবং তাঁর সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে দুটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সীমান্ত সংক্রান্ত যত রকমের সমস্যা সম্ভব, তার প্রায় প্রত্যেকটিই।
২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনের মরশুমে গণশক্তি ডিজিটালের তরফে ঢুঁ মারা হয়েছিল বনগাঁয়। বোঝার চেষ্টা হয়েছিল, সীমান্ত সমস্যার চরিত্রটা ঠিক কী এই অঞ্চলে?
জগন্নাথ প্রামাণিকের বক্তব্যের সমর্থন বনগাঁ শহর এবং সংলগ্ন গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে রয়েছে।
সাধারণ মানুষের ক্ষোভ, সীমান্তের চোরাচালানের গোটাটাই পরিচালিত হয় কেন্দ্রীয় ভাবে। এবং তাতে সক্রিয় অংশ রয়েছে বিএসএফ’রও। কেন্দ্র এবং রাজ্য, দায় রয়েছে দু’তরফেরই।
কীভাবে?
এলাকার মানুষের বক্তব্য, বিএসএফ মূলত দ্বৈতচরিত্রে অভিনয় করে নিপুণ ভাবে। একদিকে ট্যাংড়া, ছয়ঘড়িয়া, সুন্দরপুর, হাটবাওড় সহ একের পর এক গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় বিএসএফ’র কড়াকড়িতে প্রতিদিন সমস্যায় পড়েন কৃষকরা। ঘড়ির কাঁটা মেনে কাঁটাতারের দরজা খোলে বিএসএফ। কৃষকরা নিজেদের জমিতে যান। আবার বিকেল বেলা ফিরে আসতে হয় গ্রামে। জেলবন্দি কয়েদিদের মতো মাথা গুণতি করা হয় তাঁদের। সীমান্তের দরজা বন্ধ থাকার ফলে দুপুর বেলা খাবার খেতে বাড়িও ফিরতে পারেন না তাঁরা। এর সঙ্গে রয়েছে চোরাচালান রোখার নামে যখন তখন তল্লাশি।
ট্যাঙড়া পঞ্চায়েতের সীমান্ত ঘেঁষা গ্রাম হল শুঁটিয়া। শুঁটিয়া গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে কোদালিয়া নদী। নদীর ওপারেই বাংলাদেশ। কোদালিয়া নদী সংলগ্ন শুঁটিয়া রোড। সেখানের এক চায়ের দোকানে কথা হচ্ছিল মৃণ্ময় দাসের সঙ্গে। মৃণ্ময়ের কথায়, বিএসএফ সবটাই করে লোক দেখানোর জন্য। লোকে দেখে ভাবছে কত কাজ হচ্ছে। চোরাচালান আটকাতে কত কাজ করছে বিএসএফ। কিন্তু আসল কাজের সময় সব ফাঁকা।
এই ‘‘কাজের সময় সব ফাঁকা’’- আরও পরিষ্কার হল অপর এক গ্রামবাসীর কথায়। যদিও তিনি নাম প্রকাশে একেবারেই অনিচ্ছুক। শুধু জানা গেল শুঁটিয়া গ্রামেই তাঁর বাড়ি।
তাঁর কথায়, চোরাচালানের জন্য সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। সেই সময় বিএসএফ হাওয়া হয়ে যায়। তারপর আবার শুরু হয়ে যায় ওঁদের সমস্ত হাঁকডাক।
বনগাঁ ব্লকের সিপিআই(এম) নেতা নারায়ণ বিশ্বাসের কথায়, সীমান্তে চোরাচালান আটকানোর জন্য যৌথ কমিটি রয়েছে। সেখানে ডিএম, এসপি, স্থানীয় থানা, এমপি, এমএলএ সবাই রয়েছে। কিন্তু সেই কমিটি কবে বৈঠক করে কেউ জানে না।
এক কথায় কমিটি রয়েছে খাতায় কলমে।
অপরদিকে এলাকায় কান পাতলেই শোনা যায় তৃণমূল-বিজেপির বোঝাপড়া করে ‘এলাকা চালানোর’ যাবতীয় তত্ত্ব। কেননা মুখ্যমন্ত্রী বিএসএফ’র বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন জনসভায়। প্রশ্ন রয়েছে যে তাঁর প্রতিনিধি হয়ে জেলা শাসক বা পুলিশ সুপাররা বিএসএফ আধিকারিকদের ডেকে যৌথ কমিটিতে অভিযোগ জানান না কেন?
‘বোঝাপড়া’ আলোচনায় একটি চরিত্র হল হায়দার আলি মোল্লা। বৈরামপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূলী প্রধান। এলাকার মানুষের অভিযোগ, চোরাচালান এবং সরকারি প্রকল্পের টাকা চুরি করে কয়েক কোটি টাকার প্রাসাদ বানিয়েছেন হায়দার। ভোট লুঠের মূল পান্ডাও তিনি। এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনেও বৈরামপুরে সন্ত্রাস চালাচ্ছে তাঁর বাহিনী। যদিও সেই সন্ত্রাস রুখেই বৈরামপুর পঞ্চায়েতে ১৯টি প্রার্থীপদ রক্ষা করেছে সিপিআই(এম)।
এলাকাবাসীর স্পষ্ট অভিযোগ, বাংলাদেশের যশোর শহরে হায়দারের সারের দোকান রয়েছে। রয়েছে দুই দেশের পরিচয়পত্র। বাংলাদেশের নির্বাচনেও ভাড়া খাটে হায়দারের বাহিনী। কিন্তু তারপরেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
আর এহেন হায়দারের সঙ্গে বোঝাপড়া করেই জেলা পরিষদে নিজের ছেলেকে প্রার্থী করেছেন বাগদার বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস। প্রসঙ্গত, বনগাঁ মহকুমার ৪টি আসনেই ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে জয়ী হয় বিজেপি। বিশ্বজিৎ দাসও বিজেপির টিকিটে জেতেন। এখন তিনি তৃণমূলে। তাঁর চাপে এবং হায়দারের হাতযশে জেলা পরিষদে প্রার্থী হতে পারেননি দীর্ঘদিনের প্রবীণ তৃণমূল নেতা শ্যামল রায়। বাকি ৩ বিধায়ক বিজেপিতে থাকলেও তৃণমূলের সঙ্গে আঁতাত বজায় রেখেই চলেন তাঁরা, বলছেন এলাকাবাসীদের অনেকেই।
Comments :0