হাইকোর্টে নির্দেশে তড়িঘড়ি বৈঠকে বসে হনুমানজয়ন্তীর ধর্মীয় মিছিলে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার।
রাজ্য সরকারের উদ্দেশ্যে ‘প্রিভেনশান ইজ বেটার দেন কিওর’ বহু চর্চিত এই প্রবাদকে স্মরণ করিয়ে এদিন কলকাতা হাইকোর্ট রাজ্যের পুলিশ প্রশাসনকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য নিয়ে বৃহস্পতিবারের হনুমান জয়ন্তীর মিছিল আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছে।
গত মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়ে দীঘা থেকে রাজ্যের মুখ্যসচিব রামনবমীর অশান্তি নিয়ে ‘ছোটখাটো ঘটনা’ বলে জানিয়েছিলেন। বুধবার সন্ধ্যায় নবান্ন থেকে রাজ্যের মুখ্যসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী সব জেলা শাসক, পুলিশ সুপার ও পুলিশ কমিশনারদের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে ভার্চুয়াল বৈঠক করেন।
সূত্রের খবর, ওই বৈঠকেই রাজ্য সরকার বৃহস্পতিবারের ধর্মীয় শোভাযাত্রায় ৩ কোম্পানি আধা সামারিক বাহিনী সাহায্য নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঠিক হয়েছে, বারাকপুর ও হুগলী ও কলকাতার কিছু এলাকায় বাহিনীকে মোতায়েন করা হবে। প্রসঙ্গত, এদিনই কলকাতা হাইকোর্টের ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি টি এস শিবাজ্ঞানম ও বিচারপতি হিরন্ময় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে ডিভিসন বেঞ্চ রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দিয়েছে, আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েন করার। কেন্দ্রীয় সরকারকেও বাহিনী মোতায়েনের জন্য তৎপর হতে বলেছে হাইকোর্ট।
আদালতে সরকার জানিয়েছে হনুমান জয়ন্তীর মিছিলের জন্য ১৬০টির মতো আবেদন সরকারের জমা পড়েছে। এরাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে কার্যত চ্যালেঞ্জের মুখে এনে দাঁড় করিয়ে মিছিল আয়োজনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য নিতে হবে। নবান্নের শীর্ষ মহল থেকে জানা গেছে, রামনবমীর মিছিল আয়োজন পর্বে রাজ্য প্রশাসন কঠোর ব্যবস্থা নিলে এই পরিস্থিতির মুখে সরকারকে পড়তে হতো না। সরকারের পরিকল্পিত এই উদাসীনতার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে মাঠে নেমে পড়েছে হিন্দুত্ববাদী বিভাজনের শক্তিগুলি।
কোর্টের নির্দেশের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার এই সিদ্ধান্ত রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের ভূমিকাকেই কার্যত প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় হওয়ার পরও কোর্ট যেভাবে এদিন নির্দেশ দিয়েছে তা এরাজ্যে মিছিল, ধর্মীয় শোভাযাত্রার মতো কর্মসূচিতেও আদালতকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে শুধু তাই নয়, মিছিল সুষ্ঠুভাবে পালনের জন্য রাজ্য পুলিশের ওপর ভরসা না করে সরকারকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য নিতে হচ্ছে।
রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে, রামনবমীর মিছিলের পর থেকে যেভাবে রাজ্যে অশান্তির ঘটনা ঘটেছে তা উদ্বেগের। আর এই উদ্বেগ আরও বেড়েছে পুলিশের নিয়ন্ত্রণে থাকা এলাকাতেও একের পর এক ঘটনা ঘটে যাওয়া। এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর সাহায্য নেওয়ার জন্য আদালতে কোনও নির্দেশের অপেক্ষা সরকারকে করার প্রয়োজনই ছিল না। প্রয়োজন মনে করলে জেলা শাসক থেকে পুলিশ কমিশনাররাই কেন্দ্রীয় বাহিনী চাইতে পারতেন।
রাজ্য প্রশাসনে কর্মরত এক শীর্ষ আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘আইনশৃঙ্খলার প্রশ্নে রামনবমীর থেকেও ধারে ভারে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল ১৯৮৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু পরবর্তী ঘটনা ও ১৯৯২সালে বাবরি ধ্বংসের ঘটনা। তখন রাজ্য সরকারকে সামরিক বাহিনী নামাতে কোর্টের নির্দেশের অপেক্ষায় তাকিয়ে থাকতে হয়নি। সঠিক সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে এরাজ্যকে রক্ষা করেছিলেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু।’’
বৃহস্পতিবারের হনুমান জয়ন্তীর মিছিল নিয়ে নবান্ন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যে সব এলাকায় একাধিক মিছিল হবে তাদের একটি মাত্র রুট ব্যবহার করানো হবে। মিছিলের গোটা যাত্রাপথের পূর্ণাঙ্গ ভিডিও করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানোর কথাও এদিন বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এদিন আদালত অবশ্য জানিয়ে দিয়েছে রামনবমীর মিছিল থেকে যেসব এলাকায় গোলমাল হয়েছে সেখানে কোনোভাবেই হনুমান জয়ন্তীর মিছিল আয়োজন করা যাবে না।
এরাজ্যে ঐতিহ্য মেনে রাজ্যবাসী দুর্গাপুজো, কালীপুজো, সরস্বতী পুজোর বিসর্জনের শোভাযাত্রায় অভ্যস্ত। এলাকা ভিত্তিতে জগদ্ধাত্রী পুজোর বিসর্জনেও নজরকাড়া শোভাযাত্রায় মানুষ অংশগ্রহণ করেন। ক্ষমতায় এসে ধর্মীয় এই অনুষ্ঠানকে সরকারি ক্যার্নিভ্যালের মোড়কে সামনে আনেন মমতা ব্যানার্জির সরকার।
২০১৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর এরাজ্যেও বিচ্ছিন্নভাবে চালু করে রামনবমীর অস্ত্র মিছিল। তখন পালটা হিসাবে প্রথম হনুমান জয়ন্তী শুরু করেন বীরভূমের তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল। এখন রামনবমীর মিছিলে একসাথে তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপি নেতারা পথ হাঁটে। প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গেছে, হনুমান জয়ন্তী মিছিলের যত আবেদন জমা পড়েছে তাতে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতারা জড়িত আছে। যদিও কলকাতা হাইকোর্ট এদিন স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে, ধর্মীয় ইস্যুতে কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তির হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করা হবে না।
Comments :0