Drop out students West Bengal

ফরম ফিল আপ করেও মাধ্যমিকে বসেনি ২ লক্ষের বেশি ছাত্র-ছাত্রী

রাজ্য

Drop out students West Bengal


কন্যাশ্রীর ধাঁধানো প্রচারে এতদিন ঢেকে থাকা রাজ্যের সরকারি বিদ্যালয়ে স্কুলছুটের ভয়াবহ তথ্য সামনে এনে দিয়েছে এবারের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের সংখ্যা। এক শিক্ষাবর্ষে শুধু মাধ্যমিকেই কমে গেছে ৪০ শতাংশ পরীক্ষার্থী! স্কুলছুটের ভয়াবহ ছবি সামনে আসার পর এখন ড্রপ আউট কমাতে নীতি ঘোষণা করেছে শিক্ষা দপ্তর। 
গত বছর এরাজ্যে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর থেকে ৪লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী এবার কমেছে। তার থেকেও ভয়াবহ ঘটনা চলতি বছরে মাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য ৮লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী রেজিস্ট্রেশন ফরম ফিলাপ করে। নবম শ্রেণিতে মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার জন্য ফরম ফিল আপ করার পরেও ২লক্ষ নথিভুক্ত পরীক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত এড়িয়ে গেছে মাধ্যমিক। রাজ্যের বিদ্যালয় শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিকের বক্তব্য,‘‘ স্কুলছুটের কী পরিণতি তার প্রতিফলন এসেছে মাধ্যমিক পরীক্ষায়। এর থেকেও করুণ চিত্র আরও নিচে। প্রাথমিক স্তরে ও মাধ্যমিক স্তরে ড্রপ আউট এক ভয়াবহ আকার নিয়েছে।’’


মাধ্যমিক নিয়ে হইচই হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তর। শিক্ষা দপ্তরের প্রধান সচিব মনীশ জৈন জারি করেছেন এক বিজ্ঞপ্তি। সেই বিজ্ঞপ্তিতে রাজ্যের সরকার পোষিত বিদ্যালয়ে কর্মরত শিক্ষকদের পুনর্বিন্যস্ত করার নয়া নীতি ঘোষণা করা হয়েছে। নয়া নীতি ঘোষণার মধ্য দিয়ে আসলে রাজ্যের শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক উপস্থিতির রক্তশূন্য চেহারাই সামনে এসেছে। 
পরিস্থিতি এতটাই আতঙ্কজনক জায়গায় পৌঁছেছে তাতে ‘রাইট টু এডুকেশন’ আইনে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাতের হার এরাজ্যে বিপর্যয়ের মুখে। আইন অনুসারে ৩০জন ছাত্র পিছু ১ জন শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু এরাজ্যে সেই অনুপাত কোথাও ৮০, এমনকি ১০০জন ছাত্রপিছু ১জন শিক্ষকে এসে দাঁড়িয়েছে। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা কমে যাওয়াতে এই ছাত্র শিক্ষক অনপাতের হারে আরও প্রতিকূল প্রভাব পড়তে চলেছে বলে শিক্ষা দপ্তর সূত্রে জানা গেছে।

রাজ্যের স্কুল শিক্ষাকে এহেন রক্তশূন্য চেহারায় উপস্থিত করার মূলে আছে সরকারের ‘উৎসশ্রী’ পোর্টালের মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের বদলির নির্দেশ। যার অবধারিত প্রভাবে গ্রামের বিদ্যালয় ফাঁকা করে শিক্ষকরা চলে আসেন শহরে। আসলে নিয়োগ দুর্নীতিকে বৈধতা দিতেই লকডাউনের মধ্যে খোলা হয়েছিল এই ট্রান্সফার উইন্ডো। ফলে রাজ্যের গ্রামের বিদ্যালয় এখন শিক্ষক শূন্য। পড়াশোনা প্রায় নেই। এরসঙ্গে গত এক দশকে মমতা ব্যানার্জি রাজত্বে এসএসসি’র মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগের পথ দুর্নীতিতে পরিপূর্ণ। কোর্টের নির্দেশে ফি দিন চাকরি যাচ্ছে ভুয়ো শিক্ষকদের। এরসঙ্গে পরিকল্পিতভাবে রাজ্যে সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাকে গুটিয়ে আনার কাজ সম্পূর্ণ করতে ঢালাই বেসরকারি বিদ্যালয়কে অনুমোদন দিয়ে গেছে রাজ্য সরকার। শিক্ষা দপ্তরের কাছ থেকে নোঅবজেকশান সার্টিফিকেট জোগাড় করে প্রত্যন্ত গ্রামে গজিয়ে উঠেছে বেসরকারি বিদ্যালয়। এই তিন ঘটনার প্রভাবে রক্তশূন্য চেহারা নিয়েছে রাজ্যের সরকারি স্কুল শিক্ষা। সরকারের এই পরিকল্পিত উদ্যোগের সঙ্গে টানা দু বছরের অতিমারীর ধাক্কায় স্কুলছুটের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।

স্কুলছুট ঠেকাতে নতুন নীতিতে কী বলা হয়েছে? 
ড্রপ আউটের ভয়াবহ পরিণতি প্রকাশ্যে আসার মুখ পুড়িয়ে এখন নয়া নীতিতে বলা হয়েছে, যে সব সরকারি বিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক বেশি আছে সেখান থেকে শিক্ষক পাঠানো হবে শিক্ষকহীন বিদ্যালয়ে। নিয়োগের মধ্য দিয়ে যাঁরা চাকরি পাবেন তাঁদের শিক্ষকহীন স্কুলে পাঠানোয় অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকদের বদলি করার ক্ষেত্রে জেলার মধ্যেই রাখার কথা বিবেচনায় রাখা হয়েছে। নয়া নীতিতে বলা হয়েছে,  জেলা ভিত্তিতে কোন স্কুলে শিক্ষক কম, কোথায় বেশি তার তালিকা তৈরি করবে শিক্ষা দপ্তরের প্রতিটি জেলা পরিদর্শক (ডিআই)। সেই তালিকা নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করবে ডাইরেক্টর অব স্কুল এডুকেশন। তার ভিত্তিতে পরিকল্পনা তৈরি করে শিক্ষা দপ্তরে পাঠাবে ডায়রেক্টর অব স্কুল এডুকেশন। এখন থেকে ফি বছর জেলাভিত্তিতে এই তালিকা ডিআই-দের পাঠাতে হবে শিক্ষা দপ্তরে। যে সব বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ঘাটতি আছে সেখান থেকে কোনও শিক্ষককেই আগামীদিনে বদলির অনুমতি এখন থেকে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।

স্কুলছুট ঠেকাতে সরকারের এই নীতি রূপায়ণ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরাই। দপ্তরের এক শীর্ষ আধিকারিকদের বক্তব্য,‘‘ সরকার শিক্ষকদের যে পুনর্বিন্যস্ত করার কথা বলেছেন তা বাস্তবে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার কারণ, এরাজ্যের শিক্ষক নিয়োগের পথই বন্ধ হয়ে আছে। এখনই ১০ থেকে ১২ হাজার শিক্ষক নিয়োগ করতে না পারলে রাজ্যের সরকারি শিক্ষাকে বাঁচানো মুশকিল।’’ নতুন শিক্ষক নিয়োগের দাবি করে আধিকারিকরা অবশ্য মনে করিয়ে দিচ্ছেন ‘জেনুইন শিক্ষক’ নিয়োগের কথা।  


রাজ্যের স্কুল শিক্ষা দপ্তরের এক আধিকারিক জানিয়েছেন,‘‘ মাধ্যমিক পরীক্ষায় বসার জন্য নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় রেজিস্ট্রেশন ফরম ফিলাপ করতে হয় পড়ুয়াদের। ৮লক্ষ পড়ুয়া সেই ফরম ফিলাপ করেও ২লক্ষ ছাত্র-ছাত্রী পরীক্ষায় বসতে চায়নি। তার অন্যতম কারণই হলো, স্কুলে কোনও শিক্ষকই নেই। পঠনপাঠন হয়নি। রেজিস্ট্রেশন ফরম ফিলাপ করেও তাই পরীক্ষায় বসা এড়িয়ে গেছে ২ লক্ষ ছেলেমেয়ে।’’


শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরা বলছেন, রাজ্যের মাধ্যমিক পরীক্ষার ইতিহাসে এই হারে বিপর্যয় এর আগে কখনও হয়নি। অথচ এরাজ্যে শিক্ষা দপ্তরের প্রধান সচিব পদে চার বছরের বেশি সময় ধরে আছেন মনীশ জৈন। নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে ইতিমধ্যে তিনি সিবিআই জেরার মুখে পড়েছেন। বিকাশ ভবনে গিয়ে বেশ কয়েকবার সিবিআই তাঁকে জেরা করেছে। কিন্তু দপ্তরের প্রধান সচিব পদে তিনি বহাল থেকে গেছেন।

Comments :0

Login to leave a comment