Post Editorial

জাগবার দিন আজ

উত্তর সম্পাদকীয়​

কনীনিকা ঘোষ

প্রত্যেকদিন আক্রান্ত হচ্ছে মেয়েরা ,নির্যাতন করা হচ্ছে তাদের, ধর্ষিতা হচ্ছে তারা। শুধু ধর্ষিতাই হচ্ছেন না, এমনকি খুন করে দেওয়া হচ্ছে। একের পর এক - কখনো কামদুনি তো কখনো কাকদ্বীপ, কখনো পার্কস্ট্রিট তো কখনো পশ্চিম মেদিনীপুর; ৮ থেকে ৮০, শিশু থেকে সন্ন্যাসিনী বাদ নেই কেউ - এই নাকি বাংলার নিজের  মেয়ের রাজ্য! আর যে খবর আমরা পাই তাতো হিমশৈলের চূড়া মাত্র। তার বাইরে প্রতিদিন যে অসংখ্য ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তার খবর কে রাখে! 
কেন হবে না বলুন তো! দুষ্কৃতী সমাজে থাকেই, কিন্তু প্রশাসন তার প্রতি কি দৃষ্টিভঙ্গি নিচ্ছে তার ওপরে নির্ভর করে অনেক কিছু। আমাদের রাজ্য আজকে দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে, কারণ মাননীয়া ধর্ষণকে বলছেন সাজানো ঘটনা, তারপর বললে শরীর থাকলেই যেমন সর্দি কাশি হয় ধর্ষণও তেমনি। এখানেই থামেননি তিনি - ভিক্টিম শেমিং করে হাঁসখালীর ঘটনায় বললেন, ও কি প্রেগন্যান্ট ছিল? ওর কি লাভ অ্যাফেয়ার ছিল? তিনি ঠিক করতে চাইলেন মহিলার ইজ্জতের দাম। হায়রে সমাজ!  স্বাভাবিকভাবেই উল্লসিত হলো দুষ্কৃতীরা। আজ বেপরোয়া তারা। তাই ধর্ষণের খবর রাজ্যে প্রতিদিন সংবাদে। অথচ দুষ্কৃতীদের শাস্তির দিকে দেখলে গালে হাত দিয়ে সবাইকে আমাদের ভাবতেই হবে - এ কোন পশ্চিমবঙ্গ! 
এই পশ্চিমবঙ্গেই বামফ্রন্ট সারা দেশে প্রথম পঞ্চায়েতে মেয়েদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণ করেছিল, আর আজ সেখানে বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদছে। অপরাধী ধরা পড়েছে কিন্তু শেষমেষ দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মাত্র ৩.৭শতাংশ। হ্যাঁ, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-এর (এনসিআরবি) রিপোর্ট তাই বলছে। আপনার জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করছে না, পুলিশ তুমি কার - আক্রান্তের নাকি আক্রমণকারীর? তাই বিজ্ঞাপনে চকচক করলেও আসলে  মেয়েদের নিরাপত্তার এই হাল। শিশুদের বিরুদ্ধে অপরাধের সাজার হারও পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ৮.১শতাংশ, তারপরেও কোন মুখে মুখ্যমন্ত্রী মানুষের সামনে বড় বড় ভাষণ দেন? মেয়েদেরও সবার সাথে সমান মর্যাদা নিয়েই বাঁচাতে ইচ্ছে করে।
প্রতি ঘণ্টায় ৫ জন মহিলা হারিয়ে যাচ্ছেন এ রাজ্যে। এক বছরে নিখোঁজ ৪৩ হাজার, আর তার মধ্যে পাচারের শিকার নাকি মাত্র ৬১ জন! বিশ্বাসযোগ্য? রাজ্য পুলিশের এমনই দাবি। আর এটাও খুবই স্বাভাবিক যে অমিত শাহ নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক তা মেনে নিয়েছে। অথচ আমরা কে না জানি, হারিয়ে যাওয়া মহিলাদের একটা বড় অংশ পাচারকারীদের কবলেই পড়ে। 'আড়কাঠি' মানে এজেন্টদের গতিবিধি নানান জায়গায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কাজ দেওয়ার নাম করে মহিলাদের ফাঁদে ফেলা হচ্ছে। কাজ নেই, কৃষির অবস্থা সঙ্গীন - তাই তো কাজ পাওয়ার জন্য মরিয়া মহিলারা হারিয়ে যাচ্ছেন। 
পুলিশের এত গভীরে গিয়ে অনুসন্ধানের সময় কোথায়? শাসকদলের নেতাদের পাহারা দিতে হবে না! তাদের দলের দলদাস হয় না থাকলে 'টু পাইস' কামানোর যে অফুরান সুযোগ, তা তো বন্ধ হবে যাবে! তাই ওনাদের 'His Mistres's voice'  -  যা বলবেন তাই বলতে  হবে, ভুল করলেও যা করবেন তাই করতে হবে। সেই জন্যই বহু মহিলা পাচারকারীদের কলকাঠিতে রাজস্থান, দিল্লি বা নেপালে চলে যাচ্ছেন। তাদের হারিয়ে যাওয়া আর পুলিশের খাতায় পাচার হিসাবে উঠছে না। পুলিশ যে ৬১ জনকে পাচারের শিকার বলেছে, তার মধ্যে নাবালিকাই ৪৪ জন।  আবার নাবালিকা বেশি বললে তো কাজের জন্য পাচার হচ্ছে এটা বলা যাবে না, তাই তারা ব্যস্ত সব ধামাচাপা দিতে। যদিও বাস্তবে নিখোঁজের তালিকায় দেখা যাচ্ছে, সাবালিকা, গৃহবধূই বেশি। পুলিশের এই ভূমিকায় অবাক হচ্ছেন? অবাক হবেন না, কারণ পুলিশের দাবি অনুযায়ী এক বছরে ৫৬ টি মানুষ পাচারের অভিযোগ দায়ের হয়েছে এবং গ্রেপ্তার হয়েছে ১৯৬ জন মাত্র। আর হ্যাঁ, এদের মধ্যে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মাত্র ১৪ জন।    
আগেই উল্লিখিত হয়েছে, মেয়েদের বিরুদ্ধে অপরাধে শাস্তি হয় মাত্র ৩.৭ শতাংশ অপরাধীর। এনসিআরবি রিপোর্ট এটাই জানাচ্ছে। হায়রে মাতঙ্গিনী, হায়রে ইলা মিত্র! এটাই তোমাদের বাংলা! না। এ চলতে পারে না, বাঁচাতেই হবে মেয়েদের ।
রাজ্যে দারুণ বিজ্ঞাপন, কন্যাশ্রী রূপশ্রী আরও কত শ্রী। কিন্তু কেন বলুন তো প্রায় আট হাজার স্কুল বন্ধ হয়ে যায়? কেন বামফ্রন্টের সময় নারী শিক্ষায় প্রথম রাজ্যে আজ ছাত্রী ড্রপ আউট বেড়েই চলেছে? মাধ্যমিকে ছাত্রীর সংখ্যা কমছে? বাংলার নিজের মেয়ের রাজ্যে বিয়ের প্রকল্পের নাম রূপশ্রী প্রকল্প। তখন একবারও মনে হয় না যে এটাও মনের আড়ালে থাকা পিতৃতান্ত্রিকতাই। তাই তো মেয়ের বিয়ের প্রকল্পে রূপকে যুক্ত থাকতেই হবে। সে আর অন্য কি কি জানে সেগুলো গৌণ, রূপটাই একমাত্র বিবেচ্য? এরপরেও বলবেন পিতৃতান্ত্রিকতা শুধু পুরুষের ব্যাপার! বারে বারে মাননীয়া দেখিয়েছেন তার প্রকৃত মনোভাব কি। তাই তো তিলোত্তমার ধর্ষণ খুনের ঘটনার পর ‘রাত্রি সাথী’ প্রকল্পের ঘোষণা হয়। আবার দুর্গাপুরে আইকিউ সিটিতে ধর্ষণের পর তার নির্ভেজাল পরামর্শ - কেন মেয়েরা রাত্তিরে বেরোবে? এরপরেও একে পিতৃতান্ত্রিকতা না বললে কাকে বলবেন! রাত্রিবেলায় ডিউটি সেরে যে নার্স সকালে বাড়ি ফেরেন, তিনি কি রাতে বেরোবেন না? আইটির যে কর্মী বিদেশি কোম্পানির সাথে কাজ করেন বলে তাকে গভীর রাত অবধি কাজ করতে হয়, তবেই তিনি পারিশ্রমিক পান। আর সেই রোজগারেই তার ভাইকে পড়ায়, মা-বাবাকে দেখে, তার ছাতার তলায় বাঁচে সংসার। রাতে না বেরোলে তার কাজের ব্যবস্থা কে করবে? মাননীয়া কি বলছেন?  আপনি আর কি বলবেন! 
পশ্চিমবঙ্গে কাজের অবস্থা কে না জানে! FLEP (Female labour count participation) রিপোর্ট অনুযায়ী রাজ্যে শ্রমশক্তিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ মাত্র ২৯.৪ শতাংশ, যার মধ্যে অধিকাংশ  অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন ও পুরুষের তুলনায় ২০ শতাংশ কম মজুরি পান। একটি সমীক্ষার মতে আমাদের দেশে প্রায় ২০ শতাংশ মহিলা মজুরিবিহীন কাজে যুক্ত। স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (এসবিআই)-র সমীক্ষা বলছে, এই মজুরিবিহীন শ্রমের পরিমাণকে টাকায় মাপলে তা জিডিপি’র ৫ শতাংশ, যা টাকার অংকে প্রায় ২২.৭ লক্ষ কোটি। 
আমাদের রাজ্যে চলছে দুর্নীতি আর লুটের রাজত্ব। এ রাজ্যে তো কোনও কাজ নেই আর তার মধ্যে মহিলাদের অবস্থা আরও খারাপ। তাই আজ তাদেরও পরিযায়ী হয়ে যেতে হচ্ছে। অনেকে হয়তো বলবেন, কেন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার তো দেওয়া হচ্ছে। সে তো সরকারকে দিতে হবেই। সে তো মুখ্যমন্ত্রীর পৈত্রিক টাকা নয়, আমাদের সবার ট্যাক্সের টাকা। কর্মরত মহিলাদের তো এ টাকা পাওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে যারা মজুরিবিহীন কাজ করেন, তাদের মজুরির জন্য কি এই টাকা? টাকার পরিমাণ কি তা  ভাবতে দেয়? নাকি এ নেহাত ভোট পাবারই জন্য?  আকাশছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে এখনই বাড়ানো দরকার এই টাকার পরিমাণ। 
আশ্চর্যের কথা, শুধু অসংগঠিত ক্ষেত্রেই নয়, সংগঠিত ক্ষেত্রে যেমন চটকলের ৯০শতাংশ মহিলাই স্থায়ী কর্মীদের জন্য নির্দিষ্ট কাজ করেন, কিন্তু ভাউচারে টাকা পান এবং সেটা স্থায়ী শ্রমিকের চেয়ে অনেক কম। পিএফ, ইএসআই নেই। তাই দুর্ঘটনা ঘটলে চিকিৎসা বা ক্ষতিপূরণ পান না। পেনশন প্রভৃতি সামাজিক সুরক্ষাও নেই। বামপন্থীরা ছাড়া কেউ এই নিয়ে কথা বলে না কেন?
মেয়েদের সফট টার্গেট করে বিজেপি তাদের ধর্ম, জাতপাতের রাজনীতিতে গুলিয়ে দিতে চাইছে ভাতের লড়াই। অন্যদিকে, মুসলিমদের মসিহা বলে দাবি করা মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি’র সাথে ছদ্ম প্রতিযোগিতায় জনগণের করের সরকারি টাকায় দীঘায় মন্দির বানিয়েছেন। শিক্ষা স্বাস্থ্য রুটি-রুজি সহ মানুষের জীবনের প্রকৃত সমস্যাগুলিকে ভুলিয়ে দেওয়ার। যারা বয়োজেষ্ঠা তাদের নিশ্চয়ই মনে পড়েছে, বামফ্রন্ট সরকারে এসে প্রসবকে প্রাতিষ্ঠানিক করাতেই প্রসূতি মৃত্যুর হার কমে গিয়েছিল। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে বিকেন্দ্রীকৃত করে পঞ্চায়েত পৌরসভার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের মধ্যে দিয়ে চিকিৎসা করা হতো, বিনা পয়সায় ওষুধ দেওয়া হতো। আর আজ স্বাস্থ্য মানে  -শিশু মৃত্যু, জাল স্যালাইন, ব্যবহার করা গ্লাভসের ব্যবসা আর প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির বিরোধিতা করেই তিলোত্তমাদের মৃত্যু। 
ভাববেন না আপনি? শুধুই ভাববেন, নাকি কিছু করতে চাইছেন? শুনতে পাচ্ছেন ২৯ তারিখ তুফানগঞ্জে তুফান তুলে শুরু হওয়া  'বাংলা বাঁচাও যাত্রার রণদুন্দুভি। দেখতে পাচ্ছেন লাল ঝান্ডার ঝলকানি। এমএফআই-র ঋণে জর্জরিত মেয়েদের হয়রানি নিয়ে আপনি কী কিছু ভাবছিলেন? সেই হয়রানি বন্ধের স্লোগান তুলে ওরা এগিয়ে আসছে। যে মেয়েরা আক্রান্ত, তাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিতে ওদের যাত্রা পথে আলোর মশাল জ্বলছে। কোনও প্রকল্পের সাথে কেন বিরোধ থাকবে কর্মসংস্থানের? তাই কর্মসংস্থানের দাবি তুলে ওরা পথ হাঁটছে। হ্যাঁ, ওদের মুখেই তো 'পুশ ব্যাক' করে দেওয়া অন্তঃসত্ত্বা সোনালি বিবিদের যন্ত্রণার কথা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। ওরাই বলেছে, রাত হোক বা দিন - মেয়েরা, প্রান্তিক লিঙ্গের মানুষদেরও পুরুষদের মতোই সব সময় বেরোবার অধিকার আছে। তুমি ওদের আটকানোর কে হে! আপনি কি বলছেন, মহিলা হয়ে আপনি ভাবছেন ছুটে গিয়ে ওদের মিছিলে যোগ দেবেন কিনা? হ্যাঁ দিন, দেবেনই তো। ওরা যে প্রতিজ্ঞা করেছে এই জীবন্মৃত রাজ্যে রোদ্দুর আনবার, ওরা যে শপথ নিয়েছে এ বাংলাকে বাঁচানোর। তাই 'বাংলা বাঁচাও যাত্রায় মিলেছে ওরা, ওরা এগোচ্ছে আরও এগোচ্ছে প্রতিদিন - পথ কেটে সামনে এগোচ্ছে। চলুন আমরাও ওদের সাথে এগোই, আজ যে জাগবার দিন। আসুন সকলে মিলে রক্ষা করি বাংলাকে, বাঁচাই এ বাংলাকে। শামিল হই 'বাংলা বাঁচাও যাত্রা'য়।

Comments :0

Login to leave a comment