Post Editorial

৯০ ঘণ্টা কাজ একটি মৃত্যু ও হাজার প্রশ্ন

উত্তর সম্পাদকীয়​

চন্দন মুখোপাধ্যায়

২৬ বছর বয়সি আন্না সেবাস্টিয়ান পেরাইল, কেরালার কোচি শহরের মধ্যবিত্ত পরিবারের একমাত্র সন্তান। রান্নায়, বিতর্কে, শিল্প নৈপুণ্যে, খেলাধুলায় ঝকঝকে মেয়ে। নভেম্বর'২৩ সিএ পরীক্ষায় একসাথে ১ম আর ২য় পার্ট পাশ করে, ১৯ মার্চ, ২০২৪ আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং (EY) ইন্ডিয়ার মতো একটি শীর্ষস্থানীয় অ্যাকাউন্টিং ফার্মের এর চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসাবে চাকরিতে যোগ দেবার মাত্র চার মাস পরে, ২০ জুলাই, ২০২৪ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। এটা একটা অতি সাধারণ ঘটনা বলে খবরে স্থান পায়নি, পাবার কথাও নয়। কিন্তু এর কিছুদিন পর আর্নস্ট অ্যান্ড ইয়ং (EY India)-এর চেয়ারম্যান রাজীব মেমানিকে লেখা আন্নার শোকার্ত মা অনিতা অগাস্টিনের একটি চিঠিতে তার মৃত্যুর কারণ হিসাবে নিরলস কাজের চাপের অভিযোগ সমাজমাধ্যমে তোলপাড় ফেলে দেয়। 
তাঁর দীর্ঘ চিঠি শুরু করেন, "আমি এই চিঠিটি লিখছি একজন শোকার্ত মা হিসাবে, যে তার মূল্যবান সন্তানকে হারিয়েছে। আমার হৃদয় ভারাক্রান্ত, এই শব্দগুলি লিখতে গিয়ে আমার আত্মা ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে।  কিন্তু আমি বিশ্বাস করি আমাদের কথাগুলো শেয়ার করা প্রয়োজন এই আশায় যেন অন্য কোনও পরিবারকে আমরা যে যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি তা সহ্য করতে না হয়।" আর চিঠি শেষ করেন, " আমি জানি না যে, সত্যিকার অর্থে একজন মায়ের আবেগ কেউ বুঝতে পারে কিনা, যখন সে তার সন্তানকে ঘুম পাড়াতে নিজে না ঘুমিয়ে তার শিশুটি সন্তানকে  কোলে আঁকড়ে রাখে,  প্রতিদিন বড় হতে দেখছে, খেলছে, কাঁদছে এবং স্বপ্নগুলো ভাগ করেছে প্রতিদিন। …যদি না তারা একই ব্যথা অনুভব করে, তাহলে  কিসের মানবিক সংস্থা!" 
শুরু হলো বিশ্বজোড়া বিতর্ক। কোম্পানি এসব অস্বীকার করলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিতর্কের ঝড় শুরু হয়, কাজের সাথে শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে।
এই আলোচনা আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠে গত বছর যখন ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তি ভারতের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে যুবকদের প্রতি সপ্তাহে ৭০ ঘণ্টা কাজ করার পরামর্শ দিলেন। এলএন্ডটি-এর চেয়ারম্যান এসএন সুব্রহ্মণ্যন আরো একধাপ এগিয়ে ' ৯০-ঘণ্টা কাজের সপ্তাহের' প্রস্তাব দেন। একটি ভাইরাল ভিডিওতে  তাঁকে বলতে শোনা যায়, “ঘরে বসে কি করছেন? আপনি আপনার স্ত্রীর দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেন? আসুন, অফিসে যান এবং কাজ শুরু করুন”। এমনকি রবিবারেও কাজ করার জন্য কর্মচারীদের আহ্বান জানান তিনি। এদের এই বক্তব্য অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি থেকে শিল্প প্রতিনিধিদের অনেকের সমালোচনার মুখে পড়ে। এই পরিস্থিতির জন্যে ঐ শিল্পপতিদের থেকে সরকার, সকলেই একটাই যুক্তি হাজির করছে, দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্যে এবং বিদেশি কোম্পানিদের আকর্ষণের জন্য নাকি এই কাজের সময়বৃদ্ধি এবং বেশি বেশি সুযোগ দেওয়া দরকার। কিন্তু এর সত্যতা কতটুকু? অর্থনীতিবিদরা বলছেন যে, একটি দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির সম্ভাবনা উৎপাদনশীলতার সাথে জড়িত, আর উৎপাদনশীলতার সাথে কাজের সময়ের চেয়ে বেশি সম্পর্ক রয়েছে কাজের মানের। অর্থনীতিবিদ শ্যাম সুন্দর বলেছেন, “ভারতের কর্মসংস্কৃতি ১০৯০-এর দশকের পরে উদার অর্থনীতির হাত ধরে পরিবর্তিত হয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের উত্থানের সাথে। যার ফলে বর্তমানে  কোম্পানিগুলি ২৪ ঘণ্টা ব্যাপী চাহিদা মেটাতে শ্রম আইনকে অগ্রাহ্য করে, এটাকেই আইন বানিয়ে ফেলেছে। এমনকি ম্যানেজমেন্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতেও, ছাত্রদের স্পষ্টভাবে বলা হয়, উচ্চ বেতন অর্জনের জন্য দীর্ঘ সময় কাজ করা স্বাভাবিক এবং এমনকি এটাই কাম্য।”
ইন্ডিয়ান স্কুল অফ বিজনেসের অধ্যাপক চন্দ্রশেখর শ্রীপদের মতে, “বিষাক্ত কাজের সংস্কৃতি এটি। শিল্পের মালিক, পরিচালক থেকে কর্মচারী এবং এমনকি সমাজ পর্যন্ত প্রত্যেককেই উৎপাদনশীলতা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে যাতে পরিস্থিতির প্রকৃত পরিবর্তন ঘটতে পারে। আমরা এখনও কঠোর পরিশ্রমকে উৎপাদনশীল কাজের সাথে গুলিয়ে ফেলছি, প্রযুক্তির উপযোগ হল মানুষের কাজ কমানো, তাহলে কাজের সময় কেন দীর্ঘ হচ্ছে? আমাদের শুধুমাত্র পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, শ্রম অধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে স্থায়ী অর্থনৈতিক বৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দেওয়া শুরু করতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের (পিএমইএসি) প্রাক্তন সদস্য রথীন রায়ের মতে, জিডিপি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কাজের ঘণ্টা নয় বরং উৎপাদনশীল ঘণ্টার সাথে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আছে। এই প্রসঙ্গে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফাইন্যান্স অ্যান্ড পলিসি’র (এনআইপিএফপি) অধ্যাপক এস চক্রবর্তীর বক্তব্য, “ আমাদের অবশ্যই উচ্চ উৎপাদনশীলতা এবং বেশি কাজের সময়ের মধ্যে পার্থক্য করতে হবে।  বিশ্বের অনেক দেশ উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য যখন চার দিন কাজের সপ্তাহ গ্রহণ করছে, তখন ৯০ ঘণ্টা কাজ করার পরামর্শ উদ্বেগজনক, কারণ এটা কর্মীদের বিরক্তির কারণ হতে পারে। আপনি ২৫৫০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দের কাছাকাছি পিরামিড তৈরি করার সময় শ্রমিকদের আরও বেশি সময় দেওয়ার জন্য অনুরোধ করতে পারেন, কিন্তু আমি ভয় পাচ্ছি যে আমরা ২১ শতকে আছি। এর মানে হল একটি নির্দিষ্ট সময়ের (আট ঘণ্টা) বেশি কাজ করা আসলে শ্রম উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিতে পারে।”
অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ওইসিডি) এর গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, প্রতি সপ্তাহে কাজের ঘণ্টা ৫০-এর বেশি বাড়লে প্রতি ঘণ্টায় উৎপাদনশীলতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি সপ্তাহে ৫০ ঘণ্টা কাজের পর উৎপাদনশীলতা দ্রুত হ্রাস পায় এবং ৫৫ ঘণ্টার পরে উৎপাদন হয়ে পড়ে নগণ্য।  সম্প্রতি আইসল্যান্ডে কাজের সময় কমানোর উপর একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, অল্প কাজের সপ্তাহগুলি কর্মীদের সুখ এবং কর্ম-জীবনের ভারসাম্য বৃদ্ধির সাথে সাথে উৎপাদনশীলতা বজায় থাকে, এমনকি উন্নত করে। 
অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত রাষ্ট্রগুলোর কাজের সময় কেমন? নেদারল্যান্ডে, কর্মীরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ২৭.৫ ঘণ্টা কাজ করে, জার্মানিতে ২৭.৭৫ ঘণ্টা, নরওয়েতে ২৮ ঘণ্টা, ডেনমার্ক ২৮.২ ঘণ্টা, ফ্রান্সে ৩৫.৯ ঘণ্টা, স্লোভেনিয়ায় ৩১ ঘণ্টা, বেলজিয়ামে ৩১.৫ ঘণ্টা, সুইজারল্যান্ডে ৩১.৭৫ ঘণ্টা, সুইডেনে ৩২.১ ঘণ্টা, অস্ট্রিয়ায় ৩২.২ ঘণ্টা। এছাড়াও কানাডাতে ৩২.১০ ঘণ্টা, ইউকে ৩৫.৬ ঘণ্টা, ইতালি ২৬.৩০ ঘণ্টা, জাপান ৩৬.৬ ঘণ্টা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩৮ ঘণ্টা. ব্রাজিল৩৯, চীন ৪৬.১ ঘণ্টা। ভারতে সপ্তাহে কাজের ঘণ্টা ৪৬.৭০। তাহলে দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির জন্যে কাজের ঘণ্টা বাড়ানোর যুক্তি কীভাবে কাজ করে?
এর সাথে জুড়ে আছে একটি মারাত্মক বিষয়, কর্মীদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য। বহু লড়াই, রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আট ঘণ্টা কাজ, আট ঘণ্টা বিশ্রাম এবং আট ঘণ্টা বিনোদনের অধিকার তাহলে আজ কি হবে! বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) র সাথে যৌথভাবে ২০২১ সালে একটি বিশদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ২০০০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত সমীক্ষা চালিয়ে এরা দেখে, চাকরির সময়ের প্রসারের সাথে সম্পর্কিত রোগ এবং আঘাতের ঘটনায় ২০১৬ সালে বিশ্বব্যাপী ১৯ লক্ষ কর্মীর মৃত্যু কাজের সাথে সম্পর্কিত কারণগুলির সাথে যুক্ত ছিল। প্রতিবেদনটিতে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে, অতিরিক্ত কাজ করার সাথে যুক্ত সবচেয়ে বেশি সাধারণ রোগে আক্রান্ত হওয়ার মধ্যে রয়েছে হৃদরোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, উদ্বেগ, বিষণ্ণতা এবং আরও অনেক কিছু।
এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, দীর্ঘ সময় কাজ করা একজন কর্মচারীর হার্টের অবস্থাকে কীভাবে প্রভাবিত করতে পারে। ৩১-৪৮ ঘণ্টা (এক সপ্তাহ): ইস্কেমিক হৃদরোগের ক্ষতিকারকতার পরিমাণ বেশ কম। ৫৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করার ক্ষেত্রে  ইস্কেমিক হৃদরোগের ক্ষতিকারকতা মাঝারি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, যারা সপ্তাহে ৫৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করেন তাদের হৃদরোগজনিত রোগে মৃত্যুর ঝুঁকি ১৭ শতাংশ এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি ৩৫ শতাংশ বেড়ে যায়। ৪৫ ঘণ্টার বেশি কাজ করা কর্মীদের ৩০ থেকে ৪০ ঘণ্টা কাজ করে এমন কর্মীদের তুলনায় ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি ৫১ শতাংশ বেশি। ব্রেন ফগ বা মস্তিষ্কের কুয়াশা বলতে চিন্তাভাবনা এবং স্মৃতিশক্তির সমস্যা বোঝায়। এটি একটি অস্থায়ী অবস্থা, যখন মানসিক ক্ষমতা কমে যায়। মস্তিষ্কের কুয়াশায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের মনোনিবেশ করতে, সঠিক শব্দ খুঁজে পেতে সমস্যা হয়। সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য  পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। দীর্ঘমেয়াদি ঘুমের অভাব স্থূলতা, ডায়াবেটিস, হার্ট এবং রক্তনালীর (কার্ডিওভাসকুলার) রোগের ঝুঁকিও বাড়ায়। মানসিক স্বাস্থ্যের সমস্যা বাড়তে পারে, দীর্ঘস্থায়ী  কাজের চাপ, বিশ্রামের অভাব, ক্রমাগত "কাজের মোডে" থাকলে। একই কারণে বিষণ্ণতা এবং উদ্বেগজনিত রোগের ঝুঁকি বাড়তে পারে ।
সব থেকে বড় বিষয়, দেশ ও আন্তর্জাতিক শ্রমিক কর্মচারীদের আইনি অধিকারের বিরুদ্ধে গিয়ে বৃহৎ কর্পোরেটগুলোর মালিকরা এই ধরনের কথা বলার মতো জোরই বা পেলেন কোথায়? আর বিভিন্ন রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকার এক্ষেত্রে এতটা নীরবই বা  কেন! এখানেই আসল উত্তর লুকিয়ে আছে। অতিমারীর পর থেকে বিভিন্ন রাজ্যের সরকার এবং কেন্দ্রীয় সরকার শিল্পপতিদের জন্যে সব রকম দরজা খুলে দেবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একদিকে দেশের ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক ভাণ্ডার উজাড় করে দিচ্ছে, অন্যদিকে শ্রমজীবী মানুষের জীবনের বিনিময়ে শিল্পপতিদের ঘর ভরে দিচ্ছে। এখন এগুলি সকলেরই প্রায় জানা। এর বীজ লুকিয়ে আছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের শ্রমকোডগুলির মধ্যেই। বর্তমানে  যে ২৯টি কেন্দ্রীয় শ্রম ও শিল্প আইন রয়েছে সেই আইনগুলিকে চারটি শ্রম কোডে রূপান্তরিত করে শ্রমিকদের ধ্বংস করার প্রক্রিয়া চালাচ্ছে কেন্দ্রের সরকার। বামপন্থী শ্রমিক সংগঠনগুলি এর জোরদার বিরোধিতা করছে। আর তারই সাথে ২০২১ সালেই আসাম, গোয়া, গুজরাট, হরিয়ানা, হিমাচল, কর্নাটক, মধ্য প্রদেশ, ওডিশা, পাঞ্জাব, রাজস্থান, উত্তরাখণ্ড, উত্তর প্রদেশ  শ্রম আইনকে শিথিল করে অধ্যাদেশ (ordinance) ও বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে যার মাধ্যমে রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন কোম্পানি ও কারখানাগুলির জন্য সর্বাধিক দৈনিক কাজের সময় বাড়িয়ে ১২ ঘণ্টা করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বেশ কিছু রাজ্য শিল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, শ্রমিক কল্যাণমূলক সুবিধা এবং কাজের শর্তগুলির বিধান থেকে কিছু কোম্পানিকে ছাড় দিয়েছে। উত্তর প্রদেশ সহ বেশ কিছু রাজ্য মন্ত্রিসভা একটি অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে যার মাধ্যমে কিছু শর্ত সাপেক্ষে তিন বছরের জন্য সমস্ত শ্রম আইন থেকে কারখানা এবং  প্রতিষ্ঠানগুলিকে ছাড় দিয়েছে। এছাড়াও, কোম্পানিগুলিকে ‘কোম্পানি আইন, ১৯৪৮’-এর কিছু বিধান থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যেমন শৌচাগার, পানীয় জল, আলো, বায়ু চলাচল, বর্জ্য নিষ্পত্তি এবং বিপজ্জনক অপারেশনগুলির জন্য বিষয়গুলি, যা শ্রমিকদের জন্য মৌলিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করে– সেগুলি না মানলেও চলবে৷ এছাড়াও, কোম্পানিগুলিকে আইনের অধীনে থাকা বিভিন্ন অপরাধের জন্য নির্ধারিত জরিমানা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে, বিপজ্জনক প্রক্রিয়া থেকে আসন্ন বিপদের ক্ষেত্রে প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নেওয়া, বিপজ্জনক প্রক্রিয়ায় জড়িত বিপদের তথ্য প্রকাশ না করা, বিপজ্জনক পদার্থ পরিচালনার জন্য যোগ্য কর্মী নিয়োগ না করা এবং এই ধরনের কাজের অংশ কর্মীদের সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সুবিধা প্রদান না করা। যেখানে শ্রম সংক্রান্ত দ্বিতীয় জাতীয় কমিশন (২০০২) সুপারিশ করেছিল, সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনের আওতায় আনা উচিত। সুপ্রিম কোর্ট কনজিউমার এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার বনাম ইন্ডিয়া (১৯৯৫) এ রায় দিয়েছিল, একজনের স্বাস্থ্য এবং শক্তি রক্ষা করার জন্য স্বাস্থ্য ও চিকিৎসার অধিকার সংবিধানের ২১ নং অনুচ্ছেদের অধীনে একজন শ্রমিকের মৌলিক অধিকার। সেই অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।  
কোম্পানি আইন, ১৯৪৮-এ (ধারা ৫৪ এবং ৫১) অনুযায়ী, "নিয়োগকর্তাকে যে কোনও দিনে ৯ ঘণ্টার বেশি বা যে কোনও সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টার বেশি নিযুক্ত শ্রমিকদের ওভারটাইম মজুরি দিতে হবে। এই ধরনের ওভারটাইম বেতন অবশ্যই সাধারণ মজুরির দ্বিগুণ হতে হবে।" গুজরাট সরকার এটাকেও বদলে দিয়ে বলে, আনুপাতিকভাবে মজুরি দিলেই হবে। 
আজকের ভারতবর্ষে বিশাল বেকার যুব বাহিনী কাজের সন্ধানে ছুটছে। অতিমারীর হাত ধরে বহু মানুষ কাজ হারিয়ে নতুন করে বেকারের খাতায় নাম লিখিয়েছে।  ভারতের যুবসমাজ বেকার কর্মশক্তির প্রায় ৮৩ শতাংশ এবং মোট বেকার যুবকদের মধ্যে মাধ্যমিক বা উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত যুবকদের অংশ ২০০০ সালের ৩৫.২ শতাংশ থেকে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে ২০২২ সালে ৬৫.৭ শতাংশ হয়েছে, ইন্ডিয়া এমপ্লয়মেন্ট রিপোর্ট ২০২৪ অনুসারে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা এবং ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান ডেভেলপমেন্ট (আইএইচডি)। ২০০০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে যুব কর্মসংস্থান এবং স্বল্প কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু মহামারী বছরগুলিতে হ্রাস পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ভি অনন্ত নাগেশ্বরণ প্রকাশিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে, শিক্ষিত যুবকরা এই সময়ের মধ্যে দেশে অনেক বেশি মাত্রার বেকারত্বের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে রাজ্য এবং কেন্দ্রের সরকার শূন্যদগুলোকে অস্থায়ী কর্মী দিয়ে ভরাট করার চেষ্টা করছে। আর তাই প্রতিদিন গিগ এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রে কর্মীর মিছিল বাড়ছে । সেই বেকারত্ব থেকে মুক্তি পেতে, যে কোনও শর্তে কাজ করতে রাজি হয়ে যাচ্ছে এই বিরাট কর্মহীন মানুষের দল। সেই সুযোগ নিয়ে সব আইনকে নিজেদের মতো করে পালটে ফেলার সাহস দেখাতে পারছে মালিক শ্রেণি, কারণ জনগণের সরকার আজ মালিক শ্রেণির সরকারে পরিণত হয়েছে।
 

Comments :0

Login to leave a comment