অতুল চন্দ্র ও বিজয় প্রসাদ
২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪। শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশনের তরফে ঘোষণা হলো, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি)-র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি)-র প্রার্থী অনুরা কুমার দিশানায়েকে। ২০১৪ সাল থেকে বামপন্থী রাজনৈতিক দল জেভিপি’র নেতৃত্বে দিশানায়েকে। এবারের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ৩৭ জন প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাস্ত করেছেন তিনি। যার মধ্যে ছিলেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি এবং ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির রনিল বিক্রমসিংঘে। ছিলেন নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী সমাগি জনা বালাওয়েগায়ার সাজিথ প্রেমাদাসা। শ্রীলঙ্কা পডুজন পেরামুনা (এসএলপিপি) জোট এবং ইউএনপি’র মতো শ্রীলঙ্কার বহুদিনের রাজনৈতিক দলগুলি এতদিন প্রভাব বিস্তার করে এসেছে রাজনীতিতে। এবারের নির্বাচনে এই দলগুলিই পিছনে পড়ে গেল। শ্রীলঙ্কার সংসদে যদিও এখনও এই দলগুলিরই প্রাধান্য। মোট ২২৫টি আসনের মধ্যে এসএলপিপি ১০৫টি আর ইউএনপি ৩টি আসন রয়েছে। দিশানায়েকের দল জেভিপি’র সংসদে আসন রয়েছে মাত্র ৩টি।
দেশের নবম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দিশানায়েকের বিজয় একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। এবারই প্রথম দেশের মার্কসবাদী ধারার একটি দল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জয়ী হলো। ১৯৬৮ সালে জন্ম ‘একেডি’ নামে পরিচিত দিশানায়েকে কলম্বো থেকে অনেক দূরের উত্তর-মধ্য শ্রীলঙ্কার শ্রমিক পরিবারের সন্তান। শ্রীলঙ্কার ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও জেভিপি’র একজন কর্মী হিসাবে কাজ করার মধ্য দিয়ে তাঁর বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছে। বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী সিরিমাভো বন্দরনায়েকের কন্যা চন্দ্রিকা কুমারাতুঙ্গে ১৯৯৪ থেকে ২০০৫ অবধি রাষ্ট্রপতি ছিলেন। সে সময়ে জেভিপি’র সঙ্গে সমঝোতা গড়ে উঠেছিল। সে সময়ই দিশানায়েকে সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
কুমারাতুঙ্গের মন্ত্রীসভায় দিশানায়েকে ছিলেন কৃষি, ভূমি এবং পশুসম্পদ দপ্তরের মন্ত্রী। এই দায়িত্বে থাকার সুবাদে প্রশাসক হিসাবে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেন। পাশাপাশি কৃষি-সংস্কার নিয়ে বিতর্কে জনগণকে শামিল করতে সমর্থ হন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর আবার রাজনৈতিক আলোচনায় এটি মুখ্য বিষয় হিসাবে বিবেচিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
২০১৯ সালেও রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন দিশানায়েকে। তবে পরাজিত হয়েছিলেন। খুব সামান্য ভোটই পেয়েছিলেন। কিন্তু তার জন্যে দিশানায়েকে বা এনপিপি দমে যায়নি।
দিশানায়েকের জয়ের পর বিজয় সমাবেশের জনতার বিপুল উচ্ছ্বাসের ছবি কেউ অস্বীকার করতে পারছেন না। দিশানায়েকে বলেছেন যে দেশকে এক নতুন নবজাগরণ ও ‘সমৃদ্ধ দেশ, সুন্দর জীবনের’ আদর্শে চালিত করার লক্ষ্যে আপনাদের উপস্থিতি ও ২০২৪-এর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে সমর্থন সত্যিই প্রশংসনীয়!
দিশানায়েকে রাষ্ট্রপতি পদে শপথ নিয়েই জানিয়েছেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেবল লড়াই চলবে তা নয়। দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলের জন্যও চলবে লড়াই। দুর্নীতি এবং বিত্তবান রাজনৈতিক নেতাদের প্রাধান্যের কারণে রাজনীতির প্রতি জনতার অশ্রদ্ধা বাড়ছে। এই পরিবেশ বদলাতে হবে।
২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোকে ঝাঁকিয়ে দিয়েছিল ‘আরাগালয়া’। এই শব্দের অর্থ প্রতিবাদ। যার পরিণতিতে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদ দখল করে নেয় জনতা। প্রতাপশালী রাষ্ট্রপতি গোতাবায়া রাজাপক্ষেকে তড়িঘড়ি দেশ ছেড়ে পালাতে হয়। এই প্রতিবাদের কারণ ছিল দেশের-মানুষের অর্থনৈতিক সম্বলহীনতা; জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অভাব তাঁদের রাস্তায় নামতে বাধ্য করে। শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণের দায়ভার মেটাতে ব্যর্থ হয়ে দেউলিয়া হয়ে যায়। প্রতিবাদী মানুষের আয়ের রাস্তা প্রশস্ত না-করে, নয়া-উদারবাদী ও পাশ্চাত্য ঘেঁষা বিক্রমসিংঘে রাষ্ট্রপতির পদ দখল করেন রাজাপক্ষের ৬ বছরের মেয়াদের বাকি সময় সম্পূর্ণ করার জন্য।
রাষ্ট্রপতি হিসাবে বিক্রমসিংঘের অপদার্থ শাসনকাল ওই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদের অন্তর্নিহিত কারণগুলির কোনও সমাধান করেনি। ২০০৩ সালে শ্রীলঙ্কাকে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা আইএমএফ’র দুয়ারে দাঁড় করিয়েছে ২.৯ বিলিয়ন ডলারের শর্তসাপেক্ষ সহায়তার জন্যে, (১৯৬৫ সাল থেকে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের কাছ থেকে নেওয়া এটি ১৭ তম অনুদান)। আইএমএফ’র শর্তের জেরে বিদ্যুতের মতো জরুরি পরিষেবার উপর থেকে ভরতুকি প্রত্যাহার করা হয় এবং ১৮ শতাংশের ওপর দ্বিগুণ হারে বাড়তি মূল্যযুক্ত কর চাপানো হয়। এই ঋণের বোঝা বইতে হচ্ছে কোনও বাইরের ঋণদাতাকে নয়, শ্রীলঙ্কার শ্রমিক শ্রেণিকেই।
দিশানায়েকে বলেছেন, তিনি এই বন্দোবস্ত উলটে দেবেন। তাঁর বক্তব্য, আইএমএফ’র ঋণের চুক্তি পর্যালোচনার মাধ্যমে বাইরের ঋণদাতাদের ওপর অধিকতর দায়িত্ব চাপাবেন। আয়করে ছাড়ের সীমা বৃদ্ধি করবেন এবং একাধিক নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও পরিষেবার, যেমন খাদ্য ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা, ওপর চাপানো বাড়তি কর বাতিল করবেন। দিশানায়েকে যদি সত্যিই এই কাজ করতে পারেন এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি দমনে হস্তক্ষেপ করেন তবে গৃহযুদ্ধ-ক্লান্ত ও রাজনীতির ‘কুলীন কূলের’ বিশ্বাসঘাতকতার শিকার শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য ছাপ রাখতে সমর্থ হবেন।
১৯৬৫ সালে একটি মার্কবাদী লেনিনবাদী দল হিসাবে জেভিপি বা গণমুক্তি ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠা। রোহানা উইজেউইরার (১৯৪৩-১৯৮৯) নেতৃত্বে এই দল ১৯৭১ ও ১৯৮৭ থেকে ১৯৮৯-সালে দু’বার অন্যায়, দুর্নীতিগ্রস্ত ও নিয়ন্ত্রণাহীন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চেষ্টা করে। দু’টি অভ্যুত্থানই নৃশংসভাবে দমন করে রাষ্ট্র। যার ফলে উইজেউইরা সহ হাজার হাজার সদস্যেকে হত্যা করা হয়।
১৯৮৯ সালের পর জেভিপি সশ্রস্ত্র অভ্যুত্থানের পথ পরিহার করে সংসদীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। জেভিপি-তে দিশানায়েকের পূর্বসূরি নেতা সোমাওয়ানসা আমেরাসিংঘে (১৯৪৩-২০১৬) আটের দশকের শেষে, দলের প্রধান নেতৃবৃন্দের হত্যার ঘটনার পর, দলকে পুনর্গঠন করেন। নির্বাচনী সংগ্রাম ও সামাজিক ক্ষেত্রের লড়াইয়ে সমাজতান্ত্রিক নীতির অভিমুখ রেখে দলকে একটি বামপন্থী দল হিসাবে গড়ার দায়িত্ব এরপর নেন দিশানায়েকে। জেভিপি’র এই চমকপ্রদ অগ্রগতি দিশানায়েকের প্রজন্মের অবদান; যারা বয়সে দলের প্রতিষ্ঠাতাদের চেয়ে অন্তত কুড়ি বছরের ছোট এবং যারা শ্রীলঙ্কার শ্রমজীবী জনগণ ও দরিদ্রতর মানুষের মধ্যে দলের আদর্শগত ভিত্তি প্রোথিত করতে সমর্থ হয়েছেন।
তবে দলের কিছু কিছু নেতার সিংহলী জাতীয়তাবাদের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা রয়েছে। বিশেষ করে যখন সশস্ত্র উগ্রপন্থী বাহিনী এলটিটিই’র কর্মতৎপরতার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের প্রশ্ন এসেছে। দলে এই প্রবণতার প্রেক্ষিতে তামিল সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্নটি থেকেই যাচ্ছে। স্বজনপোষণে ডুবে থাকা দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত শাসকবর্গের সম্পূর্ণ বিপরীতে দিশানায়েকের ব্যক্তিগত সততা ও জাতিগত বিভাজনের দৃষ্টিভঙ্গির ঊর্ধ্বে উঠে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিকে পরিচালনা করতে চাওয়ার মানসিকতাই তাঁর এই উত্থানের প্রধান কারণ। এই নির্বাচনে জনতার রায়ে এই সম্পত্তিবানদের ধামাধরা রাজনীতিবিদদের ওপর থেকে ভরসা উঠে যাওয়ার লক্ষণ স্পষ্ট।
বাম সঙ্কীর্ণতাবাদের প্রত্যাখানও জেভিপি’র পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি কারণ। একুশটি বাম ও মধ্য-বাম সংগঠনকে নিয়ে জেভিপি’র উদ্যোগেই ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোট গঠিত হয়। যাদের অভিন্ন কর্মসূচি হচ্ছে শ্রীলঙ্কার জনগণের বৃহত্তর অংশের স্বার্থে দুর্নীতি ও আইএমএফ’র চাপিয়ে দেওয়া ব্যয় সঙ্কোচন নীতির মোকাবিলা করা।
এনপিপি’র কিছু কিছু অংশীদারদের মধ্যে তীব্র নীতিগত মতপার্থক্য থাকলেও রাজনীতি ও কর্মসূচির ক্ষেত্রে অভিন্ন কর্মসূচির প্রতি দায়বদ্ধতা ঘোষণা করা হয়েছে। এই কর্মসূচিটি স্বনির্ভরতা, শিল্পায়ন ও কৃষি সংস্কারের অর্থনৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে তৈরি হয়েছে। এনপিপি’র প্রধান শক্তি হিসাবে জেভিপি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলির (বিশেষ করে জ্বালানি ব্যবস্থাপনার মতো জরুরি ক্ষেত্র) জাতীয়করণ ও প্রগতিশীল কর ব্যবস্থা (ধনীদের করভার বাড়ানো) ও সামাজিক খাতে ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে সম্পদের পুনর্বণ্টনের সপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। জাতিগত সংঘাতে বিদীর্ণ শ্রীলঙ্কার সমাজে অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের এই বার্তাটি সাদরে গৃহীত হয়েছে।
অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বের এই কর্মসূচিটি কতটা বাস্তবায়িত করতে পারবেন দিশানায়েকে সেটাই আগামী দিনে দেখার। তবে তাঁর বিজয় নিশ্চিতভাবেই নতুন প্রজন্মের মধ্যে নতুন প্রাণের সঞ্চার করতে পেরেছে। যে প্রজন্ম অনুভব করতে পারছে যে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের প্রকল্প ছাড়াও দেশ এগতে পারে। শ্রীলঙ্কাকে এমন একটি পথে পুনর্গঠিত করার প্রচেষ্টাটি দক্ষিণ গোলার্ধের রাজনীতিতে একটি উদাহরণ হয়ে উঠতে পারে।
Comments :0