ODISHA TRAIN ACCIDENT

‘দেখলাম আপার বার্থ থেকে যাত্রীরা ছিটকে ছিটকে পড়ছেন!’

জাতীয় রাজ্য

odisha train accident bengali news ganashakti exclusive

শুক্রবার ওডিশার বালেশ্বরের কাছে দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে ছিলেন রায়গঞ্জের বাসিন্দা গৌতম মুখার্জি। সেই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা গণশক্তি ডিজিটালের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছেন তিনি। তাঁর ভিত্তিতেই এই অনুলিখন। 

 

ভুবনেশ্বরের সরকারি হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়েছি। সিটি স্ক্যান করা হয়েছে। আমার আঘাত গুরুতর না হলেও আমার স্ত্রীর মাথায় আঘাত লাগে। তাঁর সিটি স্ক্যান করানো হয়। 

গত সন্ধ্যার অভিজ্ঞতা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব। কার্যত মৃতদেহের স্তূপ ডিঙিয়ে আমাদের আসতে হয়েছে। এত কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখে নিজেকেই অপরাধী বলে মনে হচ্ছিল। নিজে যে সুস্থ এবং অক্ষত রয়েছি, এর জন্য অপরাধ বোধ কাজ করছে। মনে হচ্ছে একটু আঘাত পেলে ট্রেনের বাকিদের সঙ্গে সমব্যাথী হতে পারতাম। 

আমাদের কোচ নম্বর ছিল এ-১। এসি টু টিয়ার। তখন খুব বেশি হলে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। ট্রেন কিছুক্ষণ আগে বালেশ্বর পেরিয়েছে। হঠাৎ করে একটা ঝাঁকুনি অনুভব করলাম। কোচের আলোগুলি দপদপ করে উঠলেও পুরোপুরি নিভে যায়নি। এটাই যা বাঁচোয়া। একজন আমাদের সামনে দিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলেন। আমাদের সিটের ঠিক সামনে তিনি হঠাৎ ট্রেনের মেঝেতে পড়ে গেলেন। প্রথমে কিছুই বুঝতে পারিনি।  ভেবেছিলাম হয়ত অসুস্থ মানুষ, তাই পড়ে গিয়েছেন। কারণ করমণ্ডল এক্সপ্রেস করে তো প্রচুর রোগী চিকিৎসা করাতে দক্ষিণ ভারতে যায়। তারপর দেখলাম আশেপাশের আপার বাঙ্ক থেকে মানুষ ছিটকে ছিটকে মাটিতে পড়ছেন। আমি সাইড আপারে ছিলাম। ঝাঁকুনিটা যতটা ‘ভার্টিক্যালী’ লেগেছে, ততটা ‘হরাইজন্ট্যালী’ লাগেনি। তারফলেই হয়ত আমি অক্ষত রয়েছি। 

তারপর যখন পড়ে যাচ্ছি, তখন বুঝতে পারলাম কী হচ্ছে আসলে। আমার নীচের বাঙ্কের সাইড লোয়ারে আমার স্ত্রী ছিলেন। আমি তাঁকে ডাকছি। হঠাৎ দেখলাম সেই বার্থটা একটা দিকে বেঁকে গেল, এবং আমার স্ত্রীর মাথাটা অন্য একটা বাঙ্কের সঙ্গে ঠুকে গেল। এই ভাবে প্রচুর মানুষ, একজন অপরজনের উপর পড়ে যাচ্ছে। ঠিক কী হয়েছে সেটাই বুঝে উঠতে পারছি না। আর এসি কম্পার্টমেন্ট হওয়ার ফলে বাইরের আওয়াজও তেমন ভাবে কানে আসছে না। 

দুর্ঘটনাস্থলের সামনেই একটা লেভেল ক্রসিং ছিল। দুর্ঘটনার পরে কোনওক্রমে ট্রেনের কামরা থেকে বেরিয়ে সেই লেভেল ক্রসিং ধরে হাইওয়েতে উঠি আমরা। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। গ্রামের রাস্তা। ফোন কাজ করছে না। কিচ্ছু চিনি না। যাইহোক, কোনওক্রমে হাইওয়েতে পৌঁছই আমরা। 

সেখান থেকে কোনওক্রমে একটা গাড়িকে দাঁড় করানো হয়। আমাদের সঙ্গে সদ্য বিবাহিত একটি  দম্পতি ছিল। তাঁরা আমাদের সহযাত্রী ছিলেন। এই ঘটনার পরে খুবই অসহায় বোধ করছিলেন তাঁরা। তাই আমরা একসঙ্গে গাড়িটা ধরি। 

হাইওয়েতে তখন আরও মানুষ ভিড় করেছেন। যাই গাড়ি আসছে তাতে ওঠার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। সবাই চাইছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওই বধ্যভূমিটা থেকে পালাতে। 

কোনওক্রমে রাত দেড়টা নাগাদ আমরা ভূবনেশ্বর শহরে পৌঁছই। সেখানে গিয়ে একটা হোটেলে উঠি। কিন্তু অত রাতে সমস্ত খাবারের দোকান বন্ধ। পেটে একবিন্দু দানা নেই। শরীর অবশ হয়ে আসছিল। 

আজ সকালে উঠে জানতে পারি চেন্নাই যাওয়ার সমস্ত ট্রেন বাতিল হয়েছে। ফেরার এবং যাওয়ার সমস্ত ট্রেন বাতিল। কোনও রেসকিউ ভ্যান, কোনও স্পেশাল ট্রেন- কিচ্ছু চালাচ্ছে না সরকার। আমরা যাঁরা মরতে পারিনি তাঁরা দুর্বিষহ অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। তাঁরা কোথায় আছে সে বিষয়ে রেলের তরফে ন্যূনতম খোঁজটুকু নেওয়া হয়নি। তাঁরা কেউ ধর্মশালায়, কেউ খোলা আকাশের নীচে রাত কাটিয়েছে। এখন তাঁরা বাড়িও ফিরতে পারছে না। 

ভূবনেশ্বর স্টেশনে থিকথিকে ভিড়। বাতিল হওয়া ট্রেনগুলির যাত্রীরা উৎকন্ঠা নিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ট্রেন কখন চালু হবে কেউ কোনও সদুত্তর দিতে পারছে না। ঘটনার সুযোগ নিয়ে কার্যত লুঠ চলছে। পানীয় জল, খাবার, অটো ভাড়া লাগামছাড়া হারে বেড়ে গিয়েছে। দেখার কেউ নেই। যাচ্ছে তাই অবস্থা। 

আপাতত ভূবনেশ্বর স্টেশনে বসে রয়েছি। কোনও স্পেশাল ট্রেন ছাড়বে কিনা জানতে এসেছে। যত দ্রুত সম্ভব আমরা বাড়ি ফিরতে চাই। 

Comments :0

Login to leave a comment