অন্যকথা
দেওয়ালের লিখন
কৃশানু ভট্টাচার্য্য
মুক্তধারা
নড়বড়ে মইটা দিয়ে একটা উঁচু দেয়ালে উঠে গেল সেই শীর্নকায় শরীরের একটি যুবক। শরীর শীর্নকায় হলে কি হবে, কন্ঠের তেজে সে একাই নিয়ন্ত্রণ করত বেশ কয়েকটি কলেজের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীকে। কাগজে কলমে তার নাম ছিল তাপস মুখোপাধ্যায়। মধ্য কলকাতায় রাজাবাজার, বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিট, ঝামাপুকুর লেন এলাকায় এই নামেই তাকে বেশি লোক চিনতো না। তাকে কিন্তু কামান বু বলে। বু ছিল তার বাড়ির ডাকনাম। আর অনায়াস দক্ষতায় দেওয়ালে দেওয়ালে বোফোর্স কামানের ছবি এঁকে তার নাম হয়ে গিয়েছিল কামান বু।
এটা ১৯৮৯ সালের ঘটনা.। দেশের রাজনীতিতে তখন কামান কেলেঙ্কারি কিংবা কামানো কেলেঙ্কারি বেশ জোরালো। কলেজের ক্যান্টিনে কিংবা জি বি তে এ নিয়ে তোলপাড় আলোচনা। সে সময় গায়ে মফস্বলের গন্ধ মেখে যে কিশোর কিংবা সদ্য যুবকের দল চিনে নিতে শিখছে স্বাধীনতার মানে তাদের কাছে কামান বু দা রীতিমত আইকন। তার পিছনে রঙের হাড়ি, তুলি, চুনের বালতি নিয়ে মই কাছে ছুটছে শয়ে শয়ে ছাত্র। কখনো কখনো অবসরে বিদ্যাসাগর কলেজের শিশিরের ক্যান্টিনে গণশক্তি শিরোনাম দেখে সাদা কাগজে তাদের পোস্টার লেখবার ক্লাস নিচ্ছেন কমরেড বু। সারা জীবনের সারেগামার সা য়ে সা লাগাতে না পারা আর গণশক্তি শিরোনামের গণশক্তির গ এ গ লাগাতে না পারা উঠতি যুবকের দলও হাল ছাড়ছে না। বালতি হাতে রাজাবাজারের বস্তির দেওয়ালে চুনকাম করাটাও তো অন্ততপক্ষে তার কাছে একটা নভেম্বর বিপ্লব। বুকের স্পন্দনে তখন দ্রীমি দ্রীমি তালে বাজছেন মার্কস , এঙ্গেলস , লেনিন।
সময় বদলেছে ,যুগ বদলেছে, বদলে গেছে রাজ পাট। বদলাইনি কিন্তু ওই দেওয়ালের লেখা। নির্বাচনী হোক কিংবা কোন গণ আন্দোলন- জলপাইগুড়ি হোক কিংবা জঙ্গিপুর- এই বাংলায় এখনো দেওয়াল ডাক দিয়ে যায় রাজনৈতিক প্রতিরোধের, রাজনৈতিক আন্দোলনের , ইনসাফের । কলম তুলি আর রঙে যারা সাবলীল সেই ধরনের অসংখ্য বু দা দের দল আজও অজস্র কিশোর কিশোরী যুবক যুবতীর হৃদয়ে পৌঁছে দেন রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তাপ। দেওয়ালের লেখা দেখে আজকের এই বিভাজনের বাইনারির দিনেও ইনসাফের দাবিতে সরব হয় এই প্রজন্ম। যাদের আড়ালে আবডালে পূর্ববর্তী প্রজন্ম বলে মি টু প্রজন্ম। প্রজন্ম বদলায় , বদলে যায় ভাষা, বদলে যায় মত প্রকাশের ভঙ্গিমা। দেওয়ালের লেখা কিন্তু একই থেকে যায় । দেওয়ালের লেখা যেন হ্যামলিনের সেই বাঁশির সুর। আর বু দারা সেই রহস্যময় বাঁশীওয়ালা।
Comments :0