Siliguri

শিলিগুড়িতে অধিকার যাত্রা

জেলা

অনিন্দিতা দত্ত : শিলিগুড়ি

‘বন্ধ হোক বিভাজন—গড়ে উঠুক সম্প্রীতি, হোক গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠা’ এই স্লোগানকে সামনে রেখে হকের দাবিতে রাজ্য সরকারী কর্মীদের অধিকার যাত্রা প্রতিদিন এগিয়ে চলেছে। শ্রমজীবি মানুষের লড়াই আন্দোলনের বিশেষ দিনে বুধবার আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষনে দার্জিলিঙ জেলার শিলিগুড়িতে পা রাখা অধিকার যাত্রা থেকে আওয়াজ উঠেছে সবার পেটে ভাত ও সবার হাতে কাজ চাই। প্রকৃত ধর্মাচরন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, রাজ্য কো—অর্ডিনেশন কমিটির সংগ্রাম জারি থাকবে। সংগঠনের রাজ্য সাধারন সম্পাদক বলেছেন, দিন বদলের সময় এসেছে। শাসকদলের চোখে চোখ রেখে জানান দেওয়া হবে অত্যাচারিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষ ক্রমশই ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে ও বিভাজনের রাজনীতি করে সাধারন মানুষের সেই ঐক্যবদ্ধতাকে কোনভাবেই ভেঙে দেওয়া যাবে না। 
ফেব্রুয়ারি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে সমগ্র উত্তরবঙ্গ সহ দার্জিলিঙ জেলা জুড়ে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা চলছে। এদিনের সকাল ছিলো কুয়াশায় ঢাকা। সূর্যের দেখা মেলেনি। তবুও অধিকার যাত্রার পদযাত্রীদের স্বাগত জানাতে হাসমিচকে উপস্থিত ছিলেন অসংখ্য মানুষ। গত ১৭ফেব্রুয়ারি কোচবিহার জেলার সিতাই থেকে শুরু হওয়া অধিকার যাত্রার পদযাত্রীরা জলপাইগুড়ি জেলার সীমানা পেরিয়ে দার্জিলিঙ জেলায় প্রবেশ করে মঙ্গলবার রাতেই শিলিগুড়ির অদূরে তিনবাত্তিতে এসে পৌঁছেছে। পঞ্চম দিনে যাত্রার পদযাত্রীরা সকালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শিলিগুড়ির বাঘাযতীন পার্কের শহীদ স্মৃতি স্মারকে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর অধিকার যাত্রায় পা মেলান। এদিন শিলিগুড়ির মূল শহরে প্রবেশ করে অধিকার যাত্রাকে এগিয়ে দিতে সাধারন মানুষের সহযোগিতা ও তাদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেয়ে আপ্লুত হয়ে যান পদযাত্রীরা। 
শিলিগুড়িতে অধিকারের যাত্রা সোচ্চারিত হয়েছে জনজীবনের সমস্যা, যুব সমাজের যন্ত্রনা ও বেকারদের কাজের দাবিতে। পাহাড় থেকে সাগর পরিবর্তনের আওয়াজ উঠেছে। বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শূন্যপদে স্বচ্ছভাবে স্থায়ী নিয়োগ, সমকাজে সমবেতন, স্থায়ী চাকরি, কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ্যভাতা ও রিলিফ দেবার দাবিতে আগামীদিনে অর্জিত অধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ের মাধ্যমে প্রতিরোধের বার্তা ছড়িয়ে দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে অধিকারের যাত্রাপথ। রাজ্য ভিত্তিক চার দফা দাবি ছাড়াও শিলিগুড়ি শহরকে যানজট মুক্ত করা, অবিলম্বে হাসমিচক থেকে দার্জিলিঙ মোড় পর্যন্ত ফ্লাইওভার নির্মান করা, চা বাগানের শ্রমিকদের জন্য ন্যূনতম মজুরি নির্ধারন করা, চা বাগান সংলগ্ন পতিত জমিতে ওই বাগানের শ্রমিকদের জমির পাট্টা দেওয়া ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্থানীয় দাবিতেও শ্লোগান ওঠে অধিকার যাত্রা থেকে। এদিন সকালে লাল পতাকা, প্ল্যাকার্ড হাতে, ট্যাবলো সহযোগে জলপাইমোড় থেকে অধিকার যাত্রার মূল কর্মসূচী শুরু হয়। রাস্তায় বীমা কর্মচারীদের পক্ষ থেকে অধিকারের যাত্রীদের সম্বর্ধনা জানানো হয়। অধিকার যাত্রার পদযাত্রীরা জলপাইমোড় থেকে থানা মোড় হয়ে ফ্লাইওভার দিয়ে পায়ে হেঁটে ভেনাস মোড়ে হাসমিচকে পৌঁছান প্রায় বেলা ১১টা নাগাদ। 
দার্জিলিঙ জেলার সমতলের শহর শিলিগুড়িতে উপস্থিত সাধারন মানুষের সামনে হাসমিচকে অধিকার যাত্রার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কো—অর্ডিনেশন কমিটির রাজ্য সাধারন সম্পাদক বিশ্বজিৎ গুপ্ত চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত জাত পাত ধর্ম বর্ন নির্বিশেষে সকল শ্রেনীর মানুষের অধিকারের দাবি ও অর্জিত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য প্রথম পর্যায়ে ৪হাজার কিমি পথের এই অধিকার যাত্রা পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছে। ভারতবর্ষের গণতন্ত্র বর্তমান সময়ে আক্রান্ত হয়েছে। দেশের মানুষকে ভাষা ও ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। দেশের বহুত্ববাদী সংষ্কৃতির ওপর আঘাত হানছে সরকার। ধর্মীয় জিগির তুলে উন্মাদনার পরিবেশ কায়েম করার চেষ্টা হচ্ছে। অশুভ সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে সম্মিলিত সচেতনতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। সন্দেশখালি থেকে শুরু করে দেশের মহিলাদের মান সম্মান প্রতিনিয়ত ভূলুন্ঠিত হচ্ছে। আর অন্যদিকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ৫০০/১০০০টাকা দিয়ে মহিলাদের দর কষছেন। সরকার বিভিন্ন সাইনবোর্ডের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে সচেতনতা প্রচারে আমাদের অধিকার যাত্রা। রাজ্য ও দেশের গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়েই রাস্তায় আন্দোলনে অংশগ্রহন করেছি। এই সময়কালে দুই সরকারের নানা জনবিরোধী নীতির ফলে বিভিন্ন অংশের মানুষের মধ্যে যেমন দাবি উঠছে, তেমনি ব্যাপক ক্ষোভ পঞ্জীভূত হয়েছে। অধিকার যাত্রার মাধ্যমে সাধারন মানুষের জীবন দুর্দশার কথা, তাদের মনে জমে থাকা অনেক না পাওয়ার কথা শুনছি। আর এই ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে আগামী ১৪মার্চ নবান্ন অভিযানের মধ্য দিয়ে। 
অধিকার যাত্রা কি ও কেন করা হচ্ছে তা সংক্ষেপে তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন রাজ্য কো—অর্ডিনেশন কমিটির দার্জিলিঙ জেলা সম্পাদক অরিন্দম মিত্র। বলেন, বর্তমান সময়ে মানুষের ভাষা ও সংষ্কৃতি দুই ই আক্রান্ত। জীবনজীবিকার ওপরেও আক্রমন নামিয়ে এনেছে কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন দুই সরকার। শুধু তাই নয়, সরকারের আক্রমনের শিকার হয়েছেন সরকারী কর্মচারীরাও। কর্মসংস্থান সৃষ্টির কোন উদ্যোগ নেই। অস্থায়ী কর্মী নিয়োগ করে দপ্তর ভরানো হচ্ছে। জীবন জীবিকা চালাতে উচ্চশিক্ষিত ছেলেমেয়েরা নামমাত্র টাকায় কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশের বর্তমান অবস্থা। বিভাজনের রাজনীতিকে স্তব্ধ করে দিয়ে আমার আপনার সকলের স্বার্থে সরকার গঠন করতে হবে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত রাস্তার লড়াই আন্দোলন জারি রাখার শপথ গ্রহনের আহ্বান জানান তিনি। 
শিলিগুড়ি শহরের সফদার হাসমিচকে সিআইটিইউ, ১২ই জুলাই কমিটির পক্ষ থেকে সম্বর্ধনা জানানো হয় পদযাত্রীদের। সংক্ষিপ্ত সভা চলার পরে হিলকার্ট রোড ধরে এগিয়ে চলে রাজ্য সরকারী কর্মীদের যাত্রা। সেবক মোড়, এয়ারভিউ মোড়, জংশন পার করে সোজা পদযাত্রীরা হাঁটা পথে শিলিগুড়ি এসডিও অফিস পর্যন্ত পৌঁছায়। এরপর শিলিগুড়ি মহকুমার গ্রামীন মানুষকে সচেতন ও জাগ্রত করে এগিয়ে চলে অধিকার যাত্রা। মোটর সাইকেল মিছিল করে দার্জিলিঙ মোড়, শিবমন্দির, মেডিকেল মোড় সংলগ্ন সূর্যসেন মার্কেটের সামনে পথসভা হয়। বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সম্পাদক শ্বাশতী মজুমদার প্রমুখ। ফাঁসিদেওয়া বাজারেও অনুরূপ একটি সভায় যোগ দেন অধিকারের পদযাত্রীরা। এরপর অধিকার যাত্রা ফাঁসিদেওয়া থেকে ঘোষপুকুর হয়ে শিলিগুড়ি মহকুমার খড়িবাড়ি পৌঁছে যায়। প্রায় এক কিমি রাস্তা পদযাত্রা করে খড়িবাড়ি বাজারেও অপর একটি পথসভায় মিলিত হন অধিকারের যাত্রীরা। বক্তব্য রাখেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক দেবব্রত রায় প্রমুখ। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। বিকেলে খড়িবাড়ি থেকে ঘোষপুকুর হয়ে বিধাননগর হাসপাতালের সামনে থেকে পদযাত্রা হয় থানা পর্যন্ত। বিধাননগর থানা এলাকায় সভার পর, একেবারে শেষ বিকেলে সোনাপুর হয়ে অধিকারের যাত্রা উত্তরদিনাজপুর জেলার উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে যায়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা চলাকালীন এই কর্মসূচীতে কোথাও কোন মাইকের ব্যবহার হয়নি। মহকুমার গ্রামীন এলাকার বিভিন্ন জায়গায় সংগঠনের মেডিকেল কলেজ সেক্টর, কৃষক সভা, সিআইটিইউ, যুব ও ছাত্র সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্বর্ধিত করা হয় যাত্রার যাত্রীদের। দার্জিলিঙ জেলার অধিকার যাত্রার গোটা কর্মসূচীতে উপস্থিত ছিলেন জেলা কর্মচারী আন্দোলনের নেতৃত্ব উত্তম চতুর্বেদী, অচিন্ত্য সরকার, ১২ই জুলাই কমিটির অন্যতম যুগ্ন আহ্বায়ক পার্থ ভৌমিক, কর্মচারী আন্দোলনের নেতা মৃত্যুঞ্জয় সরকার, সমরেশ ভট্টাচার্য প্রমুখ।

Comments :0

Login to leave a comment