Buddhadeb Bhattacharya

বুদ্ধদেবের উদ্যোগেই নাট্য একাডেমি, নাট্যমেলা

রাজ্য বিশেষ বিভাগ

অশোক মুখোপাধ্যায়
 

আমরা দু’জনেই উত্তর কলকাতার পাশাপশি দুই পাড়ার বাসিন্দা ছিলাম। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সাথে প্রথম আলাপ ঠিক কবে হয় সেকথা এখন আর মনে পড়ে না, তবে এটুকু নিশ্চিত যে ব্যাপারটা ছোট বয়সেই হয়েছিল। বয়সে উনি আমার চাইতে বছর চারেকের ছোট। দুটি পরিবারই ভাড়াটিয়া হিসাবে বসবাস করত, ওরা থাকতেন শ্যামপুকুর এলাকায়, আমরা ছিলাম শোভাবাজারে। পাড়া আলাদা হলেও আমরা একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম, শৈলেন্দ্র সরকার বিদ্যালয়। বুদ্ধ আমার ছোট ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন। আমাদের পাড়ায় তার এক বিশেষ বন্ধু থাকতেন, সোমেন রায় (ডাকনাম ছিল খোকন)। সোমেনের সুবাদেই বুদ্ধ আমাদের পাড়ায় আসতেন, আড্ডায় বসতেন, সেভাবেই পরিচিত হই। পরবর্তীকালে দু’জনে দু’দিকে চলে যাই, সেভাবে যোগাযোগ আর ছিল না। আশির দশকের মাঝামাঝি পুনরায় বুদ্ধদেবের সাথে যোগাযোগ হলো। উনি তখন সংস্কৃতি মন্ত্রী হওয়ার কারণে থিয়েটারের মানুষদের আপনজন হয়ে উঠেছেন। তখনই নাট্য একাডেমি তৈরি হয়, আমরা অনেকেই তার সদস্য হই। এই সময়টায় ওকে অনেকটা ভালোভাবে জানার সুযোগ হয়। কাজের সুবাদেই থিয়েটারের জন্য ওর যে বিশেষ ভালোবাসা ছিল, তা লক্ষ্য করি। কবিতা, সিনেমা প্রসঙ্গে অনেকেই ওর কথা বলেন ঠিকই, আমরা কিন্তু থিয়েটার সম্পর্কেও ওর আবেগকে চিনতে পেরেছিলাম। পরে ওর উদ্যোগেই নাট্যমেলা, নাট্য প্রশিক্ষণ (থিয়েটার ওয়ার্কশপ) এবং নাট্য ব্যক্তিত্বদের সম্মান জানানোর কাজ শুরু করে নাট্য একাডেমি।
ক্লিফোর্ড ওদেটসের লেখা একটি বিখ্যাত নাটক ‘ওয়েটিং ফর লেফটি’, কলেজের পড়ার শুরুর দিকেই ‘বিজয়ের অপেক্ষায়’ নামে নাটকের বাংলা অনুবাদ করেছিলেন বুদ্ধদেব। ওদের পাড়ায় সেটি অভিনয়ও হয়েছিল। ১৯৮৬ সালে ‘বেলা অবেলার গল্প’ নামে আমাদের প্রযোজনা ওর বেশ ভালো লাগে। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ঘরে ব্রেখটের নাটক সম্পর্কে ওর সাথে আমি ও বিভাস চক্রবর্তী দীর্ঘ আলোচনা করেছি। ’৯৩ সালে আমি রবীন্দ্রভারতীর নাটক বিভাগে যোগ দিই। তখন উনি দুঃসময় নামের একটি নাটক লিখেছিলেন। এর নির্দেশনার জন্য উনি আমাকে ও ঊষা গাঙ্গুলিকে ডেকে পাঠান। এর আগের বছর বাবরি মসজিদের ঘটনা ঘটেছে, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধিতার প্রেক্ষিতেই নাটকটি লেখা। আমার যতদূর মনে পড়ছে ঐ বছরই ১৫ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রসদনে নাটকটি মঞ্চস্থ হওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এই নিয়ে তুমুল আলোড়ন তৈরি হয়, জ্যোতি বসু নিজে সেই অভিনয় দেখতে এসেছিলেন। নাটক শেষ হলে আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। এর পরেও নাটকটির বহু অভিনয় হয়েছিল। অসিত মুখোপাধ্যায়, মায়া ঘোষ, সব্যসাচী চক্রবর্তী প্রমুখেরা তাতে অভিনয় করেন। 
এরপরে ১৯৯৯ সালে তিনি রূপান্তর নামে আরেকটি নাটক লেখেন। ফ্রাঞ্জ কাফকা’র বিখ্যাত গল্প ‘মেটামরফোসিস’কে অবলম্বন করে এই নাটকটি লেখা। বুদ্ধদেব এর নাম রেখেছিলেন ‘রূপান্তর’, আমি সেই নাম বদল করে ‘পোকা’ নামের প্রস্তাব দিলে তিনি এককথায় রাজি হয়ে যান। এমনই খোলা মনের অধিকারী ছিলেন তিনি। বিভিন্ন কারণে নাটকটি মঞ্চস্থ করতে আমার প্রায় দু’বছর সময় লাগে, এর মাঝে উনি একবারও কোনোরকম তাগাদা দেননি। আপনাকে লেখাটি দিয়েছি, ওটার মঞ্চস্থ হওয়া আপনার ব্যাপার, এমনই মনোভাব ছিল ওর। এর মাঝেই উনি সংস্কৃতি মন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে গেলেন। 
এই প্রসঙ্গই বলে রাখা উচিত, নাট্য একাডেমি তৈরির সাথেই তিনটি বড় কাজ হয়েছিল। প্রথমটি নাট্যমেলা, এক বিরাট উৎসব। দুই, এই একাডেমির কাজ হিসাবেই নাট্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। আজ যাকে ওয়ার্কশপ বলার রেওয়াজ হয়েছে। নাট্য একাডেমির শিক্ষাক্রম থেকেই এর সূত্রপাত। তিন নম্বর বড় কাজ হয়েছিল নাটকের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতি মানুষজনকে সম্মান জানানো। দীনবন্ধু পুরস্কার, গিরীশ পুরস্কার সবই তখনকার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রূপায়িত হয়েছিল। বছরের সেরা নাটক, অভিনেতা অভিনেত্রীদের সম্মান দেওয়া, এসমস্ত ঘিরে বাংলা নাটকের জগতে রীতিমত উৎসাহের পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। 
আজ একটি স্মরণালেখ্যের মধ্যে তার সাথে আমার সমস্ত স্মৃতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাষায় লেখা সম্ভব নয়। তবে এই লেখার শেষে অন্তত আরও একটি ঘটনার কথা উল্লেখ না করলে সেই পরিচিতি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ঘটনাটি ২০০৯ এর নন্দীগ্রামে গুলি চালনার ঘটনার সাথে যুক্ত। আমরা ষোল জন নাট্যকর্মী তখন পশ্চিমবঙ্গ নাট্য একাডেমি থেকে পদত্যাগ করি। কুমার রায় তখন নাট্য একাডেমির সভাপতি। বুদ্ধদেব ঐ ঘটনায় অদ্ভুত ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেন। কুমারদা’র মারফত উনি আমাদের সাথে কথা বলেন, কথার শেষে আমরা ন’জন পুনরায় নিজেদের কাজে ফিরেও যাই। উনি একটাই কথা বলেছিলেন, আপনারা নিজেদের কথা অবশ্যই বলুন কিন্তু একাডেমির কাজটি ছেড়ে দেবেন না। থিয়েটার আপনাদেরই কাজ, আপনারা ছেড়ে দিলে একাডেমি ও থিয়েটার দুটোই আর চলবে না, বন্ধ হয়ে যাবে। অবশ্য ২০১১ সালের পর সেই পাট আমার চুকে গেছে। 
এর পরবর্তীকালে তার সাথে যোগাযোগ কিছুটা ক্ষীণ হয়ে পড়ে। আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই, আমরা যারা থিয়েটারের লোক হিসাবে পরিচিত তারা ওকে নিজেদের লোক বলেই মনে করি। নাটক রচয়িতা ছিলেন, বলা উচিত নাটক বিষয়ে উনি একজন বোদ্ধা ছিলেন। সারা পৃথিবীর নাটক সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা ছিল, সেই বোঝাপড়ায় কোথাও কোনও খাদ ছিল না। 
একজন নাট্যকর্মী হিসাবে তার প্রতি আমার আন্তরিক কুর্নিশ জানাই।

Comments :0

Login to leave a comment