দেশের অর্থনীতির হালহকিকত সম্পর্কে পালা করে প্রচারিত সরকারি ভাষ্য এবং সংবাদ মাধ্যমে তার প্রতিফলন থেকে সাধারণ জনমানসে এমন ধারণা বদ্ধমূল হবার উপক্রম হয়েছে যে অর্থনীতির বিকাশ এবং সফলতার প্রধান মাপকাঠিই হলো বৃদ্ধির হার। অর্থাৎ ত্রৈমাসিক বা বার্ষিক কত হারে বৃদ্ধি হচ্ছে সেটাই আসল কথা। গত অর্থবর্ষে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮ শতাংশ ছাড়িয়েছিল। এবার সেটা ৭ শতাংশ হবে বলে আশা। প্রতি দু’মাস অন্তর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঋণনীতি বিষয়ক কমিটির বৈঠকে ঘটা করে জানান দেওয়া হয় বৃদ্ধির হার কত হতে পারে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর তো কার্যত প্রতিদিনই কোনও না কোনও উপলক্ষে যে ভাষ্য হাজির করেন তাতে অনিবার্যভাবে থাকবে অর্থনীতি ঠিক পথে আছে, তার অন্তর্নিহিত শক্তি অটুট, বহির্বিশ্বের দোলাচলের বিশেষ প্রভাব পড়বে না, বৃদ্ধির হারও থাকার প্রত্যাশা অনুযায়ী। সরকারের মুখ্য অর্থনীতি উপদেষ্টারও কার্যত একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে শক্তিশালী অর্থনীতির বিশ্বে সর্বোচ্চ হারে বৃদ্ধির ঢাক পেটানো। আর অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামনও এই গণ্ডি থেকে বের হবার চেষ্টা করছেন।
অর্থনীতির আকার আয়তন, জিডিপি বৃদ্ধির হার, শেয়ার সূচকের উল্কা গতি ইত্যাদি আপাত কিছু মাপকাঠিতে অর্থনীতিকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে এমন এক লোভনীয় মোড়ক তৈরির চেষ্টা হচ্ছে যে অর্থনীতির আসল কথাগুলোই সরকারি ভাষ্য এবং সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই আসল কথার গোড়াতেই আছে অর্থনীতি কাদের জন্য? অর্থনীতির বিকাশ হলে সেটা কাদের সুফল দেবে? অর্থনীতির আকার আয়তন যতই বাড়ুক বা বৃদ্ধির হার যত উচ্চই হোক তার ফসল যদি আমজনতার ঘরে না ঢোকে তাহলে সেই অর্থনীতি নিয়ে জনতার আহ্লাদিত হবার কারণ নেই। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে পুঁজি লগ্নি করে পুঁজির মালিক। লোক খাটিয়ে তাদের শ্রম ব্যবহার করে যে উৎপাদন হয় তা বিপণন করে মুনাফা হয়। মুনাফা যায় মালিকের ঘরে। মালিকের সম্পদ বাড়ে। তাতে শ্রমজীবী মানুষের কোনও স্বার্থ সিদ্ধি হয় না।
অর্থনীতির আয়তন ও বৃদ্ধির হার বাড়ার ফলে যদি সেটা কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে ও মজুরি বৃদ্ধিতে প্রতিফলিত হয় তবেই আমজনতার লাভবান হতে পারে। দেশে বেকারি কমতে পারে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়তে পারে, বাজারে পণ্য ও পরিষেবার চাহিদা বাড়তে পারে। বাস্তবে তেমন কিছুই হচ্ছে না। মোদী সরকার অর্থনীতির যে ঘরানা অনুসরণ করছে সেটা প্রধানত পুঁজি নিবিড়। এতে অনেক পুঁজি বিনিয়োগ হলেও এবং অনেক মুনাফা হলেও কর্মসংস্থান হয় না। ভারতের মতো জনবহুল দেশে যে দরকার সেটা হলো শ্রমনিবিড় ঘরানা। দেশের বিপুল মানব সম্পদকে ব্যবহার করে যদি অর্থনীতির কর্মকাণ্ডে যুক্ত করা না যায় তাহলে দেশের বেশিরভাগ মানুষের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি থেমে যাবে। দৈনন্দিন জীবন তাদের দুর্বিষহ হতাশায় ভরে যাবে। কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমন অর্থনীতি ভাবনা গণতন্ত্রবিরোধী। অর্থনীতির সেই ঘরানাকেই বেছে নিতে হবে যা সব নাগরিকের জীবনে অগ্রগতির বার্তা নিয়ে আসতে পারে। বদলে যে পথে সরকার হাঁটছে সেটা অল্প সংখ্যক মানুষের প্রচুর রোজগার ও বিলাসবহুল জীবনের ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। তাই কর্মসংস্থান তৈরি হয় না, বেকাররা কাজ পায় না, মজুরি বাড়ে না, মানুষের জীবন যন্ত্রণাও কমে না। আর এই সত্য ও বাস্তব চাপা দিতে এসব নিয়ে কোনও সরকারি ভাষ্যও তৈরি হয় না।
Comments :0