ঈশিতা মুখার্জি
মোদী সরকার খুবই গর্ব করে দেশের মানুষের কাছে অভূতপুর্ব আর্থিক বিকাশের গল্প শোনাচ্ছে। দেশের জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার এত বড় মাপে নাকি অতীতে হয়নি। দেশের মানুষের কাছে এরকম তথ্য তো উৎসাহের, আনন্দের কথা। কিন্তু এই বিকাশ কোথায় খুঁজে পাবে তাঁরা? আর্থিক বৃদ্ধির হার তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে একটি সংখ্যা ৮%। কিন্তু দেশের জাতীয় উৎপাদন তো আসে দেশের কৃষি, শিল্প, পরিষেবা এসব ক্ষেত্র থেকে। তাহলে এই বিকাশকে সেখানে কি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে, অর্থাৎ দেশের বিভিন্ন আর্থিক ক্ষেত্রে কি বিকাশের কথা তথ্য জানাচ্ছে?
ওদিকে দেশে কর্মসংস্থান তলানিতে। সদ্য প্রকাশিত বিশ্ব শ্রম সংস্থা এবং ভারতের মানবোন্নয়নের সংস্থা যৌথভাবে প্রকাশ করেছে ভারতের ২০২৪ সালের কর্মসংস্থান রিপোর্ট। সেই রিপোর্টের সব তথ্য নেওয়া হয়েছে দেশের পরিসংখ্যান দপ্তর কর্তৃক প্রকাশিত পিরিয়ডিক লেবার সার্ভে রিপোর্ট থেকে এবং সরকারি পরিসংখ্যান থেকে। সেখানে উদ্বেগের সঙ্গে বলা হয়েছে যে শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের হাতে কাজ নেই। এ ছাড়াও লেখাপড়া করছে না, কাজও করছে না (NEET) এমন যুবক যুবতীর অংশ যুব সম্প্রদায়ের জনসংখ্যার নিরিখে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে বৃহত্তম। ওদিকে কাজের জন্য তৈরি উচ্চশিক্ষিত যুবক যুবতী, কিন্তু দেশের “বিকাশের”ধারা এমনটাই যে শিক্ষিত যুবসম্প্রদায়ের শিক্ষা দীক্ষা “বিকাশের”কাজে লাগছে না। তাই তো প্রশ্ন এই ‘বিকাশ”খুঁজে পাব কোথায়? দেখা যাচ্ছে তো এই “বিকাশ”সৃষ্টিতে মানব সম্পদের কোনও প্রয়োজন নেই।
দেখা যাক দেশের কৃষি, শিল্পে, পরিষেবায় কিরকম “বিকাশ”হয়েছে। দেশের জাতীয় মোট মূল্যে কৃষির অংশ ২০২৩ সালে ছিল ১৫.১২%। শিল্পের অংশ ছিল ৩০.৬৭% এবং সবথেকে বড় অংশ ছিল পরিষেবা ৫৪.২০%। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তুলনায় গড়ে এদেশে মোট জাতীয় উৎপাদনে কৃষির অংশ বেশি। আবার অন্যান্য দেশে গড়ে শিল্পের যে গুরুত্ব তাকে জাতীয় উৎপাদনে তার চেয়ে এদেশে অনেক কম। দেশের আর্থিক সঙ্কট এখানেই। যদি গত ২০২৩ সালের শেষ তিন মাসের দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারের পরিসংখ্যান দেখি তা হলে এরকম চিত্রই পাই যে, দেশের শিল্পে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমছে।
কর্মসংস্থান হয় এরকম একটি ক্ষেত্র হলো বয়নশিল্প বা টেক্সটাইল। এখানে উৎপাদন কমে গেছে ২০%। কম্পিউটার, ইলেক্ট্রনিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে উৎপাদন কমে গেছে ১৫ শতাংশ এই “ডিজিটাল”দেশে। কৃষি এবং কৃষির সঙ্গে যুক্ত ক্ষেত্রগুলির বৃদ্ধির হার ২% এরও কম। অথচ মরিয়া হয়ে দেশের মানুষের ৬১.৫% তাঁদের আয়ের জন্য কৃষি এবং কৃষির সঙ্গে যুক্ত ক্ষেত্রগুলির উপর নির্ভর করে। তাহলে এখানেও “বিকাশ”কে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে কি হয়েছে? গত ৯ মাস ধরে একটানা দেশের রপ্তানি কমে এসেছে । আমদানিও কমে এসেছে। তাহলে বৈদেশিক বাণিজ্য থেকেও দেশের কোনও আর্থিক সুবিধা হওয়ার পথ খোলা নাই। এই যে নয়া উদারীকরণের দিন থেকে ঢালাও দেশের দরজা খোলা হল, বিশ্ব আর্থিক সঙ্কট, কোভিড অতিমারীর পর তাবড় তাবড় ধনী দেশ সকলে নিজের দেশের মানুষের ভালো চেয়ে দেশের উৎপাদনের ভিত্তি, বিশেষ করে শিল্পের ভিত্তিকে শক্ত করার জন্য বিশ্বায়নের খোলা দরজা নীতি প্রায় ত্যাগ করেছে বলা যায়।
তাই আমাদের দেশের মত দেশ, যেখানে সরকার নিজের দেশের মানব সম্পদকে রক্ষা করে না, তাদের অবস্থা তো করুণ হবেই। তাই বৈদেশিক বাণিজ্যেও“বিকাশ”খুঁজে পাওয়া গেল না।
মোদী সরকার তো বেসরকারিকরণের মন্ত্র নিয়ে এই “বিকাশ”এর পথ খুলছিল বলে বলেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে বেসরকারি বিনিয়োগ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে ১৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে কমে ২ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বিদেশি বিনিয়োগ নিয়ে মোদী সরকার অনেক গর্ব করলেও বিদেশি বিনিয়োগও কমে গেছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে মোট বিদেশি বিনিয়োগ ২০২২ সালের তুলনায় ৪ শতাংশ কমে গেছে। বিনিয়োগ কমে গেলে আর্থিক উন্নতি হবে কোথা থেকে। বাজেট প্রকাশের সময়ে তো সরকারি বিনিয়োগ বছর বছর কমিয়ে দিয়েছে সরকার। বিনিয়োগ তো আর্থিক বৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি। সরকারি বা বেসরকারি বিনিয়োগ ছাড়া বিশ্বে কোনও দেশ উন্নতি করেছে? এ তো অসম্ভব।
ম্যানুফ্যাকচারিং বা কারখানা জাত শিল্পের উৎপাদন, খনিজ পণ্য, বিদ্যুৎ উৎপাদন এসব ক্ষেত্রে গতি না আসলে, তথ্য কারচুপি বা নানাভাবে পরিসংখ্যানের মারপ্যাঁচে “বিকাশ”এর অঙ্ক দেখানো যায়, কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০২৪ সালের জানুয়ারি মাসে ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পে অর্থাৎ কল-কারখানায় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৩.২%। এরকমই রয়ে গেছে গত কয়েক মাস। বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ৫.৬%। এখানেও এরকমই রয়ে গেছে গত কয়েক মাস। এখনও শিল্পে কল-কারখানায় উৎপাদনের অংশ ৭৭%।
তাই আমরা নতুন অনেক ধরনের ক্ষেত্র যেমন প্ল্যাটফর্ম, ডিজিটাল ইত্যাদি ক্ষেত্র দেখতে পেলেও এদেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি কৃষি এবং কল-কারখানাকে বাদ দিলে বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়। তাই এই দেশে অনেক শ্রমশক্তি রয়েছে, তাকে ব্যবহার করার কোনও উপায় নেই।আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা জানাচ্ছে যে এদেশে স্নাতকদের ৫২.৮% এবং স্নাতকোত্তরদের ২৭.২% ২০২২ সালে দেখা গেছে অদক্ষ শ্রমিক হিসাবে কায়িক শ্রমিক হিসাবে কাজ করছেন। এই পরিসংখ্যান কিন্তু শুধু গত কয়েক মাসের কথা নয়। এরকম গতি প্রকৃতি মোদী সরকারের জমানায় চলে আসছিল। শিল্প কারখানায় দেশে মোদী শাসনে ২০১৭ সালের পর থেকে ক্রমাগতই কমেছে। ২০১৭ সালে দেশে শিল্পকারখানায় নিযুক্ত ছিল ৫কোটি ১৩ লক্ষ শ্রমিক। ২০১৯ সালে তা কমে হল ৪ কোটি ৬ লক্ষ। এরকমই চেহারা মোদীর বিজ্ঞাপনের “বিকাশ”এর। আমাদের দেশে রপ্তানি কমে এসেছে দ্রুত হারে। ২০১৩-১৪ সালে মোট জাতীয় উৎপাদনের ২৫% ছিল রপ্তানি। ২০২২-২৩ সালে তা নেমে এসেছে ২২.৮% এ। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যে ঘাটতি রেকর্ড মাত্রা ছুঁয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর মাসে। ঠিক এই সব কারণেই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজন এই “বিকাশ” এর প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুও বলেছেন যে “বিকাশ” যদি এত আর্থিক বৈষম্য সৃষ্টি করে তা নিয়ে নতুন করে ভাবনা প্রয়োজন। আসলে দেশের ভোগব্যয় নিয়ে যে সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বেড়িয়েছে দেশের পরিসংখ্যান দপ্তর থেকে তা দেখিয়ে দিয়েছে যে দেশের মানুষের ভোগব্যয় কমে যাচ্ছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই। মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া । কোনোভাবেই নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম কমানো যাচ্ছে না। চাহিদা না থাকলে, উৎপাদন বৃদ্ধি হবে কেন? এদেশে রপ্তানি কমছে, বহির্বিশ্বে দেশের উৎপাদনের চাহিদা কমছে, দেশের ভিতরে দেশের মানুষের চাহিদা কমছে। তাহলে “বিকাশ”বা উৎপাদনে গতি আসবে কোথা থেকে?
দেশে বেড়েছে আর্থিক বৈষম্য মারাত্মক হারে। বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তিদের মধ্যে স্থান করেছে ভারতীয় মানুষ। ওয়ার্ল্ড ইনিক্যুয়ালিটি ল্যাব রিপোর্ট বা বিশ্ব বৈষম্য পরিমাপের রিপোর্ট কিছুদিন আগেই জানিয়েছে যে দেশের ধনীতম ১% মানুষের হাতে দেশের সম্পদের ২২.৬% ভাগ। দেশের ধনীতম ১০%এর হাতে রয়েছে সম্পদের ৫৭.৬%। তাহলে “ বিকাশ” দেশের সাধারণ মানুষের চোখে দেখতে পাওয়া যাবে কি করে? “বিকাশ”তো কয়েকজন কোটিপতির “বিকাশ”, “বিকাশ”তো তাঁদের যারা নির্বাচনী বন্ড কিনে মোদী সরকারকে গদিতে রেখে দিয়েছে। এই এত বড় দুর্নীতি, কর্পোরেটদের বছর বছর কর মকুব করা তো দেশের সম্পদের একটা বড় অংশ দেশের আর্থিক উন্নতি থেকে সরিয়ে ফেলা। অর্থাৎ প্রকৃত অর্থে আর্থিক বিকাশকে পিছিয়ে দেওয়া, শ্লথ করার সব রকম চেষ্টা করেছে মোদী সরকার। তাই “বিকাশ” সাদা চোখে খুঁজে পাওয়া যায় না, “বিকাশ” সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকায় কোনও লাভ হয় না। মোদী সরকারের বিজ্ঞাপনে যা আমরা পাই, তার সাথে দেশের অর্থনীতির মৌলিক ভিত্তির কোনও যোগাযোগ নেই।
কর্মসংস্থান হয় এরকম একটি ক্ষেত্র হল বয়নশিল্প বা টেক্সটাইল। এখানে উৎপাদন কমে গেছে ২০%। কম্পুটার, ইলেক্ট্রনিক ইত্যাদি ক্ষেত্রে উৎপাদন কমে গেছে ১৫ শতাংশ এই “ডিজিটাল”দেশে। কৃষি এবং কৃষির সঙ্গে যুক্ত ক্ষেত্রগুলির বৃদ্ধির হার ২% এরও কম।
মোদী সরকার তো বেসরকারীকরণের মন্ত্র নিয়ে এই “বিকাশ”এর পথ খুলছিল বলে বলেছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে যে বেসরকারী বিনিয়োগ ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারী মাস থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের মধ্যে ১৪ লক্ষ কোটি টাকা থেকে কমে ২ লক্ষ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। বিদেশী বিনিয়োগ নিয়ে মোদী সরকার অনেক গর্ব করলেও বিদেশী বিনিয়োগও কমে গেছে। ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে নভেম্বর মাসের মধ্যে মোট বিদেশী বিনিয়োগ ২০২২ সালের তুলনায় ৪ শতাংশ কমে গেছে।
Comments :0