Post Editorial

বেকারি বিরোধী দিবসে শপথ নাও, বেকার বিরোধী সরকার পালটে দাও

উত্তর সম্পাদকীয়​


সৈনিক শূর

১৯৭৩ থেকে ২০২৪ পাঁচ দশক পেরিয়ে যাওয়ার পরেও বেকারত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পায়নি গোটা দেশ। ১৯৭৩ সালের ২৮ মার্চ কলকাতার রাস্তায় সমস্ত বামপন্থী সংগঠনগুলোর ডাকে বেকারি বিরোধী দিবস পালনের মধ্যে দিয়ে প্রথম কাজের দাবি এবং কাজ দিতে না পারলে বেকার ভাতা দেওয়ার দাবি যে লড়াইয়ের ইতিহাস তৈরি করেছিল, সেই লড়াই এই সময়ে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন আরও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
২০২৪ সালের ২৮ মার্চ বেকারি বিরোধী দিবস তাই, বেকার বিরোধী সরকারকে উৎখাত করার লড়াইয়ের ডাক দিচ্ছে। গত ৫০ বছরের মধ্যে বেকারত্বের হারে সর্বোচ্চ জায়গায় আজ আমাদের দেশ, যখন দেশের জনসংখ্যার ৬০ শতাংশই যুব।
স্থায়ী কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণাক্লিষ্ট তরুণদের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রতিদিন প্রতিনিয়ত হিংসা এবং ঘৃণা দ্বারা পরিচালনা করার প্রকল্প খুব পরিকল্পিতভাবেই তৈরি করেছে মোদীর সরকার। মোদী গ্যারান্টি’র নাম করে আসলে গ্যারান্টেড হয়েছে বেকারত্ব। মোদী গ্যারান্টি’র নাম করে আসলে গ্যারান্টেড হয়েছে পরিযায়ী শ্রমিকের যন্ত্রণা। 
শহরাঞ্চলে প্রতি ১০ জনে ১ জন করে বেকার। আবার যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন, কাজের অনিশ্চয়তা তাঁদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সমগ্র বিশ্বজুড়েই আজ ছদ্ম বেকারত্ব (disguised unemployment) বেড়েই চলেছে। এই  ছদ্ম বেকারত্ব শব্দটা অর্থাৎ যে কাজ যার পাওয়ার কথা, সেই কাজ না পেয়ে অনেক কম মজুরিতে অস্থায়ী ভিত্তিতে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে দেশের যুবসমাজ। মেধার ভিত্তিতে কাজের সুযোগ থাকছে না। কোনও কাজই ছোট নয়, কিন্তু মাস্টার ডিগ্রি পাশ করা যুবক-যুবতী’র ডেলিভারি বয় বা দিন মজুরের কাজ করার মানেই হলো ছদ্ম বেকারত্ব, অর্থাৎ যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ বা মজুরি তাঁরা পাচ্ছেন না। এদের কাজের নিশ্চয়তাও থাকে না। অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষারও কার্যত এদের নেই। CMIE’র রিপোর্ট বলছে, শহরে বেকারত্বের হার ২০২৩-২০২৪ সালে ৮.১ শতাংশে পৌঁছেছে আর মহিলাদের মধ্যে ১৫ শতাংশ। ১৮-২৪ বছর বয়সিদের মধ্যে ৪৪.৪৯ শতাংশ বেকার। 
অথচ আমাদের দেশে তরুণ প্রজন্মের সংখ্যা গোটা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। জনসংখ্যার ৬৪ শতাংশই কর্মক্ষম, যে সুবিধা পৃথিবীর অন্য কোনও দেশের নেই। দেশের জনসংখ্যার অধিকাংশ যুব বয়সি, স্বাভাবিকভাবেই কর্মসংস্থানের গ্যারান্টিই দেশের উন্নতির গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠি হওয়ার কথা। কিন্তু মোদী’র আমলে কর্মসংস্থান সম্পর্কে সরকার সব দায়দায়িত্বই নিজেদের ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে কর্পোরেটদের মুনাফার স্বার্থে। স্থায়ী কাজের সুযোগ কমছে রোজ। স্থায়ী সরকারি কর্মচারীদেরও কাজের সময় নির্দিষ্ট থাকছে না। এখানেও কম বেতনে বেশি সময় কাজ করাতে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ বাড়ছে, প্রচুর শূন্যপদ থাকা সত্ত্বেও। অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন ৯৩ শতাংশ মানুষ, তাদের কাজের কিংবা মজুরির কোনও গ্যারান্টি নেই। ছাঁটাইয়ের পরিমাণ বেড়েছে এই ক'বছরে বহুগুণ। সরকার কোনও ইতিবাচক ভূমিকা না নিয়ে শ্রম কোড চালু করে শ্রমিক-কর্মচারী বিরোধী অবস্থানকেই প্রতিফলিত করছে গত কয়েক বছর ধরে। এই অনিশ্চয়তার মধ্যে গোটা যুবসমাজকে ধীরে ধীরে বেঁধে ফেলতে চাইছে মোদী’র সরকার
কাজ না পাওয়ার যন্ত্রণা কিংবা স্থায়ী কাজ না থাকার দুশ্চিন্তাকে সুপরিকল্পিত ভাবে হিংসা-বিদ্বেষ-ঘৃণায় পর্যবসিত করছে বিভেদকামী আরএসএস-বিজেপি। গোটা দেশের যুবসমাজকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব কাজের দাবিতে লড়াই আরও জোরদার করার মাধ্যমেই। এখন দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বাঁচানোর ডাক দেওয়ার সময়। এবারের বেকারি বিরোধী দিবস থেকে বেকার বিরোধী সরকারকে উৎখাত করার ডাক ছড়িয়ে দেওয়ার শপথ নিতে হবে যুবসমাজকে।
যে সরকার গোটা দেশে ইতিহাসকে বদলে দিতে চাইছে, বিজ্ঞান চেতনা, বিজ্ঞানের বোধকে একটু একটু করে ভেঙে সমস্ত কুযুক্তি-কুসংস্কার-অপবিজ্ঞানকে প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে, তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা যুবসমাজের কাছে পৌঁছে দেওয়াই আজ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। যাদের হাতে কাজের নিয়োগ পত্র থাকার কথা তাদের জাতি-ধর্ম-ভাষা-খাদ্যাভ্যাস-সংস্কৃতির ভিন্নতার ভিত্তিতে লড়িয়ে দেওয়ার জন্য তাদের হাতে অস্ত্র ধরিয়ে পরিকল্পিতভাবে হিংসা এবং ঘৃণাকে সংগঠিত করছে আরএসএস-বিজেপি। হিংসা এবং ঘৃণার মাধ্যমে আসলে যুব সমাজের রুটি-রুজির মৌলিক দাবি থেকে যুবসমাজকে একটু একটু করে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত আরএসএস-বিজেপি। 
একদিকে গোটা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে জলের দরে বেসরকারি কোম্পানিগুলোর কাছে বিক্রি করে দেওয়া, আম্বানি আদানির মতন কর্পোরেটদের গোটা দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে গিলে খাওয়ার ব্লুপ্রিন্ট তৈরি করা হচ্ছে। অপরদিকে সরকারি চাকরি অথবা স্থায়ী চাকরির ধারণাকেই ভুলিয়ে দিতে চাইছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। সে কারণেই অন্যান্য নানান পদ্ধতিতে যুব সমাজকে কর্মসংস্থানের অধিকারের লড়াই থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। ডিওয়াইএফএই তার জন্মলগ্ন থেকেই কাজকে সংবিধানে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি নিয়ে সারাবছর লড়াই আন্দোলন করে থাকে। 
দেশের সংবিধানকে ভাঙার জন্য, সংবিধানের ঐক্যবদ্ধ ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে ভাঙার জন্য আরএসএস-বিজেপি প্রতিনিয়ত এই পরিকল্পনায় লিপ্ত রয়েছে। তাই এবারের বেকারি বিরোধী দিবস যেরকম কাজের দাবির লড়াইকে জোরদার করতে শপথ নেবে, তার সাথেই আমাদের এতদিন ধরে বেড়ে ওঠা সযত্নলালিত সংস্কৃতি, দীর্ঘ ঐতিহ্যময় সম্প্রীতি, সকলের একসাথে বাঁচার ভাবনাকে বাঁচিয়ে রাখতে ‘রুটি-কাপড়া-মকান’-এর বিকল্প স্লোগান হাজির করবে। আমাদের ভাবনাচিন্তার গোড়ায় আঘাত করতে চাইছে ফ্যাসিবাদ। দেশের বৈচিত্রপূর্ণ সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে প্রতিনিয়ত ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য নানারকম প্রকল্প তৈরি হয়েছে। সেটা কখনো ঘৃণা-হিংসার কথা দিয়ে গান তৈরি করে, আবার কখনো প্রতি মুহুর্তে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা কিংবা দেশের ইতিহাসের বিকৃতির মাধ্যমে। দেশকে বাঁচানোর লড়াই মানে- এতদিন ধরে গড়ে ওঠা ভাবনা চিন্তা, যেখানে মানুষে মানুষে ভাগাভাগি নেই, ঘৃণা নেই , হিংসা নেই- সেই দেশকে রক্ষা করা। আমাদের ভবিষ্যৎকে বাঁচানোর জন্য এই বেকারি বিরোধী দিবসের শপথ হোক, বেকার বিরোধী সরকারকে  দেশ থেকে উৎখাত করার। 
আরএসএস-বিজেপি’র বিভাজনের রাজনীতি ঠিক ব্রিটিশ কায়দাতেই divide and rule নীতিকেই প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা। এর উলটোদিকে দাঁড়িয়ে যুবসমাজ প্রতিদিন লড়ছে এবং এ লড়াই লড়তে হবে, যূথবদ্ধ ভাবনাকে আরও শক্তিশালী করার জন্য; সম্প্রীতি ভালোবাসার ঐতিহ্যকে আরও বেশি করে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই। এটাই আসলে আমাদের দেশের ইতিহাসের পরতে পরতে রয়েছে। আমরা কখনোই আমাদের দেশের, সমাজের কোনও কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড়, অভিনেতা বা সাধারণ মানুষকে তাঁর ধর্ম দিয়ে চিনি না, চিনি তাঁর কাজ দিয়ে। আরএসএস-বিজেপি তাকে ধর্ম দিয়ে চেনার কথা বলে। আমরা আমাদের আশেপাশের মানুষকে তার মানবতার গুণ দিয়ে চিনে থাকি, বিজেপি চাইছে সবটাই ধর্ম-জাত দিয়ে চেনাতে। 
এই সরকার দুর্নীতি নামক শব্দটাকে রাজনীতি শব্দের সাথে সমার্থক করে দিয়েছে। তৃণমূল এবং বিজেপি এই দুই শক্তিই দুর্নীতির অতল গভীরে নিয়ে গেছে রাজ্য আর দেশকে। এ রাজ্যে গত ১২ বছর ধরেই নতুন কলকারখানা হচ্ছে না। কাজের সুযোগ না থাকা পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা বাড়াচ্ছে বছর বছর। দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে তৃণমূল আর বিজেপি যুবসমাজকে ধ্বংসের মুখে দাঁড় করাচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পে ব্যয় বরাদ্দ কমিয়েছে কেন্দ্র, আর বরাদ্দকৃত প্রকল্পের টাকা চুরি করে ফাঁক করে কাজের সুযোগ আরও সঙ্কুচিত করছে তৃণমূল সরকার। ১০০ দিনের প্রকল্পে বরাদ্দ কমিয়েছে বিজেপি, আর যে টাকা আসছে তাতেও চুরির ভাগ বসিয়ে মজুরি এবং কাজের সুযোগে হাত বসিয়েছে তৃণমূল। বেকার যুবক-যুবতীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে পাঠিয়ে, তাদের প্রাপ্য চাকরি অন্যদের বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা লুটেছে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা।
আত্মকেন্দ্রিক মানসিকতাকে মজ্জায় মজ্জায় ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে অতি দক্ষিণপন্থীরা। আঘাত হানার চেষ্টা করছে মস্তিষ্কে। মস্তিষ্কে আঘাত হানলে তার উলটোদিকে দাঁড়িয়ে মতাদর্শে শান দেওয়া এই বেকারি বিরোধী দিবসের শপথ হোক। আরএসএস-বিজেপি মানুষকে টুকরো টুকরো করে শাসন করতে চাইছে। মন্দির মসজিদ গির্জায় টুকরো করতে করতে এখন পাড়া মহল্লা এমনকি স্কুলের বেঞ্চেও মানুষকে টুকরো করার খেলায় মেতেছে এরা। এই টুকরো করার প্রয়াসের বিরুদ্ধে যূথবদ্ধতার অনুশীলনে আরও নিবিড় হওয়ার শপথ নেওয়ার কাজ জরুরি, সারা বছর ধরেই। 
এই দেশটার চরিত্র কেমন থাকবে, আমাদের চারপাশ যেমন আমরা দেখে এসেছি এতদিন তেমনটা থাকবে, নাকি গোটাটাই বদলে গিয়ে 'ডিটেনশন ক্যাম্প' হবে, তা ঠিক করতে হবে আমাদের। আমাদের দেশ, আমাদের সংস্কৃতি, স্কুল-কলেজ, বহুত্ববাদ ইত্যাদিকে বাঁচিয়ে রাখতে হাতে হাত রেখে লড়াইয়ের আহ্বানকেই শক্তিশালী করতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, লালন, কবীর যাঁরা গান কবিতায় সম্প্রীতি-ভালোবাসা-মানবতা-বহুত্ববাদের কথা বলেছেন, তাঁদের ভাবনা কিংবা ভগৎ সিং, মাস্টারদার স্বপ্নকে বাঁচাতে হলে, ফ্যাসিস্ত শক্তির হাত থেকে এদেশের ইতিহাস-সংস্কৃতিকে বাঁচাতেই হবে আমাদের। সম্প্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদ, রুটি-রুজির লড়াইয়ে যুবসমাজকে উৎসাহিত করার ঐতিহাসিক দলিল হয়ে থাকুক এবারের বেকারি বিরোধী দিবস। দেশ বেচার কারবারিদের বিরুদ্ধে দেশ বাঁচানোর ঠিকানা হয়ে থাকুক ইনসাফের লড়াই।
 

Comments :0

Login to leave a comment