attack on Buddha statue and monks

বদায়ুঁতে বুদ্ধমূর্তি, ভিক্ষুদের উপরে হামলা হিন্দুত্ববাদীদের

জাতীয়

মসজিদে মসজিদে হিন্দুত্ববাদীদের মন্দির খোঁজার প্রক্রিয়ার মধ্যেই এবারে বৌদ্ধ স্তূপ এবং ভিক্ষুদের উপরে আক্রমণ শুরু হয়ে গেল উত্তর প্রদেশে। বদায়ুঁতে বজরঙ দলের কর্মীরা সম্রাট অশোক বৌদ্ধ বিহার পর্যটন স্থলে হামলা চালায় কয়েকদিন আগে। সেখানে বুদ্ধের মূর্তি, শিলালিপি ভাঙচুর করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বৌদ্ধভিক্ষু বিকাস দীপ। দেওয়ালে বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক লেখাও গেরুয়া রং দিয়ে মুছে দেওয়া হয়। বসবাসকারী চার জন বৌদ্ধভিক্ষুকেও মারধর করে বের করে দেয় আরএসএস’র শাখা সংগঠন বজরঙ দল। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত প্রকাশ্য সমাবেশে সম্প্রীতির কথা বলছেন, আর তাঁর সংগঠনের লোকেরা সংখ্যালঘুদের উপরে হামলা করছে। অখিলেশ যাদব এদিন ফিরোজাবাদের এক সভা থেকে বিজেপি-কে তীব্র আক্রমণ করে বলেছেন, এই খননকারীরা ভারতের সৌহার্দ্যের খনন করছে। খোঁড়াখুঁড়ি করে কোনও সমাধান মিলবে না। বিজেপি নেতাদের ঘর খুঁড়লেও কিছু না কিছু পাওয়া যাবে। উল্লেখ্য, বদায়ুঁর শাহী জামা মসজিদে মন্দিরের দাবি তুলে এএসআই সমীক্ষার দাবি জানানো হয়েছে। 
মুসলিম, খ্রিস্টানদের পরে বৌদ্ধরাও আক্রান্ত হিন্দুত্ববাদীদের হাতে। বদায়ুঁর বৌদ্ধ বিহারে হিন্দুত্ববাদীদের হামলা নিয়ে উত্তর প্রদেশের জেলায় জেলায় বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা। সমাজবাদী পার্টি সরাসরি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদব সেই সব ছবি দিয়ে টুইট করেন। শুক্রবার সমাজবাদী পার্টির চার সাংসদ ধর্মেন্দ্র যাদব, আদিত্য যাদব, নীরজ মৌর্য এবং দেবেশ শাক্য এই নিয়ে প্রতিবাদ পত্র জমা দেন সংসদীয় মন্ত্রী কিরেন রিজেজুকে। উত্তর প্রদেশে তফসিলি জাতি এবং ওবিসিদের মধ্যে মৌর্য, শাক্য, সৈনিদের বড় অংশের মধ্যে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব আছে। জাতপাতের হিসাবে বিরাট অংশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠার আশঙ্কায় শেষ পর্যন্ত রবিবার যোগী প্রশাসন বৌদ্ধভিক্ষুদের বিহারে প্রবেশ করতে দিয়েছে। যদিও বজরঙ দল এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সেখানে গিয়ে ‘জলাভিষেক’ করেছে। সংঘাত জিইয়ে রাখতে সেখানে ২১দিন ধরে হনুমান চালিশা পাঠ করা হবে বলে ঘোষণা করেছে হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। বৌদ্ধভিক্ষুদের সেখান থেকে তাড়ানোর দাবিতেও অনড় আছে আরএসএসের দুই শাখা সংগঠন বজরং দল এবং ভিএইচপি। 
বদায়ুঁ জেলা সদর থেকে চার কিলোমিটার দূরে দাতাগঞ্জ সড়কে মাঝিয়া গ্রাম। এই গ্রামেই সম্রাট অশোক বৌদ্ধ বিহার পর্যটন স্থল। ৫৪ বিঘা জমিতে একটি সরোবর থাকায় একে সূরজ কুণ্ডও বলা হয়। পাঁচটি প্রাচীন স্তূপ আছে। ৮৪টি মঠও আছে। যার অধিকাংশ জীর্ণ হয়ে ভেঙে পড়েছে। কয়েকটি অবশিষ্ট আছে। ২০১৬ সালে অখিলেশ যাদবের সরকার এই বৌদ্ধ বিহারের চারপাশের পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেয় এবং সৌন্দর্যকরণের কাজও হয়। পরিসরের মধ্যে গৌতম বুদ্ধ এবং ভীমরাও আম্বেদকরের মূর্তি আছে। স্থানীয়দের বক্তব্য অনুযায়ী, এখানে আগে একটি বিশাল অশ্বত্থ গাছ ছিল। যার তলায় বসেই বুদ্ধ উপদেশ দিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়। সেই গাছটি ঝড়ে পড়ে যাওয়ার পরে সেখানেই আরেকটি অশ্বত্থ গাছ লাগানো হয়। সেই গাছের নিচেই এখন দুটি পাথরের মত বস্তু রেখে এখন হিন্দুত্ববাদীরা দাবি করছে ওই গুলি শিবলিঙ্গ এবং পাশে একটি গর্ত দেখিয়ে বলেছে সেখানে এইগুলি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। 
বজরঙ দলের জেলা আহ্বায়ক উজ্জ্বল গুপ্তা বলেছেন, ‘‘বনবাসের সময়ে রাম এখানেই ছিলেন। সূরজ কুণ্ড ভগবান রামের বনবাস কেন্দ্র। এখানে যজ্ঞশালা আছে। বেদও পড়ানো হতো। এখন দুষ্কৃতীরা যাঁরা নিজেদের বৌদ্ধ বলে, ওই জায়গায় বৌদ্ধ বিহার বানিয়ে নিয়েছে। ধীরে ধীরে পুরো জায়গার দখল নিয়ে নিয়েছে।’’ বজরং দল নেতার দাবি, বৌদ্ধভিক্ষুরা গ্রামবাসীদের ভয় দেখিয়েই নাকি ওই এলাকার দখল নিয়েছে। বৌদ্ধভিক্ষুদের বিরুদ্ধে গাঁজা, চরস খাওয়ার অভিযোগ করেছেন বজরং দল নেতা। তাঁর অভিযোগ, বৌদ্ধরা বড় বড় শিবলিঙ্গ, নন্দী মহারাজের মূর্তি একটি সিঁড়ির চার-পাঁচ ফুট নিচে চাপা দিয়ে দিয়েছে। আমরা এই খবর জেনে এখানে এসে খোঁড়াখুঁড়ি করে শিবলিঙ্গ, হনুমান, নন্দীর মূর্তি পাওয়া গেছে। বৌদ্ধভিক্ষুদের সেখান থেকে তাড়ানোর দাবিও করেছেন তিনি। 
বিপরীতে বৌদ্ধভিক্ষু বিকাস দীপ জানিয়েছেন, এখানে ভগবান বুদ্ধ এসেছিলেন এবং এক বছর ছিলেন। একটি বড় অশ্বত্থ গাছের তলায় বসে উপদেশ দিয়েছিলেন। চীনা পরিব্রাজক ফা হিয়েনের বিবরণেও এই জায়গার কথা আছে। ভগবনা বুদ্ধ এখানে মঝয়ম নিকায়ের উপদেশ দিয়েছিলেন, তাই এই গ্রামের নাম মঝিয়া। এর পাশের গ্রামের নাম বুদ্ধাই। সেই সময়ে বদায়ুঁর নাম ছিল রাজা গড়। বিকাস দীপ বলেছেন, ‘‘৭ ডিসেম্বর এক পুলিশ ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে এই বৌদ্ধ বিহারে হামলা করে আরএসএস-বজরঙ দলের লোকেরা। তারা দাবি করে এখান থেকে শঙ্করজী, নন্দীজী বেরিয়েছেন। কিন্তু এখানে কিছু ছিলই না। আরএসএস’র লোকেরা এখানের দখল নিতে চাইছে। পুলিশ ইন্সপেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে এসে এখানের বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বন্দি করে নেওয়া হয়। বিহারের ভেতরে বুদ্ধের মূর্তিতে আঘাত করা হয়। সমস্ত কাগজপত্র ছিঁড়ে ফেলা হয়।’’ বিকাস দীপ বলেন, আমরা কারোকে এখানে পুজো দেওয়ার জন্য বাধা দিইনি। কিন্তু হিন্দু সংগঠনগুলি যাকে শিবলিঙ্গ বলছে, সেটা শুকিয়ে যাওয়া সিমেন্টের স্তম্ভ। বস্তায় পড়ে থেকে সিমেন্ট শুকিয়ে পাথরের মতো হয়ে গেছে। এখন সেটাকে শিবলিঙ্গ বলে দাবি করা হচ্ছে। বদায়ুঁর সাংসদ আদিত্য যাদব বলেছেন, একাদশ শতাব্দীতে রাজা মহিপাল ওই স্থান বানিয়ে ছিলেন। নথিপত্রেও তার প্রমাণ আছে। 
এই ঘটনার পরে বৌদ্ধদের বিক্ষোভের মুখে কেন্দ্র-রাজ্যের বিজেপি সরকার বেকায়দায় পড়ে। লোকসভা ভোটে সংবিধান বদলের স্লোগানের জেরে তফসিলি জাতির ভোট বিজেপি থেকে সরে যায়। ওবিসিদের মধ্যেও ছোট ছোট অংশগুলি সরে যায় এবং অখিলেশ যাদব ঘোষিত পিডিএ বড় সাফল্য লাভ করে। এই অংশের মধ্যে বুদ্ধ-আম্বেদকর-কাঁসিরামের প্রভাব আছে। এরপর থেকে আদিত্যনাথ বাঁটেঙ্গে-কাটেঙ্গে স্লোগান দিয়ে ‘হিন্দু ঐক্য’র ডাক দেয়। হিন্দুত্ববাদীরা মসজিদে মসজিদে হিন্দু মন্দির খুঁজতে শুরু করে দেয়। নিম্ন আদালতগুলিতে মামলার পরে মামলা হতে থাকে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ছড়ায়। সম্ভলে পাঁচ জনকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। মোদী-যোগী এই সময়ে বৌদ্ধদের নিজেদের দিকে টানতে চেষ্টা করে যান। কিন্তু সঙ্ঘের আদর্শ অনুযায়ী মসজিদের মতই বৌদ্ধ বিহারেও মন্দির এবং শিবলিঙ্গের খোঁজ শুরু হয়ে গেছে বজরঙ দল, ভিএইচপি’র মতো সংগঠনের।

Comments :0

Login to leave a comment