Bengal Floods

বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই ফের দুর্যোগের আশঙ্কা

রাজ্য জেলা

আরামবাগের মায়াপুর মাঠে জলের তলায় ডুবে রয়েছে আমন ধানের মাঠ। ছবি -অনন্ত সাঁতরা।

বিগত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি এবং ডিভিসি জল ছাড়ার কারণে পশ্চিমবঙ্গের একাধিক জেলায় বন্যা পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের বহু গ্রাম জলের তলায়। আমতা ২ নম্বর ব্লকের পাঁচটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা এখনও জলমগ্ন। বন্যা পরিস্থিতির এখনও উন্নতি হয়নি হুগলিতে। প্লাবিত  জেলার বহু এলাকা। বন্যার জলে ভেঙেছে ঘরবাড়ি। রয়েছে পানীয় জলের সমস্যা। জটিল আকার নিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বন্যা পরিস্থিতি। বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুরে কংসাবতী জলাধার থেকে জলছাড়ায় একাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেতু জলের তলায়। দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে ছাড়া জলে বড়জোড়া ও সোনামুখী ব্লকে মানাচর এলাকায় বন্যা পরিস্হিতি তৈরি হয়েছে। মুর্শিদাবাদের বহরমপুর ব্লক’ও বন্যা কবলিত। সাঁটুই চৌরিগাছা পঞ্চায়েতের হটনগর, কাঁঠালিয়া, সন্তোষনগর সহ একাধিক গ্রাম প্লাবিত। 
বিহারে গঙ্গা ও অন্যান্য নদীর জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় একাধিক এলাকা জলমগ্ন। প্রায় বন্যা পরিস্থিতি বহু জেলায়। জানা গেছে, সুলতানগঞ্জ ও রতনপুর স্টেশনের মাঝে রেললাইন ডুবে যাওয়ায় জামালপুর-ভাগলপুর সেকশনে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে একাধিক ট্রেন। রেল সূত্রে জানা গেছে, সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসাবে বেশ কিছু ট্রেনকে অন্যপথে ঘুরিয়েও দেওয়া হয়েছে।
নিকাশির একটিই সুইলিস গেট। তা খোলা হয়নি এখনও। অথচ তিনদিন ধরে বুক সমান জলে ডুবে রয়েছে পশ্চিম নেকড়া সহ সংলগ্ন বিস্তীর্ণ এলাকা। কংসাবতীর বাঁধ বিভিন্ন জায়গায় ভেঙেছে। ফলে পৌর ও গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা প্লাবিত হয়েছে পাঁশকুড়ায়। যেমন জানাতে বাঁধ ভেঙে পুরসভা এলাকার অধিকাংশ প্লাবিত হয়। আবার গোবিন্দনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের মানুরে বাঁধ ভেঙে জয়কৃষ্ণপুর, পশ্চিম নেকড়া, মঙ্গলদাঁড়ি, কয়া, ধনঞ্জয়পুর, রানিয়াড়া জলে ডুবে রয়েছে। এই গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকা গুলির জল নামছে না। একমাত্র নিকাশি ঘোষণার গ্রাম পঞ্চায়েতের গোটপাতা এলাকায় ক্ষীরাই নদীর উপর সুইলিস গেট। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ সেই সুইলিস গেট বন্ধ করে রাখা হয়েছে। কেন নিকাশির এই নালার গেট প্রশাসন খুলে দিচ্ছেনা? বানভাসী এলাকা থেকে দ্রুত জল নিস্কাশনের বন্দোবস্ত প্রশাসন করছে না? এই প্রশ্ন উঠছে। দিন দুই ধরেই দাবি জানানো হচ্ছে ব্লক প্রশাসনের কাছে। কিন্তু নিকাশির সুইলিস গেট খুলে জল নিষ্কাশনের কাজ হচ্ছেনা। রবিবার বানভাসী মানুষজন পশ্চিম নেকড়াতে রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভে সামিল হয়। পুলিশ ও ব্লক প্রশাসনের গাড়ি আটকে বিক্ষোভ চলে দীর্ঘক্ষণ ধরে।
এদিকে জাতীয় সড়ক সংলগ্ন পাঁশকুড়ার বিস্তীর্ণ এলাকার বন্যা পরিস্থিতি আগের মতোই রয়েছে। জল অত্যন্ত ধীরে ধীরে কমছে। গ্রাম পঞ্চায়েত গুলি কোথাও কোমর সমান আবার কোথাও এক মানুষ প্রমাণ জল দাঁড়িয়ে রয়েছে। কতদিনে জল কমবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় বন্যার্তরা। পশ্চিম নেকড়া, মঙ্গলদাঁড়িতে জাতীয় সড়ক জলমগ্ন।  বানভাসীরা সড়কের উপর বাস ব্রিজের উপরের আশ্রয় নিয়ে রয়েছে। জাতীয় সড়কের যে এলাকা জলমগ্ন নয় তার ধারে সারিবদ্ধভাবে আশ্রয় নিয়েছে কয়েকহাজার মানুষ। নিকাশি খাল নালা সংস্কার হয়নি দীর্ঘদিন ধরে। কবে সমস্যার সমাধান হবে বাড়ি কবে ফিরতে পারবেন সেই চিন্তায় কাটছে একটার পর একটা দিন।


পাঁশকুড়ার পশ্চিম নেকড়াতে বিক্ষোভ বন্যার্তদের। ছবি- রামশংকর চক্রবর্তী।

খানাকুল সহ আরামবাগ মহকুমার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখনো জলমগ্ন। খানাকুলে বানভাসি দুর্গতদের জন্য  ত্রাণের অভাব। সঙ্কট পাণীয় জলের। খানাকুলের মানুষ এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে বসবাস করছেন। জল কিছুটা  কমলেও বহু গ্রাম, রাস্তা ও কৃষি জমির মাঠ জলে ডুবে রয়েছে। ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নৌকা করে যোগাযোগ চলছে। ভিতরের গ্রাম ও পাড়া থেকে উঠে এসে রাস্তায় অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে অনেকেই। ইতিমধ্যেই এলাকায় পচা দুর্গন্ধ ছড়িয়েছে। সাপের উপদ্রবও বেড়েছে সর্বত্রই। এই রকম অবস্থায় প্রশাসনের কোন ভূমিকা নেই। নেই কোন নৌকার সুব্যবস্থা। রাজহাটির রামচন্দ্রপুর এলাকার মালিক পাড়ার অনেকেই বানভাসি হয়ে অপরের বাড়ির ছাদে আশ্রয় নিয়েছে। বানের জল ফুটিয়ে  খেয়ে কোন রকমের দিন কাটাচ্ছে। মজুত শুকনো খাবার খেয়ে দিন রাত কাটছে। নৌকোও পাওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তিগত নৌকার প্রচুর ভাড়া। রাজহাটিতে এখনো এক হাঁটু জল। শাবলসিংহ পুর জলমগ্ন। খানাকুল ২ নং ব্লকের নন্দনপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের জগদীশতলা বিভিন্ন সংস্থা বন্যা পীড়িত মানুষদের ত্রাণ সামগ্রী ও  খাওয়ানো ব্যবস্থা করেছেন। এখানে প্রাথমিক শিক্ষকরা রান্না খাবার দুর্গতদের জন্য ব্যবস্থা করেন। পরে ওই শিক্ষকরা নৌকা করে গ্রামে গ্রামে খাবার পৌঁছে দেন।  
এদিন ঘোষপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের সিপিআই(এম) প্রাক্তন প্রধান সৃষ্টিধর ধন মাধবকুন্ড গ্রামে বাড়ি, নৌকোয় করে যাবার সময় ১১০০০ ভোল্টের তার মাথায় লেগে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান। বন্যা কবলিত এলাকায় বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে যান সিপিআই(এম) নেতা ভাস্কর রায়, ভজহরি ভুঁইয়া, জাহাঙ্গীর আলম, নেপাল খাঁ সহ আরো অনেকে। তাঁরা মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। সর্বত্রই দেখা যাচ্ছে, মানুষ ও গবাদি পশু একসঙ্গে রাস্তার উপর কিংবা কারুর বাড়ির ছাদে বা নিজের বাড়ির ছাদে বসবাস করছেন।
অন্যদিকে আরামবাগ ব্লকের মায়াপুর সংলগ্ন বিস্তীর্ণ কৃষি বলয়ে আমন ধানের মাঠ ডুবে রয়েছে। এর ফলে ধান গাছে পচন ধরে নষ্ট হচ্ছে। এলাকার বাসিন্দারা জানালেন, জমা জল কোন ভাবেই কমছে। মাঠ সংলগ্ন বহু বাড়িতেজল জমে রয়েছে। মায়াপুর ১ পঞ্চায়েতের আদমবাঁধ, সচনিপাড়া, মায়াপুর, বাতানলের তেলুয়া, ভেলুয়া, মাধবপুরে ধরমপোঁতা, কৃষ্ণবল্লভপুর, হামিরাবাটী, মলয়পুর তালা সহ আশপাশের মাঠের ফসল জলের তলায় ডুবে রয়েছে।  এই এলাকায় আমন ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এছাড়া আরান্ডি - ২ ও হরিণখোলা ২ পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ২০০ একর সবজি ফসল ঝিঙে, পটল , বরবটি, করলা  নষ্ট হয়ে গেছে। পুরশুড়া ব্লকের তোকিপুরে বর্ষার বাদাম চাষ যা শীত মরসুমে বীজ হিসাবে ব্যবহার করা হয় , তার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। পটল সহ সব ধরনের সবজি ফসলের গোড়া পচে গিয়ে মাচায় এই সব গাছ শুকিয়ে গেছে। এই এলাকার পাকা আউশ ধানের প্রচুর ক্ষতি  হয়েছে। বন্যায় হাওড়া গ্রামীণ জেলার উদয়নারায়ণপুরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বিস্তীর্ণ এলাকা এখনও জলমগ্ন। অসংখ্য মানুষ গৃহহীন অবস্থায় রয়েছেন। রবিবার বন্যা পরিস্থিতি দেখতে উদয়নারায়নপুর যায় সিপিআই(এম) এক প্রতিনিধিদল। তারা উদয়নারায়নপুরের ডিহিভূরশুট, পিয়ারাপুর, গজা সহ বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শন ও ভয়াবহ বন্যা দুর্গত ও ব্যাপক ক্ষতিগ্ৰস্ত্র মানুষের সাথে কথা বলেন। প্রতিনিধিদলে ছিলেন সিপিআই( এম) হাওড়া জেলা কমিটির সম্পাদক দিলীপ ঘোষ, রাজ্য কমিটির সদস্য পরেশ পাল, সিপিআই(এম) নেতা জয়ন্ত মুখার্জী, ষষ্ঠী মাজী, হারাধন পাত্র, কার্তিক দলুই, বিপ্লব বেরা, জিত মুখার্জী, বিকাশ শাসমল, মৃত্যুঞ্জয় দলুই, রহিত দলুই, রাজু সিং, পঞ্চানন শাসমল সহ জেলা ও এরিয়া নেতৃত্ব।


ত্রান বিলি করছেন যুব কর্মীরা।

রাজ্যে বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেই নতুন করে ফের দুর্যোগ আশঙ্কা। আলিপুর আবহাওয়া দপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিম এবং মধ্য ভাগে নিম্নচাপের কারণে রবিবার বিকেল থেকেই দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টিপাত শুরু হতে পারে। সেই সঙ্গে ঘন্টায় ৩০ থেকে ৪০ কিমি বেগে ঝোড়ো হাওয়া বইবে। হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি, উত্তর এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনা, পূর্ব এবং পশ্চিম মেদিনীপুর এবং ঝাড়গ্রাম জেলায়। সোমবার হুগলি, উত্তর ২৪ পরগনা, পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া এবং পূর্ব ও পশ্চিম বর্ধমান জেলায় বজ্রবিদ্যুৎ-সহ বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে। আগামী ৪৮ ঘণ্টা সমুদ্রে যেতে নিষেধ করা হয়েছে মৎস্যজীবীদের। বিগত কয়েকদিনের টানা বৃষ্টি এবং ডিভিসি ব্যারেজের জল ছাড়ার কারণে ইতিমধ্যেই দক্ষিণবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে বৃষ্টি হলে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করা হচ্ছে।

Comments :0

Login to leave a comment