ভারত ও বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকরা ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে ভারতীয় উপমহাদেশকে বিপজ্জনক দিকে নিয়ে যেতে চাইছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। মার্কিন মদতে আফগানিস্তান থেকে সিরিয়া, পশ্চিম এশিয়ার সাম্প্রদায়িক মৌলবাদের উত্থানের বিপদ দেখে শিক্ষা নিয়ে দুই দেশের প্রগতিশীল মানুষদের একসঙ্গে সোচ্চার হওয়ার আহবান জানিয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে সেলিম বলেছেন, যে রাজনীতিকরা ধর্মের নামে উসকানি দিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়াচ্ছেন তারা দুই দেশের মানুষকেই বিপদে ফেলছেন। পশ্চিম এশিয়ায় এভাবে বামপন্থী প্রগতিশীলদের খতম করা হয়েছে, কাবুলে তালিবানরা নাজিবুল্লাহকে টেনে হিঁচড়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মেরেছে, এখন সিরিয়ায় আমেরিকা আর আলকায়দা এক শিবিরে এসে জমানা পরিবর্তন করছে। দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতীয় উপমহাদেশকে এই মৌলবাদীদের লীলাক্ষেত্র বানানো রুখতে হলে ভারতে এবং বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপরে আক্রমণকারী মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে নিজ নিজ দেশের প্রগতিশীল মানুষকে সোচ্চার হতে হবে।
ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতিকরা যেভাবে পরস্পরের দেশবাসীর উদ্দেশ্যে রণংদেহী হুঙ্কার দিচ্ছে তাকে দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণই শুধু নয়, ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর বিপজ্জনক রাজনীতি বলে উল্লেখ করেছেন সেলিম। তিনি বলেছেন, রাজনীতিকরা আগুন ছড়াবে আর কূটনীতিকরা আগুন নেভাবে? এভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের ঐক্য নষ্ট হবে। সার্ক নিষ্ক্রিয়, অথচ সার্ককে সক্রিয় করতে ভারতের বড় দায়িত্ব ছিল, ভারত সরকার মালদ্বীপে কূটনীতিক কার্যকলাপ শুরু করতে বিলম্ব করেছিল, এখন বাংলাদেশেও ভারতের পররাষ্ট্র সচিবকে পাঠাতে ৪ মাস সময় নিলো। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পরে সেখানে সংখ্যালঘুদের অধিকারের ওপরে আক্রমণের ঘটনার প্রতিবাদ করেছেন সেখানকার বামপন্থী ও প্রগতিশীলরা। বুকের পাটা নিয়ে সেখানে তাঁরা লড়ছেন। ভারতে দাঁড়িয়েও এখানকার সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সোচ্চার হতে হবে আমাদের। এক দেশের প্রগতিশীলদের প্রতি অন্য দেশের প্রগতিশীলদের সংহতি জানাতে হবে। তার বদলে রাজনীতিকরা ঘৃণা বিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন। আর এখানকার কিছু মিডিয়া সেই হিন্দুত্ববাদী বিষ প্রচার করছে।
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বিধানসভায় বাংলাদেশকে হুমকির সুরে বলেছেন, ‘আমরা কি ললিপপ মুখে বসে আছি!’ প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের বিএনপি নেতা হুমকি দিয়েছেন, ‘আমরা কি আমলকি চুষবো!’ এই বিদ্বেষমূলক প্রচারকেই বিপজ্জনক বলে চিহ্নিত করে সেলিম বলেছেন, ‘বাংলাদেশের মৌলবাদীদের মতো আমাদের এখানেও বিজেপি এবং তৃণমূল বিদ্বেষে ইন্ধন জোগাচ্ছেন। এগুলি দুইপক্ষের স্ক্রিপ্টেড ডায়ালগ। এদেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বাংলাদেশিদের উইপোকা বলেছিলেন, আর মুখ্যমন্ত্রীর মুখে ললিপপ মন্তব্য শোনা যাচ্ছে। ললিপপ ছেড়ে মুখ্যমন্ত্রী মুখে থামোর্মিটার দিলে বুঝতে পারবেন উনি কীভাবে উত্তেজনার পারদ চড়াচ্ছেন। এই সব মন্তব্য না করে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার নিজেদের দায়িত্ব পালন করুক। বিধানসভায় তো প্রতিবেশী দেশ নিয়ে আলোচনাই হওয়ার কথা নয়, মুখ্যমন্ত্রী এমন মন্তব্য করেন কী করে! চাকরি চুরি, কালীঘাটের কাকুর কাণ্ড, আর জি করের ঘটনা থেকে একের পর এক নাবালিকা ধর্ষণ, এসবের থেকে দৃষ্টি সরাতেই তৃণমূল আর বিজেপি বাংলাদেশ নিয়ে চেঁচাচ্ছে। বিজেপি নেতারা বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী নিয়ে না চেঁচিয়ে সীমান্ত রক্ষার ব্যবস্থা করুক। সেখানে তো কাঁটাতারের বেড়ার নামে এমন বন্দোবস্ত করেছে যাতে এরাজ্যের কৃষকদের চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
মঙ্গলবার আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালিত হয়েছে বিশ্বজুড়ে। সেলিম তার উল্লেখ করে বলেছেন, জাতি ধর্ম ভাষা নির্বিশেষে মানবাধিকার একটি সর্বজনীন বিষয়, এটা রক্ষার জন্য সব দেশ দায়বদ্ধ। ভারত বাংলাদেশ যেখানেই সংখ্যালঘুদের অধিকার আক্রান্ত হচ্ছে সেখানেই মানবতার অপমান হচ্ছে। বাংলাদেশে হলে সেটা খারাপ, আর ভারতে হলে ভালো- এমন মনোভাব নিয়ে কোনও দেশেরই সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা যায় না। বাংলাদেশে গত চার মাস ধরে যা হচ্ছে সেটা যেমন মানবাধিকার লঙ্ঘন, তেমনই ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপরে আক্রমণ, সাংবাদিক থেকে প্রতিবাদীদের জেলে পোরা, মিথ্যা মামলায় রাজনৈতিক বন্দিদের আটকে রাখা, খুন করা এগুলিও অন্যায়। বাংলাদেশে যেমন সংখ্যালঘুদের হত্যা, জেলবন্দি করা অন্যায়, তেমনই এখানে ওমর খালিদ, সঞ্জীব ভাটদের বন্দি করে রাখা অন্যায়।
এরাজ্যে বাংলাদেশি নাগরিকদের হোটেল বা হাসপাতালে প্রত্যাখ্যানের ঘটনাকেও মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করে সেলিম বলেছেন, আমি সাংসদ থাকাকালীন কলকাতায় জে বি রায় হাসপাতালকে তহবিল থেকে সাহায্য করেছিলাম, পরে সেটা তৃণমূল দখল নেয়, এখন সেটা বিজেপি দখল নিয়েছে। সেখানে পর্যন্ত রোগী প্রত্যাখ্যান হয়েছে। এগুলোই তো ঘৃণা বিদ্বেষের প্রচার ও রাজনীতির ফল। জাতি ধর্ম ভাষা কোনো কিছু দেখে চিকিৎসা করাটা ডাক্তারদের শপথ বিরোধী। আজকে বাংলাদেশী নাগরিকদের বিরুদ্ধে যা হচ্ছে তা এদেশের মুসলিমদের বিরুদ্ধেও হয়েছে। ঘর ভাড়া দেওয়া হয়নি, দাঙ্গার সময়ে চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। এই সাম্প্রদায়িকতা, সঙ্কীর্ণতা যদি প্রাদেশিক আকার নেয়, কাল যদি দক্ষিণ ভারতে চিকিৎসা করাতে গিয়ে আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হয় তাহলে সেটা ভালো হবে? মানবতা বিরোধী কোনও সঙ্কীর্ণতা ভালো নয়। সেটা ভারতীয়দেরও বুঝতে হবে, বাংলাদেশিদেরও বুঝতে হবে।
Md Salim
ধর্মের নামে উসকানি দিয়ে দু’দেশের মানুষকেই বিপদে ফেলছেন কিছু রাজনীতিক
×
Comments :0