সত্যব্রত ভট্টাচার্য: নবদ্বীপ
বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী নদীয়ায় ক্রমশ বাড়ছে সাম্প্রদায়িক উসকানি। হিন্দুত্ববাদ কায়েম করার ন্যক্কারজনক প্রচেষ্টার সঙ্গে নানা দুর্নীতি তীব্র গতিতে উর্ধমুখী। সর্বক্ষেত্রে পরিচিতিসত্তার রাজনীতি স্পষ্ট। তা প্রতিহত করার ডাক দিয়ে সোচ্চার হলো সিপিআই(এম)’র ২৫তম নদীয়া জেলা সম্মেলন। দেশ ও রাজ্যের ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মোকাবিলায় সাংগঠনিক প্রস্তুতি আরও বেশি জোরদার করার আহ্বান জানালেন পার্টির নেতৃবৃন্দ। শনিবার নবদ্বীপে সিপিআই(এম)’র ২৫তম নদীয়া জেলা সম্মেলনের উদ্বোধন করে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেন, আরএসএস-বিজেপি ও তৃণমূলের গোপন বোঝাপড়া মানুষের চেতনাবোধকে বিনষ্ট করছে, বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বামপন্থীরা এর সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলে সিপিআই(এম) সহ বাম দলগুলির অগ্রগতিকে রোখার চেষ্টা করছে শাসক দলগুলি। এর বিরুদ্ধে সমস্ত অংশের মানুষকে শামিল করে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করতে হবে। তিনি বলেন, পরিস্থিতির মোকাবিলায় মতাদর্শ ও সংগঠন খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই দুই ক্ষেত্রে আরও অনেক বেশি জোর দিতে হবে। সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছাতে হবে।
সিপিআই(এম) ২৫তম নদীয়া জেলা সম্মেলন উপলক্ষে নবদ্বীপের নাম রাখা হয়েছে কমরেড সীতারাম ইয়েচুরি ও কমরেড বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নগর। সম্মেলনের মঞ্চ হয়েছে কমরেড মৃদুল দে-র নামে। কৃষ্ণনগর থেকে সড়কপথে গিয়ে গৌরাঙ্গ সেতুর উপর উঠতেই দৃশ্যটা হঠাৎ বদলে গেল। বড় বড় তোরণ জুড়ে শুধুই লাল পতাকা। গোটা নবদ্বীপই সেজে উঠেছে লাল পতাকায়। সম্মেলনে পার্টির প্রবীণ নেত্রী ঝর্ণা চ্যাটার্জি পতাকা উত্তোলন করেন। শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন রমা বিশ্বাস। উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, পলাশ দাশ, জামির মোল্লা, মেঘলাল সেখ, অলকেশ দাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। রমা বিশ্বাস, এসএম সাদী, রঞ্জিত মণ্ডল, নাদির হোসেন মণ্ডল, গায়ত্রী সর্দারকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমন্ডলী সম্মেলন পরিচালনা করছে। উদ্বোধনের পর বিদায়ী জেলা সম্পাদক সুমিত দে খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করেন।
বক্তব্য রাখতে গিয়ে শ্রীদীপ ভট্টাচার্য বলেন, সিপিআই(এম)-কে অপ্রাসঙ্গিক করতে উঠে পড়ে লেগেছে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি। চূড়ান্তভাবে এর বিরোধিতা করতে হবে। বাম-গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে আরও বেশি ঐক্যবদ্ধ করে তুলতে হবে। মানুষ যাতে বিভ্রান্ত হয়, তার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বিজেপি-আরএসএস-তৃণমূল বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে মানুষের দুর্বলতায় আঘাত করছে, ক্রমাগত মিথ্যাচার করছে। সতর্ক থাকতে হবে, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে নিরন্তর সম্পর্ক রাখতে হবে।
এক জন কমিউনিস্টের আশু কর্তব্য স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, মেহনতি মানুষের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা বা দুরত্ব যাতে না তৈরি হয়, সেই অনুযায়ী পথ চলতে হবে। মানুষের কাছে পার্টি কতটা পৌঁছাতে পারছে, তা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। পুঁজির সঙ্কটের বিপদ, সাম্রাজ্যবাদীদের আগ্রাসী মনোভাব— এই সবেরই ফল ভুগতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। দেশ জুড়ে গরিব মানুষকে লুটে নেওয়ার ফন্দি ফিকির চলছে। একইভাবে এরাজ্যে তৃণমূলের দুর্নীতিও মাথাচাড়া দিয়েছে বিজেপি’র সঙ্গে গোপন বোঝাপড়ার হাত ধরেই। এক বিরাট ষড়যন্ত্র চলেছে চারদিকে। এই অবস্থায় সিপিআই(এম)’র স্বাধীন শক্তির আরও বৃদ্ধি ঘটাতে হবে।
ভট্টাচার্য বলেন, এখন লগ্নি পুঁজি থেকে ফাটকা পুঁজির দৌরাত্ম্য চলছে। পুঁজিবাদের লুটেরা চরিত্র সামনে আসছে। ফলে বেকারত্ব বাড়ছে। উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি হচ্ছে না। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের দমন নীতি আরও বেশি প্রকট হচ্ছে। ওদিকে আবার বিশ্বের প্রথম সারির পুঁজিবাদী দেশগুলির অবস্থাও কিন্তু ভাল নয়। কারণ, পুঁজিই আজ সঙ্কটে পড়েছে। তার ফল ভুগছেন সাধারণ মানুষ। জনগণ সমস্ত ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগী হচ্ছেন। ওদের রাজনীতি হচ্ছে বাইনারি পলিটিক্স, জায়গা দেবে না বামপন্থীদের। এই সব কিছুর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সিপিআই(এম’র সামনে একটিই পথ, তা হলো আন্দোলন। গ্রামীণ সর্বহারাদের, নানা অংশের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে হবে। শ্রেণি আন্দোলনকে আরও অনেক জোরদার করতে হবে। গড়ে তুলতে হবে নাগরিক আন্দোলনও।
খসড়া সম্পাদকীয় প্রতিবেদন পেশ করে সুমিত দে বলেন, চিরকাল প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়েই এগিয়েছে কমিউনিস্ট পার্টি। সিপিআই(এম)’র দীর্ঘ লড়াইয়ের ইতিহাসও আছে। নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পার্টিকে এগতে হবে, আরও অনেক অনেক মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। কারণ, আরএসএস চাইছে ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র। মানুষের মস্তিষ্ককে বিভ্রান্ত করাই উদ্দেশ্য। এটা একটা বিরাট বিপদ। সাম্প্রদায়িকতার বীজ পোঁতা হয়েছে চারদিকে। এই নদীয়া জেলাতেও তাই। পাশাপাশি দখলের রাজনীতিও চলছে। তাই আন্দোলনের নতুন নতুন ধারা ও দিকগুলিকে নিয়ে ভাবতে হবে।
পার্টির ত্রুটি-দুর্বলতাগুলি তুলে ধরে তিনি বলেন, সাফল্য পেতে গেলে মতাদর্শগত সংগ্রাম জরুরি। আন্দোলনে আরও বেশি ধারাবাহিকতা চাই। সিপিআই(এম)’র আদর্শ ও চিন্তাভাবনার মধ্যে আরও বহু মানুষকে যুক্ত করতে হবে। ব্যাপক অংশের মানুষের কাছে পৌঁছাতে আরও অনেক সৈনিক তৈরি করতে হবে। শুধু স্লোগান তুলে নয়, প্রকৃতভাবেই শোষণ-বঞ্চনায় ও সমস্যায় মানুষের পাশে থাকতে হবে, শ্রমিক-কৃষক ঐক্যে আরও বেশি করে জোর দিতে হবে। সেই সঙ্গে স্থানীয় দাবিদাওয়াকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। মূল কথা হলো, শ্রেণি আন্দোলন ও সামাজিক আন্দোলন— এই দু’টিকেই সম্পৃক্ত করতে হবে।
এদিন প্রতিনিধিদের আলোচনাতেও উঠে এসেছে লাল ঝাণ্ডার লড়াইয়ের মেজাজ। মানুষের দাবিতে আরও আন্দোলনের মধ্য দিয়েই মানুষের আরও কাছাকাছি যেতে হবে, বলেন প্রতিনিধিরা। আলোচনায় এসেছে সার, বিদ্যুতের অত্যধিক দাম বৃদ্ধির কথা। সঙ্গে উঠেছে ফসলের অভাবী বিক্রির কথাও। ঋণের ভারে জর্জরিত কৃষকদের কথা যেমন তুলে ধরেছেন প্রতিনিধিরা, তেমনই কর্মহীন শ্রমিক পরিবারের কথাও প্রসঙ্গক্রমে এসেছে। বিভিন্ন এলাকায় যে সন্ত্রাস চলছে, তাও ব্যাখ্যা করেছেন প্রতিনিধিরা। সম্মেলন চলবে রবিবার পর্যন্ত।
Comments :0